দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিয়ে যায় যে ছবির মুহূর্তরা
Rituparna Ghosh: হ্যারির এই কথাগুলির ভিত্তিভূমি থিয়েটার। এরপর তার সামনে সিদ্ধার্থ এনে দাঁড় করায় চলচ্চিত্রের দর্শনকে। আর তখন, হ্যারি-সিদ্ধার্থ নয়, আমাদের মনে হয় মুখোমুখি কথা বলছে যেন স্বয়ং থিয়েটার আর সিনেমা।
সিনেমা ও কবিতার পারস্পরিক সংযোগবিন্দুটি সম্পর্কে একবার কথা বলতে-বলতে শঙ্খ ঘোষ পৌঁছেছিলেন এই ধারণায় :
“ শব্দ দিয়ে ছবি তৈরি করে কবিতা। ছবি দিয়ে শব্দ তৈরি করে ফিল্ম। কবি যদি যোগ্য হন, তাঁর ব্যবহৃত শব্দের ভেতর দিয়ে ছবিটাকে ঠিক-ঠিক দেখতে পান পাঠক, প্রায় ছুঁতে পান যেন। আর ফিল্মে, তার সূচনাযুগে উচ্চারিত সংলাপ ছিল না কোথাও, তখন দর্শকের কাছে সে তো পৌঁছত কেবল ছবির পরম্পরার মধ্যে দিয়ে, ছবিরই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে, শব্দের সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে যেমন কবিতা। ”
শঙ্খ ঘোষের এই লেখাটির নাম ‘ফিল্মের মধ্যে কবিতা’। আগ্রহী পাঠক ‘শতবর্ষ চলচ্চিত্র’-এর প্রথম খণ্ডে প্রবন্ধটি খুঁজে পাবেন।
কী বলছেন শঙ্খ ঘোষ? ‘শব্দ দিয়ে ছবি তৈরি করে কবিতা। ছবি দিয়ে শব্দ তৈরি করে ফিল্ম।’ এখানে ‘শব্দ’ কথাটি শুধুমাত্র সিনেমায় দেখাতে পাওয়া শব্দসমূহ নয়, ‘অর্থ প্রকাশ’ কথাটির সঙ্গে কিছুটা হলেও এর সংযুক্তি রয়েছে। অনেকগুলি নীরব অথচ তীব্র ছবির একত্র সজ্জায় আমরা বলে উঠি ‘বাঃ…’। এই সেই বিস্ময়শব্দ, যা তেমন কোনও শিল্পের সামনে দাঁড়ালে, মনের ভিতরে এমনিই জন্মায়। কিন্তু আমি এ-লেখাটির দৃষ্টি-অভিমুখকে বিশেষভাবে নির্দেশ করতে চাই শঙ্খ ঘোষের বলা এই বাক্যটির মধ্যে,
‘…ফিল্মে, তার সূচনাযুগে উচ্চারিত সংলাপ ছিল না কোথাও, তখন দর্শকের কাছে সে তো পৌঁছত কেবল ছবির পরম্পরার মধ্যে দিয়ে, ছবিরই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে’।
— এখানে ‘সংঘর্ষ’ কথাটিকে খেয়াল করতে অনুরোধ করব।
আরও পড়ুন: প্রতিশোধের উত্তাপে সমতার ভূমি খুঁজে চলে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’
সিনেমায়, একটি দৃশ্যের সঙ্গে আরেকটি দৃশ্য সর্বদা যুক্ত হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, একটি দৃশ্য-ই ঠিক করে দেয় সিনেমার পরবর্তী দৃশ্যের জন্মনিয়তি, যা অনেকটা আমাদের জীবনের মতোই। সিনেমাটি দেখার সময় হয়তো সেই সংযোগ প্রত্যক্ষভাবে আমার কাছে ধরা দেয় না। কিন্তু পরে, কিংবা বহু পরে সিনেমার দৃশ্যসজ্জার সেই সেতু আমরা আস্তে-আস্তে বুঝতে পারি।
উৎপল দত্তের ‘আজকের সাজাহান’ নাটক থেকে ২০০৭ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ তৈরি করেছিলেন ‘দ্য লাস্ট লিয়র’। ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র হরিশ মিশ্রা বা হ্যারি একজন বৃদ্ধ, প্রাক্তন থিয়েটার অভিনেতা। আজীবন শেক্সপিয়র-এর নাটকে অভিনয় করেছেন। এবং তার জীবনের সর্বত্র এখনও শেক্সপিরিয়ান থিয়েটারের চিন্তার অণু-পরমাণু উড়ে বেড়ায়। যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। ‘দ্য লাস্ট লিয়র’-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সিদ্ধার্থ। চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন অর্জুন রামপাল। সিদ্ধার্থ একজন সিনেমা পরিচালক। তার ছবিতে সে হ্যারিকে অভিনেতা হিসেবে নিতে চায়। এবার আমরা এসে পৌঁছব সিদ্ধার্থ এবং হ্যারি-র প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটির কাছে।
সিদ্ধার্থ এসেছে হ্যারি-র বাড়িতে। দরজায় কোনও বেল নেই। তবে, দরজার পাশে কতগুলি অব্যবহৃত টিনের কৌটো-ঘণ্টা একটি মোটা দড়ির সঙ্গে আটকে ঝোলানো রয়েছে। সিদ্ধার্থ সেই দড়িটি ধরে নাড়ায়। হ্যারি নীচে নেমে এসে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এগুলো সত্যি বাজালে?’
সিদ্ধার্থ।। হ্যাঁ।
হ্যারি।। তোমাকে কি কেউ এগুলো বাজাতে বলল?
সিদ্ধার্থ।। না। কে বলবে?
হ্যারি।। তুমি নিজে থেকেই বাজালে?
সিদ্ধার্থ।। হ্যাঁ… কেন?
হ্যারি।। (অসম্ভব খুশি হয়ে) তোমার কেন মনে হল এটা বেল হিসেবে বাজানো যায়?
সিদ্ধার্থ।। আসলে, দরজায় কোনও বেল দেখতে পেলাম না। অথচ আমি বাড়ির ভেতরে যেতে চাই, তখন মনে হল এগুলো একটা কলিং বেল হিসেবে কাজ করতে পারে।
হ্যারি উৎফুল্ল হয়ে জানায়, যার সঙ্গে সে থাকে, বন্দনা— সে তাকে প্রায়-ই বলে, তাদের বাড়ির দরজায় একটা কলিং বেল লাগানো প্রয়োজন। কিন্তু হ্যারির মনে হয়, ইমাজিনেশন-কে প্রয়োগ করাই সবচেয়ে ভালো! এবং তার ভাবনা যে সঠিক তার প্রমাণ হল, সিদ্ধার্থ বুঝতে পেরেছে এই অব্যবহৃত বস্তুগুলিকে কলিং বেল রূপে ব্যবহার করা যায়।
ঠিক এই সময় একটা অব্যর্থ উত্তর দেয় সিদ্ধার্থ। সে বলে, ‘এই কলিংবেলগুলির কেবল একটা সমস্যা রয়েছে, ঝড় ওঠলে এরা উড়ে যাবে।’ এইবার সিদ্ধার্থ-র বলা ‘ঝড়’ শব্দটিকে শুধু মুঠোয় তুলে নিয়ে হ্যারি বলতে শুরু করে টানা একটি সংলাপ। শেষে, সিদ্ধার্থ বলে দেয় সেই সংলাপটির উৎস— মূল, ‘দ্য টেমপেস্ট’, অ্যাক্ট ১, সিন ২। হ্যারি মুগ্ধ, সিদ্ধার্থকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে বলে।
এই বিশেষ দৃশ্যটি সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলতে চাই। এর কয়েকটি দৃশ্য আগে, ‘দ্য লাস্ট লিয়র’-এ যীশু সেনগুপ্ত-কে দেখতে পাওয়া যায় যে সে-ও হ্যারির বাড়িতে যাচ্ছে অন্য এক প্রয়াত অভিনেতা সম্পর্কে সাক্ষাৎকার নিতে। তখন কিন্তু এই কলিংবেলটিকে দর্শকের সামনে আনেননি পরিচালক। সরাসরি হ্যারির ঘরে, দু'জনের কথোপকথনকে দেখেছিয়েছেন।
কিন্তু সিদ্ধার্থর ক্ষেত্রে, কলিংবেলের ইমাজিনেশন-এর দৃশ্যটি আনলেন কেন? আনলেন কারণ, সিদ্ধার্থ ও হ্যারি দু'জনেই আর্টিস্ট, এবং দু'জনেরই চিন্তামূলের ভিত্তি— কল্পনা বা ইমাজিনেশন।
আজ কথা শুরু করেছিলাম দৃশ্যের পরম্পরাকে ঘিরে। একটু ভেবে দেখলে হয়তো আমরা বুঝতে পারব, সিদ্ধার্থর হ্যারির বাড়ির দরজায় আসার দৃশ্যটি, তা আর পাঁচটা দৃশ্যের মতোই খুব সাধারণ। কিন্তু পরবর্তী সময় এই দৃশ্যটিই নির্ধারণ করে দেবে সিদ্ধার্থ ও হ্যারির বন্ধুত্ব। অর্থাৎ, প্রথমে কলিং বেল না-থাকা, তারপর অব্যবহৃত বস্তুগুলিকেই সবচেয়ে অব্যর্থ কলিং বেল ভাবা, তারপর ঝড়ে সে কলিং বেল উড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা এবং ‘ঝড়’ থেকে ‘দ্য টেমপেস্ট’-এর সংলাপে প্রবেশ— এ সবই কিন্তু একটি দৃশ্য থেকে সিনেমার ভবিষ্যৎদৃশ্যে যাওয়ার গতিপথ, যা আসলে ঘটছে ‘ছবিরই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে’।
‘ইমাজিনেশন’-র মধ্যে দিয়ে যাদের আলাপ হল, সেই সিদ্ধার্থ ও হ্যারির পরবর্তী কথোপকথনের রূপটি কেমন? পূর্বে বলেছি, সিদ্ধার্থ হ্যারি-র কাছে এসেছিল তার সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব নিয়ে। সেই প্রসঙ্গেই কথা ওঠে শো’রিল-এর। হ্যারি জিজ্ঞেস করে, সেটা কী? সিদ্ধার্থ জানায়, ওয়ার্ক স্যাম্পলস্। অভিনেতার অভিনীত শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলির সংকলন। ক্রুদ্ধ হ্যারি বলে: ‘ইউ গেট স্যাম্পল অন আ ফ্যাবরিক শপ, নট অন স্টেজ। ইউ নেভার নো, হোয়েন ইওর বেস্ট মোমেন্ট উইল হ্যাপেন। ইউ হ্যাভ টু কিপ অন ট্রায়িং।’
সিদ্ধার্থ জানায়, সে তার ‘টেমপেস্ট’-এর ‘প্রসপেরো’ চরিত্রের অভিনয়ের অনেক প্রশংসা শুনেছে। ‘কোন প্রসপেরো? কলকাতায় অভিনীত? না মাদ্রাজে? না মুম্বাইয়ে? অ্যাক্ট টু? না অ্যাক্ট পাইভ?’— সিদ্ধার্থ নিরুত্তর। হ্যারি সিনেমায় অভিনয় করবে না, কারণ তার মতে, সিনেমা শেষ অব্দি কতগুলো 'ইনকমপ্লিট মোমেন্টস্'। কারণ সিনেমায়, ‘যখন তুমি অভিনেতার মুখটুকু দেখছ, তখন তুমি তার হাতগুলি দেখতে পাচ্ছ না। যখন তার মুখ ও বাহুদ্বয় দেখতে পাচ্ছ, তখনও তার সম্পূর্ণ শরীর তোমার সামনে অনুপস্থিত। যখন তার সম্পূর্ণ শরীর দেখতে পাচ্ছ, তখন তা এতদূর থেকে দেখছ যে অভিনেতার মুখের এক্সপ্রেশন তোমার কাছে অধরা।’
আরও পড়ুন:অনন্ত বিরহের বর্ষায় বৃষ্টি লুকোয় যে ‘রেইনকোট’
হ্যারির এই কথাগুলির ভিত্তিভূমি থিয়েটার। এরপর তার সামনে সিদ্ধার্থ এনে দাঁড় করায় চলচ্চিত্রের দর্শনকে। আর তখন, হ্যারি-সিদ্ধার্থ নয়, আমাদের মনে হয় মুখোমুখি কথা বলছে যেন স্বয়ং থিয়েটার আর সিনেমা। সিদ্ধার্থ উত্তর দেয়: ‘হোয়েন ইউ ওয়ান্ট টু সি ফেস, সি ফেস। হোয়াই হ্যান্ডস? দে জাস্ট ডিসট্র্যাক্টস্ ইউ।’ এর কোনও তুলনা হয়?
তবে বলবার বিষয় হল, এখানে হ্যারি ও সিদ্ধার্থর— দু'জনের যুক্তির কোনওটিকেই আমরা অস্বীকার করতে পারি কি? পারি না। কে ঠিক কে ভুল, সেদিকে না-গিয়ে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্ভবত দর্শককে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন অভিনয়-চিন্তার দু'টি পৃথক দিগন্তের সামনে।
কিন্তু আমরা ভুলে যেতে পারি না, এই দুই দিগন্তের কাছে পৌঁছতে আমাদের সাহায্য করল দড়িতে ঝোলানো ওই অব্যবহৃত কতগুলি বস্তুরূপী কলিং বেল-এর সাধারণ দৃশ্যটি। সাহায্য করল ‘ইমাজিনেশন’ শব্দটিও।
ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে প্রায়শই খুঁজে পাওয়া যায় একটি দৃশ্যের সঙ্গে সংযুক্ত অন্য দৃশ্যের সংকেত-রহস্য। তাই, সিনেমাকে ফিরে-ফিরে দেখলে তাঁর চিন্তার সমগ্রতাকে হয়তো আমরা কিছুটা বুঝতে পারব!