প্রতিশোধের উত্তাপে সমতার ভূমি খুঁজে চলে ঋতুপর্ণের ‘চোখের বালি’

Rituparna Ghosh: ঠিক-ভুলের সমীকরণের বাইরে দাঁড়িয়ে এমনই সব বিচিত্র, গভীর চরিত্রদশাকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর সিনেমায় বারংবার উন্মোচিত করতে চেয়েছিলেন।

আমরা প্রায় প্রত্যকেই জীবনে এক সমান্তরাল রেখার কথা ভাবি! যে রেখায়, সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে প্রাপ্তির সমান অধিকার থাকবে। এই ‘প্রাপ্তি’ কথাটি বলামাত্র একটি শুভবোধ যেন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। যা কিছু মহৎ, ‘প্রাপ্তি’ যেন ঠিক তারই স্বরূপশব্দ!

কিন্তু জীবনের ভেতর এমন এমন না-পাওয়া বসবাস করে, যাকে আজীবন নিঃশব্দে বহন করে চলতে হয়। কোনও একক ব্যক্তির কাছ থেকে ছুটে-আসা ওই ‘না-পাওয়া’-ও কিন্তু এক ধরনের পাওয়া-ই। অর্থাৎ অপ্রাপ্তি-ও, প্রাপ্তিরই একটি নঞর্থক পরিচয়।

তাই, এ-প্রাপ্তির রেখাপথগুলি সরল নয়। কারণ, সেখানে প্রায়শই কোনও সমান অধিকার নেই। যন্ত্রণা, একার। সেই একাকী ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমার জানতে ইচ্ছে করে কাকে বলে ‘প্রতিশোধ’? আমি যে কষ্ট পাচ্ছি— সেই একই পরিমাণ কষ্ট, আমার কষ্টের কারণের সঙ্গে সংযুক্ত মানুষটিও পাক, এ তো সমতার ইচ্ছে। ‘প্রতিশোধ’-এর মধ্যে এমন এক সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ রয়েছে যা ‘হিংসা’ বা ‘দ্বেষ’-কে প্রধান্য দেয়। আমি সেই দ্বেষ বা হিংসার কথা বলছি না। আক্রমণের উল্লাস নয়, তোমার কারণে যতটুকু আমার যন্ত্রণা, ঠিক ততটুকুই তুমি একটিবার ভোগ করে দ্যাখো— এই চাওয়ার মধ্যে সমতার স্বাধীনতা আছে। শুধু তাই নয়, এরই সঙ্গে রয়েছে আমাদের জীবনের অলক্ষ্যে দণ্ডায়মান অদেখা বিধাতার কাছে বিচার না চেয়ে, নিজেই নিজের বিধাতা হয়ে-ওঠার ইচ্ছেও।

আরও পড়ুন: প্রাইড মান্থ, প্রান্তিক অস্তিত্ব ও ঋতুপর্ণ ঘোষ

ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে এরকমই কয়েকটি প্রতিশোধ-দৃশ্যের কথা আজ বলব। ‘চোখের বালি’-তে তখন বিনোদিনী ও আশালতা ‘সই’ পাতিয়েছে। তারা একে-অপরকে ‘বালি’ নামে ডাকে। আমরা জানি, বিনোদিনী বিধবা। শিক্ষা, রুচি এবং যৌবনের সহজাত পিপাসা— সব ক্ষেত্রেই সমর্থ সে। অন্যদিকে আশালতা, নিতান্ত সরল গৃহবধূ। যে-সংসার, স্বামীসুখ— বিনোদিনীর মন ও শরীর প্রত্যশা করে, তা সবই আশালতার কাছে সহজলভ্য। ‘চোখের বালি’-র একটি দৃশ্যে দেখা যায়, মহেন্দ্র চায় আশালতা শাড়ির সঙ্গে খালি-গা না-থেকে, ব্লাউজ পরুক। কিন্তু নতুন কিনে-আনা সেই ব্লাউজ পরিধানের পদ্ধতি আশালতার জানা নেই। বিনোদিনী সাহায্য করছে তাকে। ছবিতে, আশালতা ও বিনোদিনীর সংলাপ-অংশটি এখানে তুলে দিচ্ছি:

আশালতা।। তুই পরিয়ে দিলেই হবে খালি? আমায় শিকে নিতে হবে না? এই ধোক্কর জ্যাকেট পরে ঘুমোব নাকি রাত্তিরে?
বিনোদিনী।। ঘুমোবার আগে তোমার বরই খুলে দেবেন বালি। সে-নিয়ে ভাবনা নেই।
আশালতা।। তুই ভীষণ অসভ্য হয়েছিস বালি! হ্যাঁ রে, তুই আমার পুতুলের জন্য এরকম ছোট-ছোট জামা করে দিবি? ওদের পরাতে-পরাতে আমি শিকে যাব।
বিনোদিনী।। সোজা জিনিস। ভালো করে একবার দেখলেই শিখে যাবি। নে খোল (ব্লাউজ), আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। [ব্লাউজ খোলার পর, আশালতার বুকের দিকে তাকিয়ে] এ কী করেছিস! কেটে-ছিঁড়ে একেবারে একসা করেছিস!
আশালতা।। সে আর বলিস না ভাই! অত দস্যিপনা করলে আমি পারি? ওর গায়ের জোর আমার থেকে বেশি না, বল?
বিনোদিনী।। বারণ করতে গায়ের জোর লাগে না বালি। মনের জোর লাগে।
আশালতা।। আমি অনেক বলেছিলুম। উনি বললেন, ঠাকুর-দেবতারা নাকি এরকম করেন!
বিনোদিনী।। আমার বলার ছিল, বলেছিলুম। একদিন কেটে-ছিঁড়ে পেকে ঘা হয়ে যাবে, তখন তোমার ডাক্তার বর-ও কিচ্ছু করতে পারবে না।
আশালতা।। ও ভাই যাস নে, লক্ষ্মী ভাই আমার! আর করব না! কী করে পরতে হয় দেখিয়ে দিয়ে যা একবার।
বিনোদিনী।। আর করবি না? ঠিক?
আশালতা।। তোর দিব্যি!
বিনোদিনী।। এই যে আজ তোদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হবে, আজ রাতে উনি যদি জোর করেন?
আশালতা।। জোর করলে বলব, বালি বারণ করেছে।
বিনোদিনী।। কী!!!
আশালতা।। ও! ও! ও! তা বলব না? তাহলে অন্য কথা বলব! কী বলব বলে দে না ভাই বালি?

লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, এই সংলাপের ভেতর যে-আশালতাকে আমরা দেখতে পাই, সে নিতান্তই এক কিশোরী! সে স্বামীর প্রতি নিবেদিত এবং বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্তপ্রাণ। কিন্তু বিনোদিনী? আশালতার শরীরে তার স্বামীর দেওয়া শৃঙ্গারচিহ্ন দেখে বিনোদিনীর আচমকা ক্রোধ ও বিরক্তিকে ছবির এই দৃশ্যটিতে বিশেষ তাৎপর্যময় করে তুলেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। যে-স্বামীসুখ বিনোদিনীর ভাগ্যে নেই তা আশালতারও থাকবে না, এই চাওয়া অন্যায্য হলেও, বিনোদিনীর জীবনে তা সত্যমূল অবস্থা। ব্যাধির যুক্তি দিয়ে বিনোদিনী আশালতাকে বলছে রাত্রে মিলনোন্মুখ মহেন্দ্রকে বাধা দিতে। ছবির কয়েকটি দৃশ্য পরে, আবার এই বিনোদিনীর শরীরেই আশালতা আবিষ্কার করবে মহেন্দ্ররই কাছ থেকে পাওয়া একই রকম মিলনের ক্ষতদাগ! বিনোদিনী যা আলতো-যত্নে মুহূর্তেই ঢেকে নেবে।

এরপর ছবিতে ছোট-ছোট কয়েকটি দৃশ্যের ঘটনাস্রোত এমন— আশালতাকে আলতা পরানো হচ্ছে। আর বিনোদিনী সেই আলতা-রঙের দিকে তাকিয়ে আছে। মহেন্দ্র-আশালতা একাগ্র ঘনিষ্ঠ যখন, পর মুহূর্তেই ঋতুপর্ণ দেখাতে ভুলছেন না মহেন্দ্র-আশালতার সেই একান্ত মিলনের অন্য পিঠে ঘটতে-থাকা শয্যায় বিধবা বিনোদিনীর আত্মরতি!

দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন। দশমীর সিঁদুর খেলা সেরে এসেছে আশালতা। সাবান দিয়ে মুখ ধুচ্ছে। জলের ঘটি হাতে পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিনোদিনী। সাবানে যখন চোখ জ্বলছে আশালতার, জলের ঘটিটি সামান্য পিছিয়ে নেয় বিনোদিনী। আশালতা বলছে, ‘বালি…, বালি… ঘটিটা কই বালি? বালি… বালি…’। বিনোদিনী ঘটিটি কিন্তু এগিয়ে দেয় না।

কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য। বিনোদিনী ওই কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দেখছে সিঁদুরের ভেতর আশালতার ছটফটানি, পীড়া। এই হল সেই প্রতিশোধ। যেখানে, শুধু সম-পরিমাণ যন্ত্রণার স্বাদ দেওয়াই নয়, আমি যে যন্ত্রণার মধ্যে পুড়ছি, তার সামান্য হলেও যদি বুঝতে পারে সেই একক ব্যক্তি, তাহলেই হয়তো তার সঙ্গে বন্ধুত্ব, ‘সই পাতানো’ সর্ব-অর্থে সমান পাটাতনে দাঁড়ায়।

এরপর, বাড়ির অন্দরমহল থেকে বিনোদিনীর প্রতি একজন মহিলার ডাক আমরা শুনতে পাই, ‘নতুন বউ-মা গিন্নি-মা আপনাকে ডাকছেন, একাদশী পড়ে গেছে।’ ‘একাদশী’ শব্দটি কানে আসামাত্র বিনোদিনী আশালতাকে জলের ঘটিটি দিয়ে দেয়। কারণ ‘একাদশী’ শব্দটি তাকে মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় যন্ত্রণার সমান অধিকার নয়, বৈধব্যই তার ভবিতব্য! এখানেই, ঋতুপর্ণ ঘোষের চরিত্রের মন বিশ্লেষণ-ক্ষমতাকে আশ্চর্য মনে হয়।

‘চোখের বালি’-র আরও একটি দৃশ্যের কথা বলতে চাইব। কালীঘাটে মৃত স্বামীর জন্য পুজো দিতে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে, ঘোড়ার গাড়িতে পুজোর সিঁদুর ভুল করে আদর-অবস্থায় বিনোদিনীর কপালে লেগে যায়। ছবিতে মহেন্দ্র-বিনোদিনীর সংলাপ-মুহূর্তটি এমন:

মহেন্দ্র।। এই যা, সিঁদুরটা লেগে গেল। মুছে ফেলো।
[বিনোদিনী নিজের সিঁদুরমুখ এগিয়ে এনে মহেন্দ্র-র জামায় মুছে দেয়।]
মহেন্দ্র।। এ কী?
বিনোদিনী।। মুছে ফেললাম!
মহেন্দ্র।। ইশ, কী যে করো না বিনোদ! এই নিয়ে এখন বাড়ি ফিরব কী করে?
বিনোদিনী।। সঙ্গ করবে, চিহ্ন রাখবে না, তাই কি হয় বলো? এই দ্যাখো না, কবে কার সঙ্গ করেছিলাম, মরে ভূত হয়ে গেছে, এত বছর ধরেও সেই চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি।

ছবিতে, লাল আলতা লাল ব্লাউজ, সিঁদুর, বিধবার ঋতুরক্ত— নানাভাবে লাল বর্ণকে ফিরিয়ে-ফিরিয়ে এনেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ‘চোখের বালি’ মুক্তি পাওয়ার অব্যবহিত পরেই সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে একটি সাক্ষাৎকার দেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সেখানে তিনি ‘চোখের বালি’-তে রঙের ব্যবহার সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। তাঁর কথায় এই চিন্তার পরিষ্কার সমর্থন মেলে। ঋতুপর্ণ বলেন, ‘লাল রংটাকে আমি আলাদা করে বের করতে চেয়েছি।’ ছবিতে এত-এত লাল রঙের তীব্রতার পাশে অবস্থিত থান আর তুলসির মালা-পরা বিনোদিনীর জীবনে সে-রঙের কোনও অধিকার নেই। সেই রক্তরং, সিঁদুর, মহেন্দ্র মিলন-অবস্থায় অজান্তেই বিনোদিনীর শরীরে লাগিয়ে দিচ্ছে। মিলনে সমাজবোধ থাকে না। কিন্তু মিলন শেষে? যে-ই সমাজের নিগড় মনে ফিরে আসছে, মহেন্দ্র বিনোদিনীকে বলছে, ‘এই যা, সিঁদুরটা লেগে গেল। মুছে ফেলো।’ অর্থাৎ আমি সামাজিকভাবে এই সিঁদুর-স্বীকৃতি তোমাকে দেব না।

আরও পড়ুন:উনিশে এপ্রিল বললেই বাঙালির এখনও মনে পড়ে ঋতুপর্ণর কথা

খেয়াল করার মতো বিষয়, এখানেও বিনোদিনী শুধু চাইছে সমতা। ওই একই সিঁদুর সে মহেন্দ্র-র জামাতেও লাগিয়ে দিচ্ছে। এরপরেই ঋতুপর্ণ প্রয়োগ করছেন এক অনবদ্য সংলাপ, ‘সঙ্গ করবে, চিহ্ন রাখবে না, তাই কি হয় বলো?’ অর্থাৎ চিহ্ন দু'জনকেই রাখতে হবে। সঙ্গ করার ফলাফলও ভোগ করতে হবে দু'জনকেই। বদ্ধ ঘোড়ার গাড়ির ভিতর জানলা দিয়ে এসে-পড়া এক ফালি রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে বিনোদিনী বলে, ‘এই দ্যাখো না, কবে কার সঙ্গ করেছিলাম, মরে ভূত হয়ে গেছে, এত বছর ধরেও সেই চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি।’ ঋতুপর্ণ একবারও বিনোদিনীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন না, সেই চিহ্ন আসলে বৈধব্য-বস্ত্র! কিন্তু কত সহজেই আমরা তা বুঝে যাই!

প্রতিশোধ, প্রতিশোধের জন্ম দেয়— লিখিত এ-প্রাচীন চিন্তা আমরা সবাই জানি। নিজের অধিকারের জমিটুকু বুঝে নেওয়া, এমনকী নিজের যন্ত্রণার ভিতর কোনও একক ব্যক্তিকে ডেকে এনে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাপ্ত যন্ত্রণার বিস্তৃতিটুকু তাকেই বোঝানোর চেষ্টা, একই জ্বালার মধ্যে দিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপন— এই সমস্ত কিছুও কিন্তু ‘প্রতিশোধ’ শব্দটির উদগ্র আর্তির মধ্যে বসবাস করছে।

ঠিক-ভুলের সমীকরণের বাইরে দাঁড়িয়ে এমনই সব বিচিত্র, গভীর চরিত্রদশাকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর সিনেমায় বারংবার উন্মোচিত করতে চেয়েছিলেন। উন্মোচনের সেই সংকেতগুলি আসলে একই মনের ভেতর লুকিয়ে-থাকা শত-সহস্র মনের হদিশসূত্র!

More Articles