মোসাদের দফতরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হিজবুল্লাহের, যে ভয়ঙ্কর পরিণতির আশঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব

Israel Hezbollah War: ইজরায়েলের তরফে জানানো হয়েছে, এই প্রথম হিজবুল্লাহের ছোড়া কোনও ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য ইজরায়েলে প্রবেশ করল। তবে ঠিক কতজন ওই হামলায় হতাহত হয়েছে, তা জানানো হয়নি ইজরায়েলের তরফে।

লেবানন, সিরিয়া ও বেইরুট জুড়ে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনায় ইজরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের ঘাড়েই দায় ঠেলেছিল ইরানপুষ্ট লেবাননের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ। এবার সেই মোসাদের সদর দফতরকে নিশানা করেই ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করল হিজবুল্লাহ জঙ্গিরা। গত কয়েকদিন ধরেই ইজরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহের সংঘাত নতুন মাত্রা নিয়েছে। আর সেই সংঘাতের আগুনেই ঘি ঢেলেছে হিজবুল্লাহের সাম্প্রতিক এই পদক্ষেপ।

এক বছর ধরে গাজায় ইজরায়েলি আগ্রাসন চলছে। হামাস-ইজরায়েলের যুদ্ধে রাশ টানার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বের একাধিক দেশ। এমনকী আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের অবস্থান থেকে সরানো যায় ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে। এরই মধ্যে নতুন করে আরও একটি যুদ্ধ। ইরানপুষ্ট লেবাননের জঙ্গিসংগঠন হিজবুল্লাহের সঙ্গে চাপা সংঘাত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে সম্প্রতি। কার্যত গাজার মতোই লেবাননেও একের পর এক হামলা চালানো শুরু করেছে ইজরায়েল।

পিছিয়ে নেই হিজবুল্লাহরাও। লেবানন, সিরিয়া ও বেইরুট জুড়ে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের পর ইজরায়েলকে জবাব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল হিজবুল্লাহ। তার পর থেকেই লেবাননে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। মঙ্গলবার পর্যন্ত ইজরায়েলের হামলায় লেবাননে অন্তত ৫৫৮ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছিল। তার মধ্যে অন্তত ৫০ জন শিশু ছিল বলে খবর। এর মধ্যে তেল আভিভের কাছে মোসাদের সদর দফতর লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল লেবানন ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনটি। ইজরায়েলি বাহিনী অবশ্য জানিয়েছে, বুধবার তেল আভিভে সতর্কতা সাইরেন বেজে উঠতেই সতর্ক হয়ে যায় ইজরায়েল। হিজবুল্লাহর দাবি, তাঁদের এই সাম্প্রতিক হামলায় অন্তত ৫০০ জন নিহত হয়ে থাকতে পারেন ইজরায়েলে। এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য় হয়েছেন কয়েক হাজার। পেজার ও ওয়্যারলেস ডিভাইস ব্যবহার করে যেভাবে লেবাননে হামলার পরিকল্পনা করেছিল মোসাদ, তার বদলা নিতেই সাম্প্রতিক এই হামলা।

আরও পড়ুন: লেবাননে ইজরায়েলের হামলায় মৃত অন্তত ৫৫০, ফিরে দেখা হিজবুল্লাহ-ইজরায়েল সংঘর্ষের ইতিহাস

ইজরায়েলের তরফে জানানো হয়েছে, এই প্রথম হিজবুল্লাহের ছোড়া কোনও ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য ইজরায়েলে প্রবেশ করল। তবে ঠিক কতজন ওই হামলায় হতাহত হয়েছে, তা জানানো হয়নি ইজরায়েলের তরফে। এখনও পর্যন্ত মধ্য ইজরায়েলের নাগরিক প্রতিরক্ষা নির্দেশাবলীতেও কোনও পরিবর্তন পাওয়া যায়নি। তবে ইজরায়েলি সেনা জানিয়েছে, শুধু তেল আভিভই নয়, ইজরায়েল অধিকৃত সিরিয়ার গোলান হাইটস ও উত্তর ইজরায়েলের মাউন্ট কারমেলের কাছেও হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লারা। এমনকী হিজবুল্লাহের আক্রমণে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে অন্তত দু'জন ফিলিস্তিনি জখম হয় বলে খবর। মোসাদের সদর দফতর লক্ষ্য করে যে ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া হয়েছিল, তার বেশ কিছু রকেট ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের খোলা এলাকায় আঘাত হানে।

প্রায় এগারো মাস ধরেই হিজবুল্লাহের সঙ্গে ইজরায়েলের এই যুদ্ধপরিস্থিতি চলে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক কালে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ধারণ করেনি। গোড়া থেকেই ছেড়ে কথা বলেনি ইজরায়েল। বরং দ্বিগুণ জোরে আঘাত হেনেছে লেবানন তারা। গত কয়েকদিনে প্রায় তিন হাজারটি হিজবুল্লাহ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে ইজরায়েলের যুদ্ধবিমান। সম্প্রতি দক্ষিণ বেইরুটে হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইজরায়েলের হামলায় ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর ক্ষেপণাস্ত্র বিভাগের প্রধান ইব্রাহিম কোবেইসির মৃত্যু হয়। একদিন আগেই ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বাসিন্দাদের সতর্ক করে জানান, হিজবুল্লাহের ঢাল না হতে। যতক্ষণ না ইজরায়েলের উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত ৬০ হাজার নাগরিক ঘরে ফিরে না আসে, লেবাননে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারির পর থেকেই ইজরায়েলে হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে হিজবুল্লাহ। প্রতিদিন প্রায় ১০০-২০০ রকেট ছোড়া বাড়িয়েছে তারা। ইজরায়েলকে নিশানা করে গুলি-বোমাও বেড়েছে কয়েক গুণ। এদিকে ইজরায়েলের হামলায় একের পর এক হিজবুল্লা কম্যান্ডারের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ক্ষোভপ্রকাশ করেছে ইরানও। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেই জানিয়েছেন, এই ভাবে একের পর এক কম্যান্ডার হত্যা আদৌ হিজবুল্লাহকে থামাতে পারবে না। ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ জঙ্গিগোষ্ঠীর উপরে পূর্ণ আস্থা রেখেছেন তিনি। খামেনেই এ-ও জানান, হিজবুল্লাহের সাংগঠনিক ও মানবিক শক্তি এর চেয়ে অনেক বেশি। দু- এক জন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে হত্যা করে তাঁদের রুখে দেওয়া যাবে না।

এদিকে হিজবুল্লাহের সঙ্গে ইজরায়েলের এই সাম্প্রতিক উত্তাপ নিয়ে বেশ চাপে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন তিনি। শুধু রাষ্ট্রসঙ্ঘই নয়, একই সঙ্গে সাম্প্রতিক এই যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বহু দেশই। সকলেই দু'পক্ষকে সংযম দেখিয়ে কূটনৈতিক পথে সমাধান খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে। ১৫ সদস্যের রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ নিয়ে বৈঠক হওয়ারও কথা রয়েছে। এদিকে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র কারিন জিন-পিয়ে জানিয়েছেন, হিংসা পরিস্থিতি বাড়ার বিষয়টি নিয়ে ভীত ও উদ্বিগ্ন আমেরিকা। ইজরায়েল ও হিজবুল্লাহের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন ইতিমধ্যেই ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি।

গাজায় যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইজরায়েলের পাশে ছিল আমেরিকা। শুধু পাশেই ছিল না, কার্যত ইজরায়েলকে যুদ্ধের ক্ষেত্রে মদতও জুগিয়ে গিয়েছেন বন্ধু ডো বাইডেন। তবে গোড়া থেকেই ইরানপুষ্ট হিজবুল্লাহের সঙ্গে ইজরায়েলের সংঘাতে যাওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়ে এসেছে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রসঙ্ঘে দেওয়া তাঁর সর্বশেষ ভাষণেও সে কথাই আবার মনে করিয়ে দিলেন তিনি। কূটনৈতিক পথেই সমাধান খোঁজার বার্তা দিতে দেখা গেল তাঁকে বারবার।

আরও পড়ুন: ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধঘোষণা হিজবুল্লাহের, গাজার পরিণতি হতে চলেছে লেবাননেরও?

এদিকে ইজরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাতের এই পরিস্থিতিতে লেবাননে বসবাসরত রুশদের যত দ্রুত সম্ভব লেবানন ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর আগে নিজের দেশের নাগরিকদের একই রকম পরামর্শ দিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও কানাডা সরকারও। ইজরায়েল ও হিজবুল্লাহের মধ্য এই সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি যে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতবস্থাকে ঘেঁটে দিতে চলেছে, তা ভালোই বুঝতে পারছেন এই সব দেশের রাষ্ট্রনেতারা। হিজবুল্লাহ একা নয়, ইরান প্রতিনিয়ত সমর্থন দিয়ে চলে প্যালেস্টাইনের হামাস ও ইয়েমেনে হাউথি জঙ্গিদের। ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই ঝামেলা লেগে রয়েছে ইজরায়েলের। ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলির দিকে বহু দিনের নজর ইজরায়েল। ইতিমধ্যেই লেবাননে পেজার হামলার নিন্দা করে সরব হয়েছে ইরাক। পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে এই সংঘাত যে আরও বড় কোনও যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞেরা।

More Articles