লেবাননে ইজরায়েলের হামলায় মৃত অন্তত ৫৫০, ফিরে দেখা হিজবুল্লাহ-ইজরায়েল সংঘর্ষের ইতিহাস
Israel-Hezbollah Conflict: একটি ভিডিও বার্তায় লেবাননের বাসিন্দাদের উদ্দেশে নেতানিয়াহু জানান, ইজরায়েলের যুদ্ধ হিজবুল্লাহের সঙ্গে, সাধারণ লেবাননবাসীর সঙ্গে নয়। হিজবুল্লাহ তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে।
আরও একটা যুদ্ধ লেগেই গেল শেষপর্যন্ত। গাজায় প্রায় এক বছর ধরে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। এর মধ্যে হিজবুল্লাহের সঙ্গে ফের উস্কে উঠেছে সংঘাত, যার জেরে লেবাননে হামলার পর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলি হামলায় লেবাননে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫০০ পেরিয়েছে ইতিমধ্যেই। তার মধ্যে অন্তত ৫০ জনই শিশু। রয়েছে অসংখ্য মহিলাও। যতদূর জানা গিয়েছে, হিজবুল্লাহের উপর চাপ বাড়াতে লেবাননের প্রায় আটশোটি জায়গায় ইতিমধ্যেই আকাশপথে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। পাল্টা হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহও। তাদের তরফে দাবি করা হয়েছে, ইজরায়েলের সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে দু'শোটিরও বেশি রকেট হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহেরা। ইজরায়েলের বায়ুসেনা ঘাঁটিকেও নিশানা করা হয়। যদিও সেই হামলায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে এখনও পর্যন্ত মুখ খোলেনি ইজরায়েল।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইজরায়েলে হামাসের হামলার পরেই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দেয় বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। সেই থেকেই ইজরায়েলের উপর একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইরানপুষ্ট লেবাননের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ। অভিযোগ, হামাসকেও ভিতরে ভিতরে মদত দিয়ে চলে ইরানই। হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের সংঘাতের পর থেকেই ইজরায়েলকে কোণঠাসা করতে হান সেই থেকেই বিবাদ লেগেই রয়েছে ইজরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহের।
তবে এ বিবাদ মাত্র এক বছরের পুরনো, তা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। এর নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ ৪২ বছরের ইতিহাস। লেবানন ভিত্তিক শিয়া ইসলামপন্থী এই হিজবুল্লাহেরা লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময়ই দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের দখল নেয়। ১৯৯২ সাল থেকেই দেশটির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে সংগঠনটি। আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা ইজরায়েলের মতো কয়েকটি দেশের জন্য সন্ত্রাসী সংগঠন হলেও বাকিদের জন্য কিন্তু হিজবুল্লাহ রাজনৈতিক দল এবং সশস্ত্র সংগঠন। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-কে উপড়ে ফেলার জন্য লেবানন আক্রমণ করে ইজরায়েল। দখল নিতে নিতে বেইরুট পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল তারা, সে সময় থেকেই হিজবুল্লাহের সঙ্গে বিবাদ শুরু। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে লেবাননে একাধিক বিদেশি বাহিনীর উপর হামলার দায় বর্তেছিল হিজবুল্লাহের উপরে। ১৯৮৩ সালে বেইরুটে ফরাসি এবং মার্কিন সামরিক ব্যারাকে বোমা ফেলার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। যাতে প্রায় ৩০০ জন শান্তিরক্ষী বাহিনী নিহত হয়। এরপর ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি করতে শুরু করে তারা। ১৯৮৫ সালে ইজরায়েলের দখলীকৃত দক্ষিণ লেবানন থেকে তাদেরকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল হিজবুল্লা বাহিনী।
আরও পড়ুন: ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধঘোষণা হিজবুল্লাহের, গাজার পরিণতি হতে চলেছে লেবাননেরও?
তার পর তো ১৯৯২ সাল থেকে দেশের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া শুরু তাদের। সে বছর লেবাননে ১২৮ সদস্যের পার্লামেন্টে ৮টি আসন জিতেছিল তারা। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালে উত্তর ইজরায়েলে হিজবুল্লাহের আক্রমণের প্রত্যাঘাত হিসেবে লেবাননে 'অপারেশন অ্যাকাউন্টেবিলিটি' শুরু করে ইজরায়েল। তাতে ১১৮ জন সাধারণ লেবাননবাসীর মৃত্যু হয়। ১৯৯৬ সালে 'অপারেশন গ্রেপস অব রাথ'-র মাধ্যমে ফের শুরু হয় দু'পক্ষের হিংসা। প্রায় দু'বছর দখলদারিত্বের পর ২০০০ সালের মে মাসে লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছিল ইজরায়েল। আর তার নেপথ্যে ছিল এই হিজবুল্লাহই। ২০০৬ সালে দুই ইজরায়েলি সেনাকে বন্দি করা নিয়ে ফের যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ইজরায়েল ও হিজবুল্লাহের মধ্যে। প্রায় ৩৪ দিনের যুদ্ধে দু'পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্তত ১২০০ লেবাননবাসী ও ১৫৮ জন ইজরায়েলির মৃত্যু হয়েছিল সেই দ্বন্দ্বে।
কার্যত দিনে দিনে লেবাননের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি এবং হিজরায়েলের বিরুদ্ধে আরব-প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবেই উত্থান হতে থাকে হিজবুল্লাহের। লেবাননের সাধারণ মানুষের সমর্থন তাদের সে কাজে আর বেশি করে সাহায্য করেছিল। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল হিজবুল্লাহেরা। এরই মধ্যে ইরানের সমর্থন আরও খানিকটা শক্তি বাড়িয়ে দেয় তাদের। ২০২৩ সালে হামাস-ইজরায়েল সংঘাতের আবহে নতুন করে ইজরায়েলের উপর হামলা বাড়াতে থাকে হিজবুল্লাহেরা। প্রায়শই হিজবুল্লাহের ছোড়া রকেট ছুটে আসত ইজরায়েলকে নিশানা করে। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা সিস্টেম বেশিরভাগকেই মাঝপথেই প্রতিহত করে বলে দাবি করা হয় ইজরায়েলের তরফে। এই এক বছর ধরে ইজরায়েল-হিজবুল্লা সংঘাত নতুন মাত্রা নিয়েছে। যা চরমে পৌঁছয় গত সপ্তাহে লেবাননে পেজার হামলাকে কেন্দ্র করে। যার দায় ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ ও ইউনিট ৮২০০ -র উপরেই ঠেলেছিল হিজবুল্লাহ, এমনকী আমেরিকাও।
তার পরেই ইজরায়েলে তড়িঘড়ি হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। যার উত্তরে লেবাননে একের পর এক হামলা চালাতে থাকে ইজরায়েলের বাহিনী। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দেন, পৃথিবীর কোনও দেশই অকারণে তার দেশের শহরে অবাঞ্ছিত রকেট হামলা বরদাস্ত করবে না। ফলে করবে না ইজরায়েলও। তার পর থেকেই লেবাননকে লক্ষ্য করে একের পর এক হামলা চালিয়েই যাচ্ছে ইজরায়েল। সম্প্রতি ইজরায়েলের বিরুদ্ধেও যুদ্ধের কথা বলেছে হিজবুল্লাহ। ইজরায়েলের পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধ বলেই ব্যাখ্যা দিয়েছে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ।
সম্প্রতি বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর তরফে লেবাননবাসীর বিরুদ্ধে বার্তা দিয়ে জানানো হয়েছে, তাঁরা যেন কোনও ভাবেই হিজবুল্লাহের মানবঢাল হয়ে ওঠার চেষ্টা না করেন। একটি ভিডিও বার্তায় লেবাননের বাসিন্দাদের উদ্দেশে নেতানিয়াহু জানান, ইজরায়েলের যুদ্ধ হিজবুল্লাহের সঙ্গে, সাধারণ লেবাননবাসীর সঙ্গে নয়। হিজবুল্লাহ তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। তাদের বসার ঘর, গ্যারেজ মিসাইল রাখার জন্য ব্যবহার করছে জঙ্গিরা। যা ব্যবহার করা হচ্ছে ইজরায়েলের নাগরিকদের বিরুদ্ধে। সেই সব অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে ফেলতে হবে বলে জানান ইজরায়েলের প্রধাবমন্ত্রী। তিনি এ-ও জানিয়ে দেন, হিজবুল্লাহের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান শেষ হলেই আবার পুরনো জীবনে ফেরত আসতে পারবেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
আরও পড়ুন:বিস্ফোরক লুকানো ছিল পেজারেই, লেবাননে বিধ্বংসী হামলার নেপথ্যে ‘ধুরন্ধর’ মোসাদ?
তেমনটা যে গাজায় গত এক বছরেও হয়নি, তা দেখেছে গোটা বিশ্ব। সেই গত বছরের অক্টোবর থেকে গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। এখনও পর্যন্ত গাজায় মৃতের সংখ্যা ৪১ হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। জখম এক লক্ষের কাছাকাছি। আর মাত্র এক সপ্তাহের লড়াইয়ে সাড়ে পাঁচশোরও বেশি লেবাননবাসীর মৃত্যু হয়েছে। জখম প্রায় আঠারোশো। হতাহতের মধ্যে অসংখ্য শিশু ও মহিলা রয়েছেন। হামাসের পরে কি এবার তবে হিজবুল্লাহকে খতম করার অভিযানে নামল ইজরায়েল? আর সেই লড়াইয়ে কি গাজার মতোই অবস্থান হতে চলেছে লেবাননের। দু-পক্ষের লড়াইয়ে উলুখাগড়ার মতো মরবেন শুধু তাঁরাই। গাজায় এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নিরাপদ বলে আর কিছুই নেই। গোটা শহরটাকেই আস্ত একটা গণকবরে পরিণত করেছে ইজরায়েল। এবার কি তেমন পরিণতির অপেক্ষায় দিন গুনছে লেবানন? কার্যত ২০০৬ সালের যুদ্ধের পরে সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাত বলা যায় সাম্প্রতিক এই হিজবুল্লাহ-ইজরায়েল যুদ্ধকে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের ভূমিকা কী হতে চলেছে? আমেরিকাই বা কী ভূমিকা নেবে নতুন এই সংঘাতে? ইতিমধ্যেই দু'পক্ষকেই পরিস্থিতি পুনর্বিবেচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। আদৌ কোথায় পৌঁছতে চলেছে এই যুদ্ধ? উঠছে একাধিক প্রশ্ন।