কেন হারাল সংস্কৃত ভাষা? প্রাণ ফেরা সম্ভব?
World Sanskrit Day: প্রাচীন সাহিত্য থেকে পুঁথি, শাস্ত্র থেকে মহাকাব্য, সমস্ত কিছুই রচনা হয়েছে যে ভাষায়, কালের স্রোতে ক্ষয়ে গিয়েছে সেই ভাষার মেরুদণ্ড। সামান্য কিছু স্কুলে বিকল্প বিষয় হিসেবে এবং পুরোহিতের মন্ত্রে শুধু বেঁচ...
ভাষা আসলে বহমান নদীর মতো। যে নদী স্রোত হারায়, সেই নদীর বুকে জমতে থাকে শ্যাওলা। ঠিক তেমন ভাবেই ব্যবহারের অভাবে ভাষার বুকেও জমতে থাকে পলি। ক্রমশ স্রোত হারায় সেই ভাষা। ঠিক যে ভাবে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে অজস্র ভাষা। সেই বিলুপ্তপ্রায় ভাষার মিছিলে নাম লিখিয়েছে সংস্কৃতও। সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম ভাষা।
সমীক্ষা বলছে, গত পাঁচ দশকে দু'শোর বেশি ভাষা মুছে গিয়েছে। আর তার কারণ একটাই, অব্যবহার। বিশেষ কিছু ভাষার আগ্রাসন সেই সব ভাষাব্যবহারকারীদের ক্রমশ কোণঠাসা করেছে। আর তাঁরাও নিজস্ব ভাষার শিকড় ছাড়িয়ে এসে ঢুকেছে মূল ভাষার স্রোতে। যার ফলে হারিয়ে গিয়েছে সেই সব ভাষা।
আরও পড়ুন: বাংলা ভাষার হিন্দি-রোগ কিংবা হিন্দিযোগ
তবে সংস্কৃত এককালে ছিল রাজার ভাষা। প্রাচীন সাহিত্য থেকে পুঁথি, শাস্ত্র থেকে মহাকাব্য, সমস্ত কিছুই রচনা হয়েছে যে ভাষায়, কালের স্রোতে ক্ষয়ে গিয়েছে সেই ভাষার মেরুদণ্ড। সামান্য কিছু স্কুলে বিকল্প বিষয় হিসেবে এবং পুরোহিতের মন্ত্রে শুধু বেঁচে রয়েছে সেই ভাষা। এবং বলাই বাহুল্য শ্বাসবায়ু তার ধিকিধিকি। একটা সময় পর্যন্ত স্কুলগুলিতে সংস্কৃত শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। তবে ক্রমাগত দেখা গিয়েছে, সংস্কৃত পড়ে ভবিষ্যতে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কোনও সুযোগসুবিধা মিলছে না। সংস্কৃত ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে সেটাও একটা বড় কারণ।
একদিকে যখন সংস্কৃত ভাষা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত, সরকার তখন জোর দিচ্ছে রাষ্ট্রভাষায়। ফলে এই যে ভাষার ক্ষয়ে যাওয়া, তার একটা বড় অংশের দায় বর্তায় সরকারের কাঁধেও। কারণ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার কারিগরেরা জোর দিয়েছেন হিন্দির উপরে, তাতে আঞ্চলিক ভাষা যেমন মর্যাদা হারিয়েছে, তেমনই ক্ষয় পেয়েছে দেবভাষাও। অথচ হিন্দুত্ববাদীরা যে রামায়ণ নিয়ে এত গৌরব করে, কার্যত জয়শ্রীরাম জপ করে, সেই রামায়ণও কিন্তু লেখা হয়েছিল সংস্কৃততেই। অথচ সেই দেবভাষার কোনও গুরুত্ব নেই আজকের ভারতে।
যদিও বিশ্ব সংস্কৃত দিবস উপলক্ষে জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কতটা তাৎপর্যপূর্ণ এই ভাষা। সংস্কৃত ভাষায় একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে জাতিকে তিনি আওড়াতে বলেছেন তা। তাতেই নাকি সংস্কৃতকে উদযাপন করা হবে। টুইটার তথা মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এও এই মর্মে শুভেচ্ছাবার্তা শেয়ার করেন তিনি।
গত ২৭ অগস্ট, রবিবারই 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে সংস্কৃত ভাষার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন মোদি। জানিয়েছিলেন এই প্রাচীন ভাষা সম্পর্কে। বহু আধুনিক ভাষার জননী বলেও সংস্কৃতকে সম্বোধন করেন তিনি। পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষা কেন বিজ্ঞানসম্মত এবং তার ব্যকরণগত দিকগুলোর কথাও তুলে ধরেন তিনি। তিনি জানান, সংস্কৃত ভাষার সচেতনতা নাকি ইদানীং মানুষের মধ্যে বেড়েছে।
সত্যিই কি সংস্কৃত ভাষার দুর্দিন ঘুচেছে। না, আশপাশে তাকালে তেমনটা কিন্তু মনে হয় না। বরং ক্রমশ তা ক্ষয়ীষ্ণু হতে হতে অবলুপ্তির পথে। সংস্কৃতকে বাঁচাতে সরকার তেমন কোনও পদক্ষেপ করেনি। তবু প্রাচীন এই ভাষাকে বাঁচানোর অনর্গল চেষ্টা করেছে কর্ণাটকের শিমোগা জেলার মাট্টুর গ্রাম। ভারতের একমাত্র গ্রাম, যেখানকার প্রধান ভাষা সংস্কৃত। না, শুধু পাঠোভ্যাস নয়, এ গ্রামের মানুষ কথা পর্যন্ত বলেন প্রাচীন দেবভাষাতেই।
গ্রামের ভিতরে পা রাখলেই দেখবেন, আট থেকে আশি, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালাচ্ছেন সংস্কৃততে। সেখানকার মাতৃভাষাই যে সংস্কৃত। তবে এই কৃতিত্ব শুধু গ্রামবাসীর নয়, বরং 'সংস্কার ভারতী' নামে একটি স্কুলের। সেই স্কুলেই প্রতিদিন পাঁচ হাজার করে পড়ুয়া সংস্কৃত শেখেন সেখানে। প্রাচীন ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না সংস্কার ভারতী। এই গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে সংস্কৃতের চেয়ে সহজ আর কিছুই নেই। তাঁরা মনে করেন, সংস্কৃত ভাষা থেকেই জন্ম হয়েছে এশিয়া মহাদেশের বহু ভাষার। সে কারণেই এই ভাষা শেখা অনেক সহজ।
আরও পড়ুন:মৃত ভাষায় কথা বলতে পারে তোতাপাখি! যে ঘটনা চমকে দিয়েছে বিশ্বকে…
যেখানে নরঃ- নরৌ-নরাঃ মুখস্থ করতেই দাঁত পড়ে যায় ছেলেমেয়েদের, যেখানে ক্রমাগত অবহেলায় মরে যেতে বসেছে দেবভাষা সংস্কৃত, সেখানে এই গ্রামের মানুষ সংস্কৃত সহজ করে তুলেছেন শুধুমাত্র আগ্রহ আর অধ্যবসায়ের জোরে। মাত্র দশ বছর বয়সেই বেদ পড়তে শুরু করে এ গ্রামের খুদেরা। বছর কয়েক আগে নাকি সংস্কৃত ভাষাকে সিবিএসই সিলেবাসে বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মোদি সরকার। তবে শুধু মাত্র নিয়ম নীতি করে এ ভাষাকে বাঁচানো কঠিন বলেই অনুমান। ভাষা বাঁচে ব্যবহারকারীর আদরে, যত্নে। যে যত্ন থেকে বহুকাল ধরেই বঞ্চিত দেবভাষা সংস্কৃত। শিমোগার ছোট্ট গ্রাম পেরেছে। প্রাচীন সংস্কৃতি ও সংস্কৃত, দুটোকেই বাঁচিয়ে জীবনে জায়গা দিতে পেরেছে তাঁরা। ভারত পারবে না?