ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধঘোষণা হিজবুল্লাহের, গাজার পরিণতি হতে চলেছে লেবাননেরও?
Israel-Hezbollah Conflict: এতদিন পর্যন্ত মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ হয়েই ইজরায়েলের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল হিজবুল্লাহ। আর কোনও রাখঢাক নয়। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে এবার খোলাখুলি যুদ্ধঘোষণা করে দিল লেবাননের এই জঙ্গিগোষ্ঠী।
গাজায় যুদ্ধের আগ্রাসন থেকে এক বিন্দুও সরে দাঁড়ায়নি ইজরায়েল। এর মধ্যে যে আশঙ্কায় কাঁপছিল গোটা বিশ্ব, তেমনটাই হল। লেবাননের জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহের সঙ্গে এবার পুরোমাত্রায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল ইজরায়েল। দিন কয়েক আগেই লেবানন, সিরিয়া ও বেইরুটের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ ঘটে। যে হামলার দায় ইজরায়েলের কাঁধেই ঠেলেছিল ইরানপোষিত জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ। এতদিন পর্যন্ত মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ হয়েই ইজরায়েলের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। এবার আর কোনও রাখঢাক নয়। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধঘোষণা করে দিল হিজবুল্লাহ।
পেজার হামলার ব্য়াপারটাকে যে হিজবুল্লাহ বা ইরান, কেউ-ই যে ভালো ভাবে নেয়নি, তা প্রথম থেকেই ঘোষণা করে দিয়েছিল তারা। কার্যত এর ফল ভুগতে হবে ইজরায়েলকে, এমন হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছিল ইরান। গত সপ্তাহে প্রায় দিন তিনেক ধরে একের পর এক পেজার বিস্ফোরণ হতে থাকে লেবাননের বিভিন্ন এলাকায়। প্রায় চার-সাড়ে চার হাজার মানুষ জখম হন সেই হামলায়। মৃ্ত্যু হয় অন্তত ৩২ জনের। যার মধ্যে বেশিরভাগই হিজবুল্লাহ জঙ্গি রয়েছেন। রয়েছে দুটি শিশুও। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরেও হামলার তীব্রতা থেকে সরে আসেনি কোনও পক্ষই।
আরও পড়ুন: মোবাইল ছেড়ে হাতে হাতে পেজার! কেন সেকেলে যোগাযোগ মাধ্যমেই ভরসা লেবাননের?
২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস ইজরায়েল হামলা করার পরেই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তার পর থেকেই ইজরায়েলে হামলার পর হামলা চালিয়ে গিয়েছে হিজবুল্লাহ জঙ্গিরা। এই হামাসও ইরানের মদতপুষ্ট হিসেবেই পরিচিত। গাজায় আগ্রাসন বাড়াতেই ইজরায়েলের দিকে একের পর এক রকেট, ড্রোন নিক্ষেপ করে গিয়েছে হিজবুল্লাহ। ইজরায়েলের জোরালো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিরভাগকেই মাঝআকাশে প্রতিহত করেছে। কখনও কখনও হিজবুল্লাহকে উত্তরও ফিরিয়ে দিয়েছে ইজরায়েল। কিন্তু সম্প্রতি সেই যুদ্ধ অন্যরূপ নেয়।
গত শনিবার ইজরায়েলের জেজরিল উপত্য়কার উত্তরাঞ্চলীয় শহকগুলি লক্ষ্য় করে অন্তত দশটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে হিজবুল্লাহ। ইজরায়েলের তরফে অবশ্য দাবি, বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্রকেই মাঝপথে প্রতিহত করা গিয়েছে। তবে সেই ক্ষেপণাস্ত্রের শার্পনেলে আঘাত পায় বছর ষাটেকের এক ব্যক্তি। সেই হামলার দায় স্বীকার করে হিজবুল্লা। তারা জানায়, তাদের নিশানায় ছিল লেবানন সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রামাত ডেভিড এয়ারবেস, যেটা ইজরায়েলি বিমানবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত স্থান। এর জবাবে দক্ষিণ লেবাননে একের পর এক প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে থাকে ইজরায়েল। আইডিএফ জানায়, হিজবুল্লাহ-র অন্তত ১১০টি জায়গা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। যার মাধ্যমে হিজবুল্লাহের আরও আক্রমণ প্রতিহত করা গিয়েছে বলেও জানায় তারা। এরপরেই ইজরায়েলের তরফে সামনে আসতে থাকে তাদের সাফল্যের একের পর এক খতিয়ান। আইডিএফ জানায়, হিজবুল্লাহের রকেট-ফায়ারিং সক্ষমতা ধ্বংস করতে হাজার হাজার রকেট ব্যারেল-সহ অন্তত ২৯০টি হিজবুল্লাহ সাইটে বিমান হামলা চালায় ইজরায়েল।
এরই মধ্যে পাল্টা হামলা চালায় হিজবুল্লাহও। ইজরায়েলি বাহিনীকে নিশানা করে তাদের তরফে ছোড়া হয় অন্তত ৯০টি রকেট। এদিকে ইজরায়েলের বেইরুট বিমান হামলা চালায় ইজরায়েল। তাতে হিজবুল্লাহের এক সিনিয়র কম্যান্ডারের মৃত্যুর খবর মেলে। কার্যত ইজরায়েলের একের পর এক স্ট্রাইকে অন্তত ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে লেবাননে, তেমনটাই জানানো হয়েছে লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে। আর এর পরেই ক্ষুব্ধ লেবানন ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামার কথা ঘোষণা করেছে। হিজবুল্লাহের রাদওয়ান ফোর্সের প্রধান ইব্রাহিম আকিল-সহ আরও কয়েক জন উচ্চপদস্থ কম্যান্ডার নিহতদের তালিকায় রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যার প্রতিশোধ নেওয়া হবেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহের আরেক উচ্চপদস্থ নেতা আহমেদ মাহমুদ ওয়াহবিও নিহত হন ইজরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায়। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ এই হামলার নিন্দা করে একে যুদ্ধপরাধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এর পরেই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামলার মাত্রা আরও বাড়িয়েছে হিজবুল্লাহ। উত্তর ইজরায়েল জুড়ে বিমান হামলার সাইরেন বাজছে তো বাডছেই। হাজার হাজার বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করেছে ইজরায়েল। হাইফার কাছের কিরিয়াল বিয়ালিক শহরের একটি আবাসিক ভবনের কাছে এসে পড়ে হিজবুল্লাহ-র ছোড়া একটি রকেট। মুহূর্তে আগুন ধরে যায় ভবনটিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় একাধিক গাড়ি। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি ইজরায়েলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বা আয়রন ডোম তেমনভাবে কাজ করে উঠতে পারছে না।
গত বছর অক্টোবর মাসের সাত তারিখ। ইহুদিদের পবিত্র দিনে দেশের সমস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে ঢুকে পড়েছিল হামাস জঙ্গিরা। ঘটনার ভয়াবহতায় কেঁপে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। প্রায় ১৪০০ মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। বন্দি বানানো হয় বেশ কিছু ইজরায়েলিকে। তার পরেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইজরায়েল। সেই স্মৃতি উস্কে অক্টোবর আসার আগেই ফের ইজরায়েলবাসীর মাথার উপর চক্কর কাটছে নয়া যুদ্ধের আশঙ্কা। কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে রকেটের সাইরেন। গাজায় যে লাগাতার যুদ্ধ প্রায় এক বছর ধরে চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল, তেমন কিছুই কি ঘটতে চলেছে এবার নেতানিয়াহুর নিজের দেশে। নাকি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই আঘাত ফিরিয়ে দেবে ইজরায়েল। তেমনটাই জানিয়েছেন অবশ্য দেশের প্রধানমন্ত্রী?
নেতানিয়াহু সাম্প্রতিক এই হামলার বিষয়ে জানান, কোনও দেশই তার শহরগুলিতে অযৌক্তিক রকেটিং মেনে নিতে পারে না। মানবে না তারাও। নেতানিয়াহুর বার্তা, উত্তরাঞ্চলের নিরাপত্তা ফেরাতে এবং মানুষকে রক্ষা করতে ইজরায়েল সরকার যে যে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন, তা নেবে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। গাজায় যখন পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করে ইজরায়েল, সে সময় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো একাধিক শক্তিশালী দেশকে পাশে পেয়েছিলেন নেতানিয়াহু। কিন্তু হিজুবুল্লাহের এই যুদ্ধে যেহেতু সরাসরি জড়িত ইরান এবং ইরানকে কোনও ভাবেই চটাতে চায় না আমেরিকা, ফলে নতুন এই লড়াইয়ে বন্ধু বাইডেনকে কতটা পাশে পাবেন নেতানিয়াহু, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এমনিতেই পেজার হামলার দায় ইজরায়েলি জঙ্গিগোষ্ঠী মোসাদের উপরে চাপাতেই উঠেপড়ে লেগেছিল আমেরিকা। এমনকী সেই হামলার বিষয়ে যে তারা কিছুই জানত না, তা-ও বোঝাতে কম কসুর করেনি তারা। এই পরিস্থিতিতে হিজবুল্লাহকে যদি পুরোদমে সমর্থন করে ইরান, তবে এই যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে তো ইজরায়েল। এমনিতেই গাজায় এক বছর ধরে যুদ্ধ করতে করতে ইজরায়েলি সেনার অবস্থা যথেষ্ট চাপে। এই পরিস্থিতিতে হিজবুল্লাহকে সর্বশক্তি দিয়ে আটকাতে পারবে তো ইজরায়েল? উঠছে প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: ফের নতুন করে হামলা বেইরুটে, পেজার বিস্ফোরণে কেন জড়াচ্ছে ইজরায়েলের Unit 8200-র নাম?
এরই মধ্যে লেবাননে ইজরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন ইরাকের শিয়া ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি সিস্তানি। ইজরায়েলের এই বর্বর আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা করেন তিনি। হিজবুল্লাহের তরফে যে ভাবে ইজরায়ের সঙ্গে যুদ্ধের নয়া পর্বে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে, তাতে কাঁপছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। রাষ্ট্রের সঙ্ঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতারেসের আশঙ্কা, চলমান গাজা সংঘাতের মধ্যে ইজরায়েল-হিজবুল্লাহের এই লড়াই চলতে থাকে লেবাননের আরও একটি গাজা হয়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এই পরিস্থিতিতে দু'পক্ষকেই সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জানান, আমেরিকা এই সংঘাত আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবে যেভাবে দু'পক্ষই নিজের অবস্থানে অনড় থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিচ্ছে, তাতে সঙ্কট আরও বেড়েছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।