টিটেনাসের কারণ কি সত্যিই মরচে পড়া লোহা? যে তথ্য সামনে আসছে
মরচে পড়া লোহায় আঘাত লেগে শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে আমরা ভয় পাই এই বুঝি টিটেনাস হল। সেই ভয়ে আমরা টেট-ভ্যাক বা টিটেনাসের ভ্যাকসিনও নিয়ে থাকি। মূলত আমরা ভয় পাই লোহার ওই মরচে ধরা অংশকে, রসায়নের ভাষায় বললে আয়রন অক্সাইডকে (Iron Oxide)। অনেকের ধারণা ওই মরচেই আসলে টিটেনাসের কারণ। আবার অনেকে মনে করেন লোহায় কাটা মানেই টিটেনাস সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
পশ্চিমবঙ্গ কেন, ভারতবর্ষ এমনকী গোটা পৃথিবীর অগুনতি জায়গায় জলে আয়রন অক্সাইড পাওয়া যায়, সেই জল অনেকে পানও করছেন নিয়মিত। তাঁদের শরীরে নিয়মিত আয়রন অক্সাইড পানীয় জলের সঙ্গে ঢুকলেও তাঁরা তো টিটেনাসে ভুগছেন না!
তাহলে টিটেনাসের কারণ কী?
আদতে টিটেনাসের কারণ কিন্তু লোহার মরচে ধরা অংশ বা আয়রন অক্সাইড নয়। টিটেনাসের আসল কারণ ক্লস্ট্রিডিয়াম টিট্যানি (Clostridum tetani) নামের একটি ব্যাক্টিরিয়া। এবং টিটেনাসের সঙ্গে মরচে ধরা লোহা বা আয়রন অক্সাইডের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই।
কেবল মরচে ধরা লোহার গায়েই নয়, এই ব্যাক্টিরিয়া পাওয়া যেতে পারে ধুলো-মাটি থেকে শুরু করে প্রাণীদের মলেও। শরীরের কোনো ক্ষত বা চামড়ার কাটা অংশের মধ্যে দিয়েই সহজে আক্রমণ করতে পারে ক্লস্ট্রিডিয়াম টিট্যানি।
এমনকী পোকার কামড়েও ছড়াতে পারে এই অসুখ, যদি কোনো ভাবে সেই পোকাটির শরীরে ক্লস্ট্রিডিয়াম টিট্যানি অর্থাৎ টিটেনাসের জীবানু লেগে থাকে। মরচে ধরা লোহা তো দূরের কথা, দেখা গেল আপনি লোহাতেও কোনো আঘাত পাননি, অথচ আপনার শখের বাগানে কাজ করতে করতে, আপনার শরীরের কোনো ক্ষত বা কাটা অংশে মাটি লেগে গেল। টিটেনাসের জীবাণু কিন্তু সেই মাটি থেকেও ছড়াতে পারে শরীরের কাটা অংশ দিয়ে প্রবেশ করে। ।
ঠিক কী কী ক্ষতি করতে পারে টিটেনাসের জন্যে দায়ী ব্যাক্টেরিয়া?
মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সেন্টার ফর ডিজি়জ় কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (Centre for Disease Control and Prevention) বা সি.ডি.সির (CDC) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ছয় বছরের একটি শিশুর কপালে আঘাত পেয়ে ক্ষতর সৃষ্টি হয় এবং তার কিছুদিন পরেই বাচ্চাটির টিটেনাস সংক্রমণ হয়। বাচ্চাটি হাসপাতালে সাতান্ন দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে ফেরে ঠিকই, হাসপাতালে থাকাকালীনই বাচ্চাটির শরীরে স্প্যাজ়ম শুরু হয় পেশি ও দাঁতের চোয়ালে; এর পাশাপাশি দেখা যায় অনিয়মিত হার্ট রেট, রক্তচাপ, এবং দৈহিক তাপমাত্রা।
যদি সঠিক সময় অন্তর টিটেনাসের ভ্যাক্সিন নেওয়া না থাকে, তাহলে টিটেনাসের জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার তিন থেকে একুশ দিনের মধ্যে রোগের সূত্রপাত হয়। সি.ডি.সি-এর মতে সাধারণত এর কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কিন্তু সমস্যা হয় পরে, যখন শরীরের মধ্যে এই ব্যক্টিরিয়াগুলি স্বাভাবিক নিয়মেই মারা যেতে শুরু করে। কারণ তার পরেই নিউরোটক্সিন (Neurotoxin) তৈরি হতে শুরু করে তাদের মৃতদেহ থেকে।
নিউরোটক্সিন কী?
সোজা কথায় এমন কিছু বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, যা আমাদের (এমনকি অন্যান্য প্রাণীর শরীরেও) নার্ভকোষ, মস্তিষ্কে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং তার ফলে একাধিক নার্ভজনিত অসুখ দেখা যায়।
ক্লস্ট্রিডিয়াম টিট্যানির মৃত কোশ থেকে তৈরি হওয়া নিউরোটক্সিন (Neurotoxin) বিশেষ ভাবে GABA বা গামা অ্যামাইনো বিউটাইরিক অ্যাসিডের (Gamma amino butyric acid) ক্ষরণকে ব্যহত করে। GABA কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের (Central nervous system) কাজ নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে । শুধু তাই নয়, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম, নিউরোন বা নার্ভকোশের স্বাভাবিক কাজ, একটি স্নায়ুকোশ থেকে আরেক স্নায়ুকোশে বার্তা পাঠানো, স্নায়ুকোশের নিজস্ব আন্তঃর্জাল বা নেটওয়ার্ক (Neuronal network) সুষ্ঠ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করাও GABA-এর কাজ।
এ ছাড়াও এই পেশির সংকোচন-প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করে GABA। এর কাজ বাধা পেলে স্প্যাজ়ম থেকে শুরু করে, মুখ বেঁকে যাওয়া বা হাত-পায়ের পাতা চিরকালের মত বেঁকে অকেজো হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন-১২০ বছর পূর্তি! যে ভাবে সাজছে লাখো বাইকারের প্রিয় রয়েল এনফিল্ড
তাহলে মরচে পড়া লোহার সাথে টিটেনাসের সম্পর্ক কী?
মরচে পড়া লোহা বা পেরেকের সাথে কী ভাবে টিটেনাস ওতোপ্রোত ভাবে সম্পর্কযুক্ত তা এখনও অজানা। কিন্তু আয়রন অক্সাইড মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর নয়, অন্তত টিটেনাসে সংক্রমণের কারণ তো নয়ই। তাহলে আয়রন অক্সাইড মেশা জল পান করলে, আমাদের টিটেনাস হত।
তবে গবেষকদের ধারণা, মরচে ধরা লোহা অর্থাৎ আয়রন অক্সাইড টিটেনাসের জীবাণুর (ক্লস্ট্রিডিয়াম টিটানি) বেড়ে ওঠার আদর্শ জায়গা। হয়তো সেই জন্যেই মরচে ধরা লোহা বা পেরেকে আঘাত পাওয়ার সাথে টিটেনাসের এত সরাসরি সম্পর্ক আছে।
টিটেনাসের হাত থেকে বাঁচতে কী করণীয়?
দশ বছরে তিনবার টিটেনাসের ভ্যাকসিন এবং একটি বুস্টার ডোজ়ই যথেষ্ট টিটেনাসের সংক্রমণ আটকাতে - একশো ভাগ কার্যকরীও হয়েছে এই পদ্ধতি। এমন নয় যে সংক্রমণ কেবল মরচে পড়া লোহা থেকে হলেই ভ্যাক্সিন ও বুস্টার ডোজ় কাজ করবে। সংক্রমণ যে ভাবেই হোক না কেন, ভ্যাক্সিন ও বুস্টার ডোজ় কাজ করবেই যদি তা নিয়মমাফিক নেওয়া হয়।