রনিল, রাজাপক্ষেকে পিছনে ফেলে প্রেসিডেন্ট পদে, শ্রীলঙ্কাকে দিশা দেখাতে পারবেন বামপন্থী দিশানায়েকে?

Sri Lanka President Election: ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দিশানায়কের নেতৃত্বাধীন বামজোট পেয়েছিল মাত্র ৩% ভোট। পাঁচ বছরের মধ্যেই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্টের কুর্সি পেল এই বামজোট।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বামজোটের নেতা অনুরা কুমার দিশানায়েকে। শ্রীলঙ্কায় ভোটার সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ। এই নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন প্রায় ৭৫% মানুষ। এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট ৩৮ জন প্রার্থী ছিলেন। শ্রীলঙ্কার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো রাজাপক্ষের পরিবারও ক্ষমতা ফিরে পেতে জোরদার লড়াই করেছিল। কিন্তু লাভ হল না। এমনকী অভ্যুত্থানের পর পার্লামেন্টের সদস্যদের ভোটাভুটিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হওয়া রনিল বিক্রমসিঙ্ঘও জয়ী হতে পারলেন না । ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দিশানায়কের নেতৃত্বাধীন বামজোট পেয়েছিল মাত্র ৩% ভোট। পাঁচ বছরের মধ্যেই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্টের কুর্সি পেল এই বামজোট। কীভাবে এই অসাধ্যসাধন করল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ারের নেতা অনুরা কুমার দিশানায়েকে?

প্রথম গণনায় দিশানায়েকে পেয়েছিলেন ৪৯% ভোট। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিধি অনুযায়ী, তিনি ৫০% ভোট না পাওয়ায় পুনরায় ভোটগণনা হয়। সেখানেও দেখা যায়, বাকি দলগুলিকে পেছনে ফেলে ৪৩% ভোট পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দিশানায়েকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রনিল পান ১৭.২৭% ভোট। ভোট শতাংশের নিরিখে তিনি তৃতীয় স্থান পেয়েছেন এবং পার্লামেন্ট বিরোধী দলনেতা সাজিথ প্রেমদাসা ৩২.৭৬% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কোনও বামপন্থীনেতা ক্ষমতা পেলেন।

আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কাকে দ্বীপ দান! ৫০ বছর আগে ইন্দিরা গান্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটের আগে কেন সরব বিজেপি?

২০২২ সালে চরম আর্থিক সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। দ্বীপরাষ্ট্রটির বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। দেশটির সরকারের ভুল অর্থনীতি, দুর্নীতি, প্রতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলির দুর্বলতা, গোষ্ঠীপ্রীতি, শাসক দলের একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতার মতো কারণগুলির জন্য অর্থভান্ডারে টান পড়েছিল। সেই টালমাটাল পরিস্থিতির পর শ্রীলঙ্কায় এটাই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। শ্রীলঙ্কা স্বাধীন হয়েছে সাড়ে সাত দশক আগে। স্বাধীনতার পর থেকে বরাবরই কয়েকটি পরিবারের হাতেই দেশ শাসনের ক্ষমতা থাকত। সম্প্রতি কয়েক বছরের আর্থিক সঙ্কটে অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয় শ্রীলঙ্কা। এই পর্যায়ে ২০২২ সালে প্রবল জনরোষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষে এবং তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। এরপর গঠিত হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। পার্লামেন্টের সদস্যদের নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান রনিল।

রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে জনগণের যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি রনিলের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এই ভোটে বামজোটের নেতা অনুরাকুমার দিশানায়েকে-র উপরেই শেষপর্যন্ত আস্থা দেখালেন দেশবাসী। ভোটের প্রচারে দুর্নীতির দমন, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ-সহ আর্থিক টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যাশা দিয়েছিলেন তিনি। এর জন্য তিনি আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় যেতে চাইছেন। কিন্তু বলে রাখা প্রয়োজন, ফ্রন্টলাইন সোশালিস্ট পার্টির মতো দলগুলি আইএমএফের বিরোধী। ভোটের প্রচারেও এই দলগুলি আইএমএফের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।

ছোট্ট কৃষিপরিবার থেকে উঠে আসা অনুরার। বাবা ছিলেন বাবা ছিলেন  সরকারী অফিসের ক্লার্ক এবং মা গৃহবধূ। ১৯৮৮ সাল নাগাদ জেভিপি-র দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের সময় তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের মৃত্যু হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের বাড়িও। সেই অনুরাই কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতিতে। ২০১৪ সালে সেই জেভিপি-রই প্রধান হলেন তিনি। অতীতে জেভিপি-র কিছু পদক্ষেপকে নানা জন নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেন। কারও চোখে সেটা ছিল বিপ্লব, কেউ আবার সেই দিনগুলিকে হিংসাত্মক দিন বলেই চিহ্নিত করেছেন। যারা ওই সময়কালকে হিংসাত্মক বলে মনে করেন তাঁদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন দিশনায়েকে। দলকে আবার নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। সেই নতুন আদর্শেই যেন সফলতা পেল দল। জেভিপি-র লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কমরেড নেতা রেহানা বিজয়ভেরার নেতৃত্বে দু'বার অভ্যুত্থানে করে ব্যর্থ হয়েছে জেভিপি। অভ্যুত্থানে রেহানার মৃত্যু হয়। মারা যান প্রায় ৬০,০০০ মানুষ । দ্বিতীয় অভ্যুত্থানে ব্যর্থ হয়ে জেভিপি সিদ্ধান্ত নেয়, তারা আর সশস্ত্র সংগ্রাম করবে না। এই সময় দলের বিপ্লবী সদস্যরা বেরিয়ে গিয়ে ফ্রন্টলাইন সোশালিস্ট পার্টি গঠন করেন।

সম্প্রতি ভারত সফরে এসেছিলেন দিশানায়েকে। সে সময় ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডেভালের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল তাঁর। বৈঠকে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার বার্তা দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। যদিও তাঁর দলে একাধিকবার ভারতবিরোধী নিদর্শন দেখা গিয়েছে। বিশেষজ্ঞমহল আশঙ্কা করছে, এই পরিস্থিতিতে দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে নয়াদিল্লিকে।

আরও পড়ুন: মানুষের আস্থা ফিরবে? শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের আসল পরিচয় জানুন

অন্যদিকে, বহুদিন ধরেই শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়ে গিয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা দাবি করছেন, এই নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখাননি দিশনায়েকে। জেভিপি কট্টর তামিল ইলামের বিরোধী। তাঁরা বার বার যুক্তি দিয়েছে, এই আন্দোলনে ভারতের হাত রয়েছে। মনে রাখতে হবে, যখন রাজাপক্ষের সরকার তামিল ইলামের আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিল, তখনও কিন্তু জেভিপি রাজাপক্ষদেরই সমর্থন করে। এখন দিশানায়কে রাষ্ট্রপ্রধান। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। তামিল-ক্ষত মুছে দিতে আদৌ পদক্ষেপ করবেন দিশনায়ক? কীভাবে মোকাবিলা করবেন তিনি এই ইস্যুর? শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষকে দিশা দেখাতে পারবেন দিশানায়েকে? আপাতত সেই দিকেই তাকিয়ে তামাম বিশ্ব।

More Articles