প্রিয় বন্ধু, প্রিয় শত্রু: চুঘতাইয়ের মান্টো
Manto and Chughtai Friendship: ১৯৪৬ সালে ইম্পিরিয়াল ক্রাউন চুঘতাই আর মান্টোর বিরুদ্ধে মামলা করে। অশালীনতার অভিযোগে।
সালটা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ। অশ্লীলতার দায়ে দায়ের হওয়া মামলায় লাহোরে কোর্টে হাজিরা দিতে হয় মধ্য তিরিশ আর সদ্য তিরিশের দুই লেখককে। একজন পুরুষ ও একজন নারী। নারীটির জবানিতে, এই কোর্টে হাজিরা দেওয়ার দিনগুলি ছিল উৎকণ্ঠাময়। কিন্তু নভেম্বরের লাহোর, শেষ দুপুরের আলো আর দুই অভিযুক্তের অনর্গল আড্ডা সব উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে পিকনিকের এক আমেজ আনতো। সদ্য তিরিশের সেই যুবতীর একটা সময়ের পর কোর্টে যেতে আর ততটাও খারাপ লাগতো না। সহ-অভিযুক্ত মধ্য তিরিশের লেখকটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠবেন বহতা সময়ের হাত ধরে এবং বন্ধুত্বের রঙ এতটাই গাঢ় হবে যে নারীটি সেই পুরুষটিকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু বলতেও দ্বিধা করবেন না। সদ্য তিরিশে পা দেওয়া যুবতীটি ইসমত চুঘতাই। মধ্য তিরিশের যুবকটি সদত হাসান মান্টো।
বন্ধুত্ব সবসময় একে অপরকে ভালোবাসা, পাশে থাকা বা আগলে রাখার নিয়ম মেনে চলে না। কিছু বন্ধুত্ব হয় 'বিশেষ'রকম যাতে মধু যতখানি, বিষও কিছু কম নয়। সমসাময়িক দুই লেখকের মধ্যে বন্ধুত্বের সমীকরণ খুব জটিল অংক, অথচ খুব মজার একটা বিষয়। তারা একে অপরকে পছন্দ করেন, অপছন্দ করেন, ঈর্ষা করেন, তারিফ করেন এবং সময়বিশেষে একে অপরের লেখার ব্যাপারে মৌনতাও অবলম্বন করেন। কেউ কেউ আবার এই সব হিসেবের ছকে পড়েন না। চুঘতাই আর মান্টোর কথাই যদি বলি, এক সাক্ষাৎকারে চুঘতাইকে মান্টোর বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছেন,
“টেকনিক্যালি মান্টো সুন্দর গল্প লেখে। ভীষণ সাহসী কিন্তু লোকজন ওকে লম্পট ভাবতো। ও কিন্তু খুব মিষ্টি, ঘরোয়া। ওর লেখায় চেপে রাখা ইচ্ছেগুলোর কথা বলে ফেলত। যা ও হতে চাইত, ওর গল্পের চরিত্রেরা আসলে তা-ই। যৌনতা নিয়ে যখন লিখেছে ,কখনও সেটাকে খুব আকর্ষণীয় করে দেখিয়েছে, কখনও বা বিরক্তিকর। ওর চরিত্রেরা কোনও আনন্দ বা উত্তেজনা দেবে না আপনাকে, শুধু ঝাঁকিয়ে দেবে। সব রোম্যান্স মাঠে মারা যাবে। ওর লেখায় আদতেই কোনও রোমান্স নেই।"
আরও পড়ুন- বান্ধবীর মেয়েকে দত্তক! বাজপেয়ী আর ‘মিসেস কৌলে’র বন্ধুত্বের যে রসায়ন রইল অজানাই
মান্টোর 'ঠান্ডি গোস্ত' নিয়ে প্রশ্ন করায় চুঘতাই বলেছেন, "ভয়ংকর লেখা! টেকনিক্যালি ফাইন। কিন্তু ও তো খুব বুদ্ধিমান, খুব চালাকি করে লিখেছে। আমার মনে হয় গল্পটা ভালো। আপনি আগুনটা টের পাবেন, টের পাবেন গন্ধও…।" সবাই জানে মান্টোর এই গল্প নিয়ে অনেক ভোগান্তি হয়েছে। অশালীনতার অভিযোগ উঠেছে। কারও মনে হয়েছে অশালীনতা শব্দ ব্যবহারে নেই, কর্তার সিং বা ওই মৃত মেয়েটির মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাকেও অশালীন বলা যায় না। অশালীন হলো সেই নির্দিষ্ট সময় খণ্ড। পিপল অফ ইন্ডিয়া ওয়াজ রেপিং ইন্ডিয়া। চুঘতাই এই গল্প নিয়ে কী বলছেন, সেটাই আমাকে অবাক করে দিয়েছে! তিনি বলছেন, “মান্টো এই গল্পে রেপ নিয়ে লিখেছে, যখন কেউ রেপ করে তখন কী হয় তাই নিয়ে লিখেছে। সিম্বলিক কিছুই নেই এতে। আমার মনে হয় মান্টো একজন নরম মানুষ, অশ্লীল বা ভাল্গার কখনও নয়। সুন্দর দেখতে, সরল, সন্তের মতো একজন। আমি যখনই ওকে বলতাম একথা, ও খুব দুঃখ পেত, বলত, “আমি সন্ত না; আমি খুব খারাপ লোক।" বুঝতে পারি না, চুঘতাই সবটাই মজা করেছেন কিনা! তবে পরবর্তীকালে লিখেছেন, “মান্টো, আমার বন্ধু, আমার শত্রু।" চাবুকের মতো আছড়ে পড়েছে সেই লেখা। মান্টোর মৃত্যুর পর পাকিস্তানে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন নিয়ে আদিখ্যেতার উত্তর ছিল চুঘতাইয়ের এই লেখা। মান্টো মেরা দোস্ত মেরা দুশমন।
১৯৪৬ সালে ইম্পিরিয়াল ক্রাউন চুঘতাই আর মান্টোর বিরুদ্ধে মামলা করে। অশালীনতার অভিযোগে। মান্টোকে হেনস্থা করা তখন ভদ্রলোকেদের পবিত্র কর্তব্যের মতো ছিল। প্রতিদিন একরাশ হুমকির চিঠি পেতেন মান্টো। চুঘতাইয়ের ঠিকানা কয়েকজন সম্পাদক ছাড়া কেউ জানত না। দু-চার লাইন পড়েই তিনি সেই সব চিঠি ফেলে দিতেন ডাস্টবিনে। কিন্তু মান্টো চিঠিগুলো শুধু পড়তেন তাই নয়, বন্ধুদের জোরে জোরে পড়ে শোনাতেন। মানসিক শান্তি ফর্দাফাঁই হয়ে যেত তাতে। একদিন স্রেফ ইয়ার্কি করে চুঘতাই মান্টোকে বলেছিলেন, “মান্টো, তুমি মরলে, লোকে তোমার পূজা করবে, মহান বলবে। চিরদিনের জন্য তোমার নামের সঙ্গে মহান শব্দটা লেপ্টে থাকবে। তোমাকে এক্সপার্ট সাইকোলজিস্ট, ন্যাশনাল রিফর্মার বলা হবে।" খুব রেগে গেছিলেন মান্টো। চোখ গরম করে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে একশা করেছিলেন, “এটা যদি হয়,তাহলে কবর থেকে উঠে এসে তাড়া করব আমি!”
কেউ কি দেখেছে মান্টোর কবর? কাছ থেকে? তাতে ফাটল দেখতে পেয়েছে? চুঘতাই প্রশ্ন করেছেন। "মার্বেলে মোড়া কবর থেকে মান্টো কখনও উঠে আসতে পারেনি। কেউই পারে না। রাস্তার মোড়ে মূর্তি গড়া হয়, তাতে কাক-পায়রার পূরীষের আস্তর পড়ে। কিন্তু যখন বেঁচে ছিল মান্টো, যখন খবরের কাগজগুলো ওর ওপর নোংরা আবর্জনা ঢালছিল, যখন পাগলাগারদে ভূত দেখত একা একা, তখন কোথায় ছিল এখন গজিয়ে ওঠা শুভানুধ্যায়ী? হয়তো তারা শিশু ছিল তখন কিন্তু পরিণত বয়স্ক কেউ কি ছিল না? এখন যারা উৎসব করতে আগ্রহী, মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে উদ্গ্রীব কোথায় ছিল তারা তখন? কেউ বলতে পারবে, কী ঘটেছিল মান্টোর সঙ্গে? কেন ঘটেছিল? হাজার বছর বুক চাপড়ালেও কি আলি আসগরের গলায় আর-পার হয়ে যাওয়া তির উপড়ে ফেলা যায়? পৃথিবীতে কি কোনও আদালত আছে যা মান্টোর ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী কারা, তাদের খুঁজে বের করবে? মান্টো একলা জঙ্গলে বাস করত। কেউ সাহায্য করেনি ওকে। কোনও মানুষ পারে না ওইরকম একলা থাকতে। ওর চারপাশে দু-পেয়ে মানুষ ছিল না? অন্ধ-বোবা-কালা হয়ে কী করে ঘুমাতে পারে সকলে রাতে? পাথরের মতো? একলা মানুষটার মরে যাওয়ার দায় শুধু মৃত্যুর ওপর চাপানো যায়? আর মরার শুরু হয় পূজা।"
আরও পড়ুন- ক্যাপিটল হিলে হইচই, আমেরিকা লুকিয়ে রেখেছে ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’কে?
চুঘতাই বলেছেন, "মান্টো সবচেয়ে বেশি ঘেন্না করত ভণ্ডামি আর কৃত্রিমতাকে। তাই ওর বিষয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে ভয় করে। ওর সঙ্গে দেখা হলে হয়তো ঝগড়া করব। ও অনেক বড় গল্পকার ছিল! আমি খুব একটা মানি না এ কথা, কত বড় শিল্পী ছিল ও, তাও জানি না কিন্তু মানুষ তো ছিল। কারও বাবা, কারও স্বামী ছিল। এই পৃথবীতে কি শুধুমাত্র মানুষ হওয়াই যথেষ্ট নয় বেঁচে থাকার জন্য? যদি মান্টো আরও কুড়ি বছরও বেঁচে থাকত, তাহলেও জেলের ভেতরেই মাথা ঠুকত। তারপরেও লোকজন ওকে নিয়ে আদিখ্যেতা, উৎসব করত।" এক পরম মমতাময় বন্ধুর মতো পরামর্শ দিয়েছেন চুঘতাই। "ভালো করে লক্ষ্য করবেন, আপনাদের ভেতর কোনও মান্টো আছে কিনা।কেউ আছে আপনাদের মধ্যে যে খুব বাজে বকে, যে ভয়ংকর সংবেদনশীল, যে ছোট-বড় ভুল করে, যে এমন সব কথা বলে যা মানতে লোকের অস্বস্তি হয়? কেউ আছে আপনাদের মধ্যে যে ভাবে, তাকে কেউ বোঝে না, যে একবগগা, যে চোরকাঁটার মতো জামায় আটকে থাকে যতক্ষণ না অসহ্য হয়ে ওঠে? কেউ আছে এমন যে ভাবে, কেউ মানতে চাইছে না কিন্তু সে একজন মহান লেখক, যাকে সবাই এড়িয়ে যেতে চায় কারণ সে সন্ত ও শয়তানের মতো একলা? এরকম কেউ থাকলে, সেই ঠগের থেকে সাবধান, কারণ একদিন তো সে মরবে, সেদিন হয়তো মাথা নোয়াতে হবে তার কাছে। হয়তো আর্টিকল লিখতে হবে তাঁকে নিয়ে, তাঁর সম্মানে মিটিং মিছিল করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু এগুলো কিছুই মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হতে পারে না, আর আলি আসগরের গলায় বেঁধা তির আপনাদের বিবেকে বিরক্তিকর অস্বস্তির মতো বিঁধে থাকবে।"
ইসমত চুঘতাইয়ের বক্তব্যে তাঁর প্রিয় লেখক বন্ধুর প্রতি যে আবেগ ধরা পড়েছে তা বড় সাচ্চা। খুনসুটির সম্পর্কটিও বুঝি। কিন্তু ‘ঠান্ডি গোস্ত' নিয়ে তাঁর মন্তব্য আমাকে অবাক করেছে। অবশ্য বন্ধুত্ব এমন অনেক বিস্ময় জমিয়ে রাখে। যেমন চুঘতাই গলা খুলে বলেননি যে, গল্পকার মান্টো অসীম প্রতিস্পর্ধার নাম। দিনের শেষে মানুষ আর আর্টিস্ট দুটো আলাদা সত্ত্বাই কি? নইলে তিনি এক সাক্ষাৎকারে কেনই বা বলবেন যে, উর্দু সাহিত্যের সেবার চাইতেও বেশি জরুরি আমার কাছে আমার সংসার,পরিবার। অথচ মান্টোর কাছে ঠিক এর উলটো। বন্ধুত্বই পারে এমন উলটো প্রকৃতির মানুষদের কাছাকাছি আনতে। বন্ধুত্বই পারে মৃত্যুর এতদিন পরেও দুইজনকে এত কিসসা বাঁচিয়ে রাখতে!