চাঁদের মাটি ছোঁয়ার অপেক্ষায় চন্দ্রযান-৩, ভারতের চাঁদে যাওয়ার নেপথ্যে যেসব তুখোড় মস্তিষ্ক...
Chandrayaan-3, ISRO: একদিন, দুদিন নয়, টানা চার বছর ধরে চন্দ্রযান ৩ নিয়ে পড়ে রয়েছেন অজস্র বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার। তবে সে তো একদিনের পথ নয়। প্রথম চন্দ্রযান পাঠানো থেকে এই তৃতীয় চন্দ্রযান পর্যন্ত পৌঁছনোর পথে পড়ে রয়েছে অনেক...
সেই মাহেন্দ্রক্ষণের থেকে সামান্যই দূরে দাঁড়িয়ে আমরা। চাঁদের মাটি ছোঁয়ার স্বপ্ন আমাদের আজকের নয়। আমেরিকা, রাশিয়া, চিনের মতো হাতে গোনা কয়েকটি দেশই কেবল চাঁদের মাটিতে নিজেদের পদচিহ্ন রাখতে পেরেছে। সেই এলিট দেশেদের দলে ভারতও ঢুকে পড়তে পারবে কিনা তা ঠিক করে দেবে অবতরণের সেই মুহূর্তে।
এর আগেও একাধিক বার চাঁদ জয়ের চেষ্টা করেছে ভারত। সফলতা আসেনি বটে, তবে প্রতিবার আরও একটু করে সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে ভারতের মুন মিশন। ২০১৯ সালে চন্দ্রযান ২ মহাকাশে পাঠিয়েছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। চাঁদের কক্ষপক্ষে পৌঁছেও গিয়েছিল সেটি। তবে অবতরণের সময়েই ঘটে দুর্ঘটনা। সফটওয়্যারের গোলযোগে ব্রেক কাজ করেনি ঠিক মতো। সফট ল্যান্ডিংয়ের আগেই চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রযান ২। কিন্তু শুধু তো চন্দ্রযান ২ ভাঙেনি। তার সঙ্গেই ভেঙেছিল একদল বিজ্ঞানীর স্বপ্ন, ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের বিগত কয়েক বছরের লাগাত পরিশ্রম। তবে তার পরেও থামেনি বিজ্ঞানসাধনা। বরং পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নয়া উদ্যমে তাঁরা হাত দিয়েছিলেন চন্দ্রযান-৩-কে প্রস্তুত করতে। গত ১৪ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে মহাকাশে পাড়ি দেয় চন্দ্রযান ৩। গত ৫ অগস্ট তা পৌঁছেও গিয়েছে চাঁদের কক্ষপথে। এবার অপেক্ষা কেবল চাঁদকে ছোঁয়ার।
আরও পড়ুন: শেষপর্যন্ত চাঁদের মাটি স্পর্শ করতে পারবে তো চন্দ্রযান ৩?
চন্দ্রযান ৩-কে প্রস্তুত করে চাঁদের জন্য রওনা করতেই সময় লেগে গিয়েছে প্রায় চার বছর। অর্থাৎ প্রায় চন্দ্রযান ২ -এর ব্যর্থতার পর থেকেই ফের কোমর বেঁধে ফেলেছিল ইসরো। এমনকী করোনা অতিমারির জেরে যখন পৃথিবী কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে সময়েও কাজ বন্ধ করেননি বিজ্ঞানীরা। ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথ জানিয়েছেন,প্রায় সাতশো কোটি টাকার মিশন এই চন্দ্রযান ৩। আর তার পিছনে লাগাতার কাজ করে গিয়েছেন অন্তত এক হাজার বিজ্ঞানী। তবে মূল মস্তিষ্ক হিসেবে উঠে এসেছে কয়েকজন মহাকাশবিজ্ঞানীর নাম। আর সেই তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথের নাম। চন্দ্রযান ৩ মিশনের নেপথ্যে থাকা অন্যতম মানুষ তিনি।
এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার এস সোমনাথ সাহায্য করেছিলেন লঞ্চ ভেহিকেল মার্ক-৩ বা বাহুবলি রকেটের নকশায়। চন্দ্রযান ৩-কে কক্ষপথ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হয়েছিল এই লঞ্চ ভেহিকেলই। পাশাপাশি ভারতীয় মহাকাশ গবেশণা সংস্থার প্রধান হিসেবে চন্দ্রযান ৩-টি সব দিক থেকে চাঁদের মাটি ছোঁয়ার জন্য প্রস্তুত কিনা, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল তাঁরই কাঁধে। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। মজার ব্যাপার, এস সোমনাথ কিন্তু সংস্কৃততে বেশ পটু। এমনকী একটি সংস্কৃত ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
চন্দ্রযান ৩ যাঁদের ছাড়া চন্দ্রাভিযান করতেই পারত না, তাঁদের মধ্যে অন্যতম উন্নিকৃষ্ণান নায়ার এস। তিরুবনন্তপুরমের বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের ডিরেক্টর তিনি। গোড়া থেকেই এই প্রজেক্টটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। তিনিও একডন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। এই অভিযান সফল হলেই চাঁদের মাটিতে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। আর সেই অভিযানেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন উন্নিকৃষ্ণান। তাঁরও পড়াশোনা বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স থেকে। হিউম্যান স্পেস ফ্লাইটের প্রথম ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। এর আগেও একাধিক জটিল মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গগনযান মিশনে। তাঁরই নেতৃত্বে লঞ্চ ভেহিকেল একশো শতাংশ নির্ভুলতার সাহায্যে কক্ষপথে পৌঁছে দিয়েছিল মহাকাশযানটিকে।
এরপরেই সেই তালিকায় রয়েছে চন্দ্রযান ৩ মিশনের প্রজেক্ট ডিরেক্টর বীরমুথুভেল পি। বেঙ্গালুরুর ইউআর রাও স্যাটেলাইট সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত বীরমুথুভেলর জীবন গত চার বছর ধরে আবর্তিত হয়েছে ওই চন্দ্রযানকে কেন্দ্র করেই। চেন্নাইয়ে এমটেক করেন বীরমুথুভেল। চন্দ্রযান ২-এর সঙ্গেও ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। ছিলেন মঙ্গলযান মিশনের সঙ্গেও।
চন্দ্রযান ৩ মিশনের ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার কল্পনা কে-ও ইউআর রাও স্যাটেলাইট সেন্টারের ইঞ্জিনিয়ার। কোভিড অতিমারির সময়েও যে চন্দ্রযান ৩-এর কাজ এতটুকু থামেনি, তার পুরো কৃতিত্বই বোধহয় যায় কল্পনার কাঁধে। নিজের গোটা জীবনটাই মহাকাশ গবেষণায় উৎসর্গ করেছে তিনি। চন্দ্রযান ২ এবং মঙ্গলযান মিশনেরও অংশ ছিলেন তিনি।
রয়েছেন এই মিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর এম ভানিথা। ইলেকট্রনিক্স সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার ভানিথা চন্দ্রযান ২ মিশনের সময়ে ছিলেন প্রজেক্ট ডিরেক্টর। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা, যিনি চন্দ্রাভিযান মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। চন্দ্রযান ২ নিয়ে তাঁর জ্ঞান এই প্রজেক্টকে নির্ভুল করে তোলার ক্ষেত্রে অনেকটাই কাজে এসেছে। মহাকাশ ছাড়া নিজের ভালোবাসার জায়গা বাগান।
এই মিশনের সঙ্গে ভীষণভাবে রয়েছে ইউআর রাও স্যাটেলাইট সেন্টারের ডিরেক্টর এম শঙ্করন। এককথায় ইসরোর পাওয়ার হাউজ তিনি। নোবেল পাওয়ার সিস্টেম তৈরিতে তার মতো সিদ্ধহস্ত কম লোকই আছেন। সেই সোলার পাওয়ার সিস্টেমই প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করবে স্যাটেলাইট তথা উপগ্রহটিকে। চন্দ্রযান ১, মঙ্গলযান, চন্দ্রযান ২- প্রায় সবকটি স্যাটেলাইটে নিজের সাক্ষর রেখেছেন শঙ্করন। চাঁদের মাটি থেকে সমস্ত গতিবিধি যাতে ইসরোর কাছে পৌঁছয়, তা দেখার গুরুভারও তাঁরই কাঁধে। পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে শঙ্করনের।
চন্দ্রযান-৩ মিশনে বুদ্ধি ও শ্রম ঢেলেছেন তিরুবনন্তপুরমের লিকুইড প্রপালসন সিস্টেম সেন্টারের ডিরেক্টর ভি নারায়নন। লিকুইড প্রপালসন ইঞ্জিনের বিশেষজ্ঞ তিনি। এই যে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে সফট ল্যান্ডিং শব্দটি। আগের বার অবতরণের সময়ে জোরে আছড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রযান ২। এবার ইসরোর প্রথম লক্ষ্য, তেমন ভুল যেন আর না হয়। এই যে চাঁদের মাটিতে মাখনের মতো নেমে আসবে চন্দ্রযান ৩, তার সমস্ত প্রস্তুতিপর্বই সামলেছেন নারায়নন। আইআইটি খড়্গপুরের প্রাক্তনী নারায়ননের বিশেষ দক্ষতা রয়েছে কায়রোজেনিক ইঞ্জিনে। ইসরোর প্রায় সমস্ত রকেটের সঙ্গেই যুক্ত থেকেছেন তিনি। ছাপ রেখেছে লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-৩-এও।
সবশেষে যাঁর নাম না করলেই নয়, তিনি ইসরোর টেলিমেট্রি ট্র্যাকিং অ্যান্ড কম্যান্ট নেটওয়ার্ক, বেঙ্গালুরুর ডিরেক্টর বিএন রামাকৃষ্ণা। এই চাঁদের কক্ষপথ জুড়ে এত নাচানাচি করে বেড়াচ্ছে চন্দ্রযান-৩, তার রিমোট অনবরত সামলে চলেছেন যিনি, তিনি রামাকৃষ্ণা। ইসরোর বাইরে লাগানো রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় ডিশ অ্যান্টেনাটি। যার ব্যাস ৩২ মিটারের কাছাকাছি। সেটির মাধ্যমেই অনবরত কম্যান্ড পাঠিয়ে যেতে হয় বিক্রম ল্যান্ডারের কাছে। সেই কাজটাই দায়িত্ব সহকারে করে চলেন এই বিজ্ঞানী।
আরও পড়ুন: চাঁদে কি আদৌ কোনও দিন পা দিয়েছিলেন নীল আর্মস্ট্রং?
এ ছাড়াও সারাদিন-রাত অনবরত পরিশ্রম করে চলেছেন আরও কয়েক হাজার বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার। একদিন, দুদিন নয়, টানা চার বছর ধরে চন্দ্রযান ৩ নিয়ে পড়ে রয়েছেন তাঁরা। তবে সে তো একদিনের পথ নয়। প্রথম চন্দ্রযান পাঠানো থেকে এই তৃতীয় চন্দ্রযান পর্যন্ত পৌঁছনোর পথে পড়ে রয়েছে অনেক ত্য়াগ, অনেক পরিশ্রম। আর কয়েকমুহূর্তের অপেক্ষা। তার পরেই ইতিহাস গড়ে চাঁদের মাটিতে পা রাখতে চলেছে চন্দ্রযান ৩। তবে সত্যিই সে ইতিহাস আজই রচনা হবে, না তার জন্য আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি বুঝে নেবেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। আসলে এ বার আর কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চাইছে না ইসরো। অবতরণের জন্য নির্ধারিত সময় দেওয়া হয়েছিল বুধবার সন্ধে ৬টা বেজে চার মিনিটে। তবে সত্যিই সেই সময়ে চাঁদের মাটি ছুঁতে পারবে কিনা স্যাটেলাইটটি, তার সিদ্ধান্ত ঘণ্টা দুয়েক আগে নেওয়া হবে বলেই জানিয়েছিলেন ইসরো প্রধান এস সোমনাথ। আপাতত সেই আশাতেই বুক বাঁধছে গোটা দেশ। জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে এমনই একটি মাহেন্দ্র মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার জন্য উদগ্রীব বোধহয় সকলেই।