অস্ট্রেলিয়ার 'স্টোলেন জেনারেশন' ও আদিবাসী সমাজ

Stolen Generations of Australia: উপনিবেশ স্থাপনের পরে ব্রিটিশদের চোখে আদিবাসীদের জীবনযাপন পদ্ধতি অসহ্য ঠেকতে শুরু করে। আর সেখানেই শুরু হয় বিড়ম্বনা।

অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম তটরেখা ধরে শুধু উত্তর থেকে দক্ষিণে খুঁটিয়ে পর্যটনের সময়েই বুঝেছি ,পৃথিবীর অন্যতম স্বপ্নের দেশ যেন এটিই। সেদেশে পর্যটনরত পড়ুয়াদের আলাপচারিতায় বুঝতে অসুবিধা হয় না, অস্ট্রেলিয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গুণগত মানের আকর্ষণেই বহুদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটে আসেন তাঁরা। বিশ্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিতেও অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। সুচারু রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশাসনিক দক্ষতার গুণপণায় দেশটিতে বছরভর পর্যটকদের ভিড়। এদেশের জলবায়ুও বেশ সহনীয়। বছরে দু'মাসের অস্বস্তিকর গরমে শান্তি দেয় সুসজ্জিত বেলাভূমি। নবীন স্থাপত্যের অন্যতম সৃষ্টি, বিশ্ব বিখ্যাত সিডনি অপেরা হাউস রয়েছে। রয়েছে কুইন্সল্যান্ডের প্রবাল প্রাচীর,বিখ্যাত গ্রেট বেরিয়ার রীফ। তার বদলে আমরা এক্সমাউথ শহর থেকে 150 কিমি দূরে নিঙ্গালু রীফে গিয়েছিলাম। সুবিধার কথা, খুব গভীর সমুদ্রে যাওয়ার আগে তীর সন্নিকটে অনুরূপ প্রবাল প্রাচীর আছে সেখানে, প্রকৃতির এমন অনন্য শোভা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। আগে ভাবতাম দেশটি বুঝি ক্রিকেটেই খুব ভাল। এখন দেখি আরও খেলাধুলাতেও তাদের ঈর্ষণীয় সাফল্য আছে। অস্ট্রেলিয়া আজ আত্মনির্ভর, সবদিক থেকে এগিয়ে থাকা, আর্থিক সমৃদ্ধিতে ভরপুর একটি দেশ।

আজকের এই চূড়ান্ত উৎকর্ষতার মাপকাঠিতে অবশ্য দেশটির অতীত বিচার করতে গেলে চরম ভুল হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকেই দেশের আদিবাসীদের জোর করে নিজেদের জমি জায়গা থেকে উৎখাত, বিনা পারিশ্রমিকে খাটানো, এইসব নিপীড়ন তো ছিলই। তার উপরে ছিল আরও এক ধরনের অত্যাচার। সেই বৃত্তান্ত বিস্মিত করার মতোই। কলঙ্কিত সেই অধ্যায়ের বিচারে তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান সমাজকে আদৌ ‘সভ্য’ বলা যায় কিনা, সেটাও এক প্রশ্ন বটে! ১৯০৫ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় 'চাইল্ড রিমুভাল পলিসি' আইনের বলে প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে,স্থানীয় আদিবাসী মায়েদের কোল খালি করে বাড়িঘর,রাস্তাঘাট থেকে প্রায় সমস্ত সন্তানদের জোর করে তুলে আনা হত। ধারা-সেকসন 8, ওয়েষ্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান নেটিভ এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ্যাক্ট (১৯৩৬) আইন অনুসারে, এইসব নেটিভ শিশুদের বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজন থাকা সত্ত্বেও তাদের বয়স একুশ বছর না-হওয়া পর্যন্ত ওই সব শিশুদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হত আঞ্চলিক শ্বেতাঙ্গ কমিশনারদের হাতে।

আরও পড়ুন: জালিয়ানওয়ালাবাগ প্রথম নয়, ১৫০০ আদিবাসীকে গণহত্যার আতঙ্ক আজও তাড়া করে এই গ্রামকে

আসলে উপনিবেশ স্থাপনের পরে ব্রিটিশদের চোখে আদিবাসীদের জীবনযাপন পদ্ধতি অসহ্য ঠেকতে শুরু করে। আর সেখানেই শুরু হয় বিড়ম্বনা। সব দেশেরই শহরাঞ্চলে জীবনের মান বা তার উন্নয়নের যে পরিকাঠামো থাকে, শহর থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সেই সুবিধাগুলি থাকেনা। শহুরে মানুষ জীবনকে আরও ভালো, আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা লেগেই থাকে। উল্টোদিকে, সংঘবদ্ধ আদিবাসী সমাজ, বছরের পর বছর ধরে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, শিল্প, লোকাচার নিয়ে অনাড়ম্বর জীবনেই মেতে থাকে। তাতে না থাকে তাঁদের খেদ,না থাকে অভিযোগ।

হাজার হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে এসে পড়েছিল এই আদিবাসী সমাজ। তারপর এই স্বেচ্ছা নির্ধারিত জীবনযাপনেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। এবার হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা উপনিবেশ স্থাপনকারী ব্রিটিশদের একদিন মনে হল, অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় আদিবাসীদের উপস্থিতি যেন বড়ই বেমানান। ফলে পিছিয়ে পড়া কৃষ্ণাঙ্গদের এই শ্বেতাঙ্গরা আর কোনওমতেই মেনে নিতে পারছিল না যেন। আর তার পরেই আইন প্রয়োগ করে আদিবাসীদের অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার শ্বেতাঙ্গ জনসমাজের সাথে মিশিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে অস্ট্রেলিয়ান প্রশাসকেরা। শুরু হয় ‘পলিসি অব অ্যাসিমিলেশন’-এর আওতায় 'ছেলে (মেয়েও) পাকড়াও' অভিযান। এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ লাগিয়ে আদিবাসী শিশুদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রিজিন ভ্যানে তুলে শহরে নিয়ে আসা হত। এই শিশুদের মূলধারার সমাজের সাথে যুক্ত করতে প্রাথমিক ভাবে রাখা হত বিভিন্ন সরকারি আবাসে। ভাবনা ছিল, ছোট থেকে এই সব নেটিভ শিশুদের শ্বেতাঙ্গ সমাজের সঙ্গে বেড়ে উঠতে দিলে, তারা নতুন সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। বহু শিশুকে শ্বেতাঙ্গ দম্পতিরা দত্তকও নিতেন। শুধু তা-ই নয়, এমন দত্তক- উপঢৌকন ব্রিটেনেও পাঠানো হত। পরবর্তী কালে সমীক্ষায় জানা যায়, এইভাবে তুলে আনা সব শিশুদের পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থাটুকুও করা হয়নি, বরং আদিবাসী ওইসব শিশুদের বাড়ির কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। আদিবাসী শিশুদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারে জারি করা হত কঠোর নিষেধাজ্ঞা। পরিবার প্রদত্ত নামটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হত। হঠাৎ করে শহরে এসে পড়া এইসব আদিবাসী শিশুদের যে নতুন সমাজে মানিয়ে নিতে খুব একটা সুবিধা হত না, তা আলাদা করে বলে দিতে হয় না।

আদিবাসী সমাজে শিশুদের পবিত্রতার প্রতীক বলে মনে করা হয়। বাবা-মায়েরা চোখের সামনে তাদের আদরের সন্তানদের কয়েদীদের মত অবহেলা ও বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বড় হতে দেখত। সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদের ঠাঁই হত, সেখানকার কর্মচারীরাও ওদের সঙ্গে মোটেও ভালো ব্যবহার করত না। ভীষণ রকম মানসিক ও শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে প্রতিমুহূর্তে বেড়ে উঠতে হত প্রতিটি শিশুকে। জিন ও জাতিগত কৌলীন্য বজায় রাখতে বেছে বেছে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গেই উত্তর জীবনে এই শিশুদের বিবাহের ব্যবস্থা করা হত। আদিবাসী সমাজের তিন প্রজন্মের প্রায় সব শিশুকে ধরে নিয়ে এসে শ্বেতাঙ্গ সমাজের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার যে এই ব্যর্থ প্রচেষ্টা, তা চলেছে অনেক দিন। এই অভিশপ্ত এই প্রজন্মকে একত্রে বলা হয় ‘দ্য স্টোলেন জেনারেশন’। কুখ্যাত 'অ্যাসিমিলেশন’ প্রথা অব্যাহত ছিল ১৯০৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সামর্থ্য তখনকার আদিবাসী ওই জনগোষ্ঠীর ছিল না। ফিলিপ নয়েস পরিচালিত, 'ব়্যাবিট- প্রুফ ফেন্স' (২০০২) নামক একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রে এই অত্যাচারের ছবি তুলে ধরা হয়েছিল বিশদে।

যে কোনও জাতি বা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, নিজস্ব লোকাচার এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়, এটাই দস্তুর। কিন্তু সমাজচ্যুত স্টোলেন জেনারেশনের শিশুদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক জ্ঞানের সেই প্রবাহকেই আইন বলে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই নীতির জেরে যে আদিবাসী সমাজে এক ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে, তা নীতিনির্ধারকেরা ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেননি। অসংখ্য পরিবার তাঁদের সন্তান, বংশধরদের হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। সন্তান হারানোর হতাশা কাটাতে অনেকেই মাদকের আশ্রয় নেন। ক্রমে সন্তানহারা ওইসব আদিবাসী সমাজে কর্মক্ষম রোজগেরে মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ফলে তাদের সমাজে একধরনের অর্থনৈতিক স্থবিরতা নেমে আসে।

১৭৮৮ সালে সে দেশে উপনিবেশ পত্তনের সময়, জনসংখ্যার ৭৩% ছিল ব্রিটিশ। নগন্য অন্যান্য ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের কথা বাদ দিলে সিকিভাগ (২৫%) ছিল 'অ্যাবরেজিনস'। প্রথম ২০১৯ সালে যখন অস্ট্রেলিয়াতে যাই, ততদিনে সোয়ান নদী দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে। ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষ এসে পড়েছে সেখানে। দেশটির মোট জনসংখ্যা তখন আড়াই কোটি, ব্রিটিশ জনসংখ্যা ততদিনে কমে ৪০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। স্টোলেন জেনারেশনের নৃশংসতার শিকার হয়ে অ্যাবরেজিনদের সংখ্যা ক্ষয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.৩ শতাংশে।

আরও পড়ুন:মুম্বইয়ের জমকে ব্রাত্য আরে অরণ্য, আদিবাসীদের দিন বদলের স্বপ্ন দেখান ক্যাসান্দ্রা

বর্তমান অস্ট্রেলীয় প্রশাসন অবশ্য সেই লজ্জার কথা স্বীকার করে নেয়। এবং সেই কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে ১৯৮৮ সাল থেকে দেশজুড়ে প্রতি বছর ২৬ মে, 'ন্যাশনাল সরি ডে' পালন করা শুরু হয় অস্ট্রেলিয়ায়। বর্তমান অস্ট্রেলিয় সমাজে অনেক বদল এসেছে। জীবনের প্রতি স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির জন্যও অজিরা আজ বিশেষ ভাবে পরিচিত। প্রতিটি স্কুলের পাঠ্যক্রমে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এই বিশেষ দিনে স্কুলে আয়োজিত বিভিন্ন সভায় পড়ুয়াদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হয়। পড়ুয়াদের মনে এ ব্যাপারে সহমর্মিতাবোধ জাগিয়ে তুলতে বলাই বাহুল্য সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সফল।

'অ্যাবরেজিনদের অধিকার নিয়ে বহু শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ান পরে সোচ্চার হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্টোলেন জেনারেশন’-এর সকলের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। এছাড়া আদালতের নির্দেশে অতীতে যেসব আদিবাসী শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদান করতে বাধ্য করা হয়েছিল, জীবিত সেই প্রবীণদের ক্ষতিপূরণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।

More Articles