দেশ থেকে দেশে মিশে আছে বুদ্ধদেবের জীবন ও ভাবনার ছাপ
গত ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্থানের তালিবান বাহিনী বলেছিল- "দেশের প্রাচীন স্থাপত্য হল দেশের ইতিহাস, পরিচয় এবং ঐতিহ্য| একে রক্ষা করা, সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব"| কিন্তু আমেরিকান সেনাবাহিনী আফগানিস্থান ত্যাগ করার পর ৬ অগস্ট থেকে ১৫ অগস্ট- এর মধ্যে তালিবান বাহিনী পুনরায় আফগানিস্থানের দখল নিল| ক্রমে নতুন সরকার গঠন করল| তাদের মুখে আর প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহ্য প্রেমের কথা নেই| তাদের কোথায় কারও ভরসা নেই, বিশ্বাস নেই| সকলের মনে পড়ছে ২০০১ সালের মার্চ মাসের কথা| কয়েক সপ্তাহ ধরে একটু-একটু করে ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বামিয়ান প্রদেশের দেড় হাজার বছরের পুরনো পুরনো পাহাড়ের গায়ে খোদিত দুই বিশালাকার বুদ্ধমুর্তিও ধ্বংস করেছিল তালিবান |
বুদ্ধ হলেন শান্তি, প্রেম, অহিংসা ও সহনশীলতার করুণাঘন মূর্তি| সে মূর্তি পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত| তার ধ্বংস নেই, ক্ষয় নেই | ধর্মমতের বেড়াজাল অতিক্রম করে বুদ্ধদেব আজও ভারতীয় উপমহাদেশ ও এশিয়া মহাদেশের অগণিত মানুষের হৃদয়য়ের রাজা| সেই সন্ন্যাসী রাজার মহিমার নিদর্শন যেখানেই পাওয়া গিয়েছে, সেখানেই ছুটে গিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ|
শ্রী দীপঙ্কর আরোন, একজন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত, সেইরকমই একজন মানুষ | ২০০৯ সালে তিনি মানস সরোবরের তীর্থপথে তিব্বত গমন করেছিলেন| সেখানেই তিনি প্রথম বুদ্ধদেবের প্রতি শ্রদ্ধাভাবাপন্ন হন| ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের চাকরি সূত্রে তিনি যখন জাপানে কর্মরত ছিলেন, তখন সেখানেই উপকূলবর্ত্তী শহর কামাকুরাতে একটি ব্রোঞ্জ নির্মিত বুদ্ধমূর্তি ( নাম 'দৈবাৎসু' ) দর্শন করার সৌভাগ্য হয় তাঁর| তারপর ২০১২ সালে তিনি হংকং শহরে রাষ্ট্রদূতের চাকরীতে নিযুক্ত হন | হংকং বিমানবন্দরের নিকটেই একটি ৩৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ঠ তিয়ান-তান বুদ্ধমূ্র্তি দেখে অভিভূত হন | তার মানে এই ধারণা বলবৎ হয় যে, চিন ও জাপান দেশের প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই এই বিশালাকার বুদ্ধমূর্ত্তি গঠন সম্ভব হয়েছে | সেই থেকে, যে সমস্ত দেশে ও স্থানে এইপ্রকার বুদ্ধমূর্তির নিদর্শন রয়েছে, সেই সব স্থানে গিয়ে নিবিড় অনুসন্ধান করার সঙ্কল্প দীপঙ্করের মনে জাগরুক হয় |
তবে শুধুমাত্র বুদ্ধমূর্তি দর্শনের আকর্ষণ তিনি দেশে দেশে ভ্রমণ করেননি| তাইওয়ানের বন্দরনগর কাওসিয়াং- এ ফো-গুয়াং-স্যান নামের এক মন্দির চত্বরে একটি মিউজিয়াম আছে| সেই মিউজিয়ামে অসংখ্য চিত্রমালার মাধ্যমে বুদ্ধদেবের জীবনকাহিনী ও ধর্ম-দর্শনকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে| সেই চিত্রমালা দর্শন করেও দীপঙ্কর অভিভূত হন | সেখানে তিনি জিয়ান নামের এক চিনের শহরের ছবি দেখে আকৃষ্ট হন| পরবর্তীকালে তিনি ওই শহর ঘুরে বেড়ান ও স্বচক্ষে দেখে আসেন বুদ্ধদেবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মারক বস্তু| বুদ্ধদেবের মহিমার নিদর্শন দেখবার আগ্রহে দীপঙ্কর পূর্ব এশিয়ার 'সিল্ক রোড' অবলম্বন করে পশ্চিমে কাশগড় থেকে আরম্ভ করে পূর্বে কোয়াশান পর্যন্ত এবং উত্তরে উলানবাটোর থেকে শুরু করে দক্ষিণে কাওশিয়াং পর্য্যন্ত প্রায় ১০০টি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানে ভ্রমণ করেন|
এই সুদীর্ঘ যাত্রা ও গবেষণাধর্মী অনুসন্ধানের ফলশ্রুতি তাঁর লিখিত একই বই – ‘On the Trail of Buddha: A Journey to the East’. তাঁর লিখিত বইটির উপজীব্য বিষয় হল ওই সকল স্থানে বুদ্ধদেবের জীবন ও দর্শনের কতখানি প্রভাব আজও সজীব হয়ে আছে |
সেইসব প্রভাবের বিবরণ যা বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে, তা সত্যিই আকর্ষণীয় ও উদ্দীপনাপূর্ণ | দীপঙ্কর চিন দেশে গিয়ে দুজন ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতের স্মৃতিসৌধ দেখেন| সেই পণ্ডিত দুজন ছিলেন ধর্মরত্ন ও কাশ্যপ মাতঙ্গ, যাঁরা চিনদেশের সম্রাটের রাজসভায় ৬৭ সালে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন| সম্রাট, তাঁদের বসবাসের জন্য 'বাইমা শি' অর্থাৎ স্বেতাশ মন্দির নামক একটি গৃহ নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন| সেই গৃহে অবস্থানকালেই দুই পণ্ডিত সংস্কৃত ভাষায় রচিত অনেক সূত্র চিনাভাষায় অনুবাদ করে দিয়েছিলেন| সেখানেই তাঁরা পরলোকগমন করেন| তাঁদের স্মৃতি সৌধ আজও সযত্ন-লালিত ও সুরক্ষিত অবস্থায় বিরাজ করছে |
চিন দেশের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের আরও কিছু নিদর্শন পান দীপঙ্কর| প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতের নাম শাওলিন মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত| 'কুংফু'-র এক বিশ্ববিখ্যাত কেন্দ্রে সেখানে রয়েছে| আবার সেই মার্শাল আর্টের উৎস নিহিত রয়েছে কেরালার 'কালারিপায়াট্টু'-র কৌশলের মধ্যে|
তবে দীপঙ্কর সর্বাপেক্ষা বিস্মিত হয়েছেন জাপানের টোকিওর উত্তরভাগে নিকো শহরে তোশগু নামক এক মন্দিরের ভেতর খোদিত কিছু মূর্তি দেখে | তিনটি বাঁদর- যারা কান ঢেকে রাখে যাতে কোনও মন্দ কথা শুনতে না হয়, যারা চোখ ঢেকে রাখে যাতে কোনও মন্দ দৃশ্য দেখতে না হয়, যারা মুখ চেপে থাকে যাতে কোনও মন্দ বাক্য উচ্চারণ করতে না হয়, তারাই হল সমাজজীবনে সদাচরণের শিক্ষক | এই শিক্ষা মূলতঃ বৌদ্ধধর্মের ভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত | ফুজিশান নামক এক জাপানি পণ্ডিত ১৯৪০ সালে ভারতে এসেছিলেন এবং গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষার প্রতীক-স্বরূপ ঐ বাঁদরগুলির উল্লেখ করেছিলেন| তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে মহাত্মা গান্ধীও তার সমাজশিক্ষা মূলক প্রচারকার্যে ওই প্রতীকগুলির ব্যবহার করতেন |