ছ'বছরে সর্বত্র শুধুই ক্ষতি! নোটবন্দির কালো ছায়া আজও ঢেকে রেখেছে দেশকে
Demonetisation: বিশেষজ্ঞরা বলেন, নোটবন্দি প্রথম থেকেই একটা ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, নোটবন্দির প্রথম অনুমানটাই ভুল।
নোটবদলের ৬ বছর পূর্তি। কথা ছিল, কালো টাকা ফিরবে দেশে। কিন্তু সত্যি কি কালো টাকা ফিরল? নগদ টাকায় দুর্নীতির কারবার কি সত্যিই কম হলো? নোটবন্দির এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে এই একটি প্রশ্ন গত ৬ বছর ধরে তাড়া করছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এর কোনও সন্তোষজনক উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। এমনিতেই অক্টোবরে নোটবন্দি-সংক্রান্ত একটি জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্টকে তারা জানিয়েছে, এই নোটবন্দি বিষয়টি এখন আর বাস্তব জীবনে প্রাসঙ্গিক নয়। কেন্দ্রের অ্যাটর্নি জেনারেল এটাও বলেছেন, নোটবন্দি এখন নিছক একটি পাঠ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এখন আর এর সঙ্গে সরাসরিভাবে কোনও কিছুর যোগ নেই।
তারই মধ্যে মঙ্গলবার এই নোটবন্দির সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর পেল নতুন মাত্রা। প্রকাশ্যে এল একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেখানে দেশের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কই জানাচ্ছে, নোটবন্দির চার দিন আগে দেশের জনতার হাতে যে পরিমাণ টাকা ছিল, তার থেকে নোটবন্দির পর গত ছ'বছরে ৭১.৮৪ শতাংশ টাকা বেড়েছে, যেখানে এর মাঝে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি থাকার কারণে অনলাইনের ব্যবহার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেখানে এখনও মানুষের হাতে ক্যাশ টাকা অনেক বেশি। এই বিষয়টি সামনে আসার পরেই বিরোধী দলগুলো আক্রমণ করতে শুরু করেছে ভারত সরকারকে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মোদি সরকারকে আক্রমণ করে বলেছেন, "কালাধন আসেনি, শুধু দারিদ্র এসেছে। ইকোনমি ক্যাশলেস হয়নি, বরং হয়েছে কমজোর।"
প্রথমে জানা যাক, নোটবন্দি আসলে কী? নোটবন্দি হলো এমন একটি আইনি পদ্ধতি, যেখানে কিছু পরিমাণ আর্থিক ইউনিটকে বাতিল ঘোষণা করে তার মূল্য শূন্য করে দেওয়া হয়। তবে এই নোটবন্দির সিদ্ধান্ত এই প্রথম মোদি সরকার নিয়েছে, এমনটা কিন্তু নয়। ভারতে এর আগেও নোটবন্দির ইতিহাস রয়েছে এবং একাধিকবার একাধিক সরকার এই নোটবন্দির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে ১০০০ টাকা এবং তার থেকে ওপরের মূল্যের নোট প্রথমবার বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। এর আগে পর্যন্ত ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যের নোট সারকুলেট করা হতো ভারতে। ১৯৫৪ সালে স্বাধীন ভারতে ১০০০ টাকা, ৫০০০ টাকা এবং ১০,০০০ টাকার নোট নতুন করে ফিরিয়ে আনা হলো।
আরও পড়ুন: কবে আসবে মোদির ‘১৫ লাখ’! ২০২৪ এর আগে কি ফিরতে চলেছে প্রতিশ্রুতির অর্থ?
কিন্তু ১৯৭৮ সালে আবারও এই তিনটি নোটকে বাতিল বলে ঘোষণা করল মোরারজি দেশাইয়ের সরকার। ফের ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে ১০০০ টাকার নোট আবারও ফিরিয়ে আনা হলো ভারতে, যা সাম্প্রতিক নোটবন্দির আগে পর্যন্ত ভারতে চালু ছিল। এরপর ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫০০ টাকা এবং ১০০০ টাকার সমস্ত চালু নোট বাতিল বলে ঘোষণা করলেন। এই ঘটনাটি ছিল ১৯৭৮ সালের সিদ্ধান্তর একেবারে কার্বন কপি। ব্যাঙ্কিং আওয়ারের পরে নোটবন্দির ঘোষণা ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিল একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর কারণ হিসেবে কালো টাকা এবং জাল নোটের অবলুপ্তিকে সামনে রেখেছিলেন।
এখানেই প্রশ্ন আসে, যদি এর আগেও একইভাবে একই চিন্তাধারা নিয়ে দু'বার নোটবন্দি হয়ে থাকে, তাহলে এবারের নোটবন্দি আগের থেকে কতটা আলাদা? ২০১৬ সালের নোটবন্দি ১৯৭৮ সালের মোরারজি দেশাইয়ের নোটবন্দি-র থেকে কিছুটা হলেও ছিল আলাদা। ১৯৭৮ সালে যখন মোরারজি দেশাই সরকার নোটবন্দি করেছিল, সেই সময় ভারতের অধিকাংশ মানুষ ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের আওতায় পড়তেন না। পাশাপাশি সেই সময় বেশিরভাগ মানুষের কাছেই এতটা বড় টাকার নোট ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব অনুযায়ী মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্যাশ এই সমস্ত বড় টাকার নোটে ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে ব্যাপারটা ছিল একেবারে আলাদা। ততদিনে ভারতের অর্থনীতির একেবারে ভোল বদলে গিয়েছে। ৫০০ এবং ১০০০ টাকায় তখন ভারতের অধিকাংশ টাকা সার্কুলেট হতে শুরু করেছিল। কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৮৬ শতাংশ ক্যাশ সেই সময় ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটে ছিল।
তাই এবারের নোটবন্দি ছিল খাতায়-কলমে অনেকটাই বেশি কার্যকর। এই নোটবন্দির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার দেশের বাইরে থাকা কালো টাকা ভারতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। পরিকল্পিত হত্যা, দাঙ্গা, জঙ্গি কার্যকলাপ, মানব-পাচার, দুর্নীতি এবং মাদক- এই সবকিছুর উৎসই হলো এই কালো টাকা। ২০১৪ সালে এনডিএ সরকার দুর্নীতিকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতে ক্ষমতায় এসেছিল। আর নোটবন্দিকে এর সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র কালো টাকা নয়, একই সঙ্গে আরও অনেক কারণ ছিল এই নোটবন্দির। মনে করা হয়েছিল, যখন মানুষের হাতে থাকা নোট ব্যাঙ্কে আসবে, তখন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ভারতে ছড়িয়ে থাকা জাল নোট পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে। এছাড়াও, মানুষের হাতে যদি ক্যাশ কম থাকে, তাহলে সরাসরি মূল্যবৃদ্ধির ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেছিল ভারত সরকার। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়েছিলেন, যদি মানুষের হাতে কম ক্যাশ থাকে, তাহলে জিনিসপত্রর চাহিদা কম থাকবে। আর যদি চাহিদা কমে যায়, তাহলে জিনিসপত্রর দাম কমে যাবে। এছাড়াও, যেহেতু পুরো টাকা ব্যাঙ্কেই জমা করতে হতো, তাই ক্যাশ ফরমালাইজেশনের একটা সুবিধা পেত কেন্দ্রীয় সরকার। অর্থাৎ, সহজ ভাষায় বলতে গেলে, পুরো টাকার কাউন্টিং হয়ে যেত এবং সকলের আয়ের একটা গড় হিসেব সরকারের কাছে চলে আসত, যাতে ট্যাক্সের অঙ্কটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। নোটবন্দির সময় থেকেই ক্যাশলেস এবং অনলাইন ট্রানজাকশন বাড়তে শুরু করেছিল। এছাড়াও ব্যাঙ্ক নোটের সিকিউরিটি বৃদ্ধি করার পদক্ষেপও একই সঙ্গে করেছিল ভারত সরকার। নোটগুলিকে আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী করে তার মধ্যে অতিরিক্ত কিছু সিকিউরিটি ফিচার যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল ভারত সরকার। বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেছিলেন, কম অঙ্কের ব্যাঙ্ক ডিপোজিট বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আর্থিক সংস্থাগুলি কম সুদে ঋণ দেওয়া শুরু করতে পারত, যার সরাসরি প্রভাব পড়ত ভারতের অর্থনীতির ওপর। কিন্তু সবথেকে বড় আশা ছিল, সরকার হয়তো রবিনহুডের মতো গরিবদের মসিহা হয়ে উঠবে, যে বেইমানি করে রোজগার করা কালো টাকা গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দেবে, এবং সামাজিক ন্যায়ের একটা উদাহরণ তৈরি করবে।
অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি দাবি করেছিলেন, যদি ভারতের সব মানুষ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ ঘোষণা করে, তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই ভারত নিজের স্বরাজ সফল করতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যা ভাবা হয়েছিল, তা ঘটেনি। নোটবন্দির সময়ও হলো একইরকম। ভারতে যে পরিমাণ টাকা বাতিল হলো, তার মোটামুটি পুরোটাই আবারও ব্যাঙ্কের কাছে ফেরত চলে এল। ২০১৮ সালের আরবিআই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৫.৪১ লক্ষ কোটি টাকার ক্যাশ বাতিল করেছিল মোদি সরকার। অন্যদিকে ব্যাঙ্কের কাছে ফেরত চলে এল ১৫.৩০ কোটি টাকার ক্যাশ। অর্থাৎ, মাত্র দু'বছর তিন মাসের মধ্যেই ভারত সরকারের ঘরে ৯৯.৩% ক্যাশ ফেরত চলে এল, যা ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি ভুল বলে প্রমাণিত করল। ভারত সরকার ভেবেছিল, প্রায় ২০ শতাংশ, অর্থাৎ পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার ক্যাশ ফেরত আসবে না ব্যাঙ্কে। কিন্তু, সেরকমটা হলো না। তাহলে সেখানেই প্রশ্ন উঠছে, কালো টাকা আসলে গেল কোথায়? পাশাপাশি ভারত সরকার যে মূল্যবৃদ্ধি কমানোর আশা জুগিয়েছিল, সেই মূল্যবৃদ্ধি কোথায় কমল?
নোটবন্দির ৬ বছর পরে ২০২২ সালে ভারতের কারেন্সি সার্কুলেশন হয়ে উঠেছিল ৩১.০৫ লক্ষ কোটি টাকা, যেখানে ২০১৬ সালে এই অঙ্কটা ছিল মাত্র ১৬.৪ লক্ষ কোটি টাকা। কারেন্সি নোটসংখ্যাতেও বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সরকার ভেবেছিল, মূল্যবৃদ্ধি কম করার পাশাপাশি নোট ছাপানোর পরিমাণও কমাবে। কিন্তু সেরকমটা হয়নি। কালো টাকা ফেরত আসা তো দূরের কথা, এই নোটবন্দির ফলে সরকারের আরও বেশি ক্ষতি হয়। যাঁরা ক্ষমতা রাখেন, তাঁরা তাঁদের কালো টাকা সাদা করার নানারকম রাস্তা খুঁজে বের করে ফেললেন। যেখানে এই নোটবন্দির সমস্ত সমস্যার শিকার হলেন ভারতের দরিদ্র মানুষ, যাঁদের কালো টাকার সঙ্গে দূরদূরান্তেও কোনও সম্পর্ক নেই। গরিবদের সামাজিক ন্যায়বিচার দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার যে পদক্ষেপ করেছিল, সেই পদক্ষেপ পুরোপুরি ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হলো। যাঁরা ক্ষমতাশালী মানুষ ছিলেন, তাঁরা তাঁদের ড্রাইভার, বাড়ির পরিচারিকা এবং গার্ডদের মাধ্যমে নিজেদের নোট পরিবর্তন করিয়ে নিলেন। আর ক্ষমতাশালী মানুষদের এই 'বেইমানি'-তে পুরোপুরি সাহায্য করলেন কিছু ব্যাঙ্কার, যাঁরা ব্যাকডেটে অ্যাকাউন্টিং করে এই টাকা জমা করিয়ে নিলেন। এছাড়াও, মন্দিরের ক্যাশ কালেকশন বাক্স হয়ে উঠল এই ক্ষমতাশালী মানুষদের সিক্রেট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট।
আপনারা হয়তো জানেন, মন্দিরের ক্যাশবাক্স কখনওই আয়কর দফতরের আওতায় আসে না। অর্থাৎ, এই টাকার ওপরে কোনও ট্যাক্স পড়ে না। তাই ভগবানের কাছে নিজেদের কালো টাকা জমা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ক্ষমতাশালীরা। নোটবন্দির পরবর্তী দু'মাসে ১০০০ এবং ৫০০ টাকার বাতিল নোট দান করার গ্রাফ একধাক্কায় অনেকটাই ওপরদিকে উঠে গিয়েছিল। কয়েকজন তো সেই কালো টাকা দিয়ে নিজেদের আশ্রম তৈরি করে ফেললেন। কিনে ফেললেন জমি। অস্থাবর সম্পত্তিকে স্থাবর সম্পত্তিতে রূপান্তর করার এই ছিল সবথেকে ভালো সময়। আয়কর দফতরের চোখে ধুলো দেওয়ার একাধিক পন্থা পেরিয়ে এল দু'মাসের মধ্যে। অর্থাৎ বলতে গেলে, যে সুবিধা ভারতের মানুষের পাওয়ার কথা ছিল, তার কোনও সুবিধাই ভারতের মানুষ পেল না এই নোটবন্দির ফলে।
আসলে, যে কালো টাকা ভারতে আনার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সেই পুরো টাকা সুইস ব্যাঙ্কের মাধ্যমে অপারেট করা হতো। সুইস ব্যাঙ্ক হলো বিশ্বের একমাত্র ব্যাঙ্ক, যারা বিশ্ব ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী চলে না। তারা শুধুমাত্র সুইস কোর্টের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে। তাই এই ধরনের ব্যাঙ্কের ওপর ভারত সরকার কিংবা অন্য কোনও দেশের সরকারের কোনও প্রভাব পড়ে না। ফলে যাঁরা সুইস ব্যাঙ্কের অ্যা।অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, তাদের এই সিদ্ধান্তে কিছু যায় আসল না। তাদের টাকা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। না সুইস ব্যাঙ্কের ওপরে কোনও প্রভাব ফেলতে পারল ভারত সরকার, আর না ভারতে ফেরত এল সুইস ব্যাঙ্কের কালো টাকা।
অন্যদিকে এই পুরো অপারেশনের খরচ, ভারতীয় করদাতাদের ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করল। ভারতের চালু প্রত্যেকটি নোটের অঙ্ক পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল। ভারতের প্রত্যেকটি এটিএম-এর ক্যাসেটকে নতুন করে তৈরি করতে হলো। নতুন ক্যাসেট তৈরি করা এবং পুরনো ক্যাসেট পরিবর্তন করার জন্য একটা বিশাল পরিমাণ খরচ হলো ভারত সরকারের। এর পাশাপাশি, নোট ছাপানোর জন্যও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটা বিশাল টাকা খরচ হলো। নোটবন্দির আগে, ২০১৫-'১৬ আর্থিক বছরে যেখানে ব্যাঙ্ক নোট প্রিন্ট করতে আরবিআই-এর ৩৪২১ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল, সেখানে ২০১৬-'১৭ অর্থবর্ষে ব্যাঙ্ক নোট ছাপতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের খরচ হয়েছিল ৭,৯৬৫ কোটি টাকা। আর ২০১৭-'১৮ অর্থবর্ষে এই নোট ছাপার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের খরচ হয়েছিল ৪,৯১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ। এই বাড়তি খরচের পুরো চাপটা পড়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির ওপর।
আর আরবিআই এই খরচ কখনওই নিজে বহন করে না। সেই কারণে সরকারের ওপর দিয়েই এই টাকার ধাক্কা পুষিয়ে নিল রিজার্ভ ব্যাংক। যেখানে ২০১৫-'১৬ অর্থবর্ষে আরবিআই ভারত সরকারকে ডিভিডেন্ট দিয়েছিল ৬৫,৮৭৬ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৬-'১৭ অর্থবছরে ডিভিডেন্টের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৩০,৬৫৯ কোটি টাকায়। তবে ২০১৭-'১৮ অর্থবর্ষে এই ডিভিডেন্টের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে ৫০,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছিল। এছাড়াও এই নতুন নোট এয়ারলিফট করার জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনীকেও অতিরিক্ত ২৯.৪১ কোটি টাকার পেমেন্ট করতে হয়েছিল। তার পাশাপাশি পুরনো ব্যাঙ্ক নোট কালেকশন, নতুন নোট নিয়ে আসা এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় নতুন নোটের সঞ্চারনের জন্য ভারতের আর্থিক তহবিলকে একটা বিশাল ধাক্কার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।
তবে এতক্ষণ তো কথা হলো এই পুরো নোটবন্দির দৃশ্যমান খরচ নিয়ে। কিন্তু এই নোটবন্দির ফলে ভারতের আর্থিক তহবিলের একটা অভ্যন্তরীণ খরচ হয়েছিল। এই খরচটা ছিল আর্থিক অবক্ষয়। পারচেসিং ম্যানেজার ইনডেক্স, যেটি উৎপাদন এবং বিক্রির আর্থিক তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে, তার হিসেব অনুসারে, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে এই মান ৫৪.৫ শতাংশ থেকে নেমে গিয়ে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে সোজা ৪৬.৭ শতাংশে চলে আসে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পারচেসিং ম্যানেজার ইন্টেক্স যদি ৫০-এর ওপরে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি হচ্ছে। আর যদি এই মান ৫০-এর নিচে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, অর্থনীতির পতন শুরু হয়েছে। ২০১৬ সালে নভেম্বর মাসে যেভাবে পিএমআই নিচের দিকে গিয়েছিল, তা বিগত তিন বছরে কখনও যায়নি।
এই সময়ে ভারতীয় ইন্ডাস্ট্রির আটটি কোর সেক্টরের বৃদ্ধি ৬.৬ শতাংশ থেকে ৪.৯ শতাংশে নেমে এসেছিল। আর এই নোটবন্দির সবথেকে খারাপ প্রভাব পড়েছিল এগ্রিকালচার ইন্ডাস্ট্রির ওপর। এখানে বীজ থেকে শুরু করে সার এবং পেস্টিসাইড পর্যন্ত সমস্ত জিনিস ক্যাশ টাকায় কেনা হয়। এই সেক্টরে কখনওই অনলাইন পদ্ধতি কাজ করে না। সেই কারণে এই সেক্টরে নোটবন্দির সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছিল। অন্যদিকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি নাগাদ রবি ফসলের রোপণ শুরু হয়। ঠিক সেই সময় এই সিদ্ধান্ত ভারতের রবি ফসল চাষিদের ওপর এক বিশাল আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল। এছাড়াও, মানি লন্ডারিংকে সামনে রেখে, কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে টাকা জমা এবং টাকা তোলা বন্ধ করে দিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। কৃষি সেক্টরটির সবচেয়ে বড় মেরুদণ্ড হলো এই কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক। তাই সেই সময় ভারতীয় চাষিদের বিশাল সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এছাড়াও জিডিপি বৃদ্ধির ওপরেও এই নোটবন্দির প্রভাব পড়েছিল। আরবিআই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে যখন নোটবন্দি হয়নি, তখন ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৭.৫%। কিন্তু, নোটবন্দির পরে ২০১৭ সালের জুন মাসে এই সংখ্যাটা পুরো পাল্টে যায়। ৭.৫% থেকে এই সংখ্যাটা নেমে আসে ৫.৭ শতাংশে।
এই সবকিছু ছাড়াও, নোটবন্দির কারণে বিভিন্ন সেক্টরে মানুষের চাকরি যাওয়ার পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। CMIE-র তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে চাকরিরত মানুষের পরিমাণ ছিল ৪০৬.৫ মিলিয়ন। সেখানেই, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে চাকরিরত মানুষের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৪০৫ মিলিয়ন। অর্থাৎ, প্রায় ১০.৫ লক্ষ মানুষ এই সময়ের মধ্যে চাকরি খুইয়েছিলেন। তবে নোটবন্দির আরও খারাপ প্রভাব পড়েছিল অসংগঠিত সেক্টর, রিয়েল এস্টেট এবং কনস্ট্রাকশন সেক্টরের ওপর। এই তিনটি সেক্টরে ক্যাশের ওপরে সবথেকে বেশি ভরসা করা হয়। অল ইন্ডিয়া মোটর ট্রান্সপোর্ট কংগ্রেস দাবি করেছিল, এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৮ লক্ষ ট্রাক ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টর ক্যাশ কম থাকার কারণে সমস্যার মধ্যে পড়েছিলেন। সঙ্গেই প্রায় চার লক্ষ ট্রাক বড় বড় হাইওয়ের ওপর আটকে যায়। গুজরাত, দিল্লি এবং মুম্বইয়ের বিভিন্ন হাইওয়ের ওপর এই ধরনের ট্রাকের একটা লম্বা লাইন পড়ে যায়। ক্যাশ কম থাকার কারণে বিভিন্ন টোল প্লাজাতে ট্রাক আটকে পড়ে। টোল প্লাজা অপারেটররা এই ধরনের বাতিল নোট গ্রহণ করা বন্ধ করে দেন। ফলে, ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রত্যেকটি হাইওয়েতে টোল ট্যাক্স বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয় ভারত সরকারকে। টোল কালেকশন সাসপেন্ড হয়ে যাওয়ার কারণে একটা বিশাল ক্ষতি হয় ভারত সরকারের। রিয়েল এস্টেট সেক্টরের ওপর শুধুমাত্র নোটবন্দি নয়, তার সঙ্গে RERA ও GST-র প্রভাব একসঙ্গে পড়েছিল। এর ফলে, নতুন প্রপার্টি কেউ কিনতে চাইলেন না। ২০১৬-'১৭ আর্থিক বছরের মধ্যে নতুন হাউজিং ইউনিটের ক্রয় ৬০% কমে গেল এই সমস্ত রিয়েল এস্টেট সেক্টরে।
স্টক মার্কেটের ওপরেও এই তুঘলকি চালের ভয়ংকর খারাপ প্রভাব পড়ল। BSE SENSEX ও NIFTY 50, দু'টি স্টক সূচকই ৯ নভেম্বর, ২০১৬ সালে বাজার খোলার সঙ্গে সঙ্গে ৬ শতাংশের নিচে নেমে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষরা এই নির্দেশের সবথেকে বড় ভুক্তভুগী হয়ে উঠলেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এই নোটবন্দির খারাপ প্রভাব পড়ল। এমারজেন্সি থেকে শুরু করে সার্জারির ক্ষেত্রেও পুরনো নোট গ্রহণ করতে চাইল না কোনও হাসপাতাল। ফলে শুধুমাত্র নোট না থাকার কারণে, হাসপাতালেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হলো বহু মানুষের। তাদের রিপোর্টে হয়তো লেখা হলো হার্ট অ্যাটাক, কিন্তু তাঁরা মারা গেলেন স্রেফ ভাবনাচিন্তা না করে গ্রহণ করা একটা পদক্ষেপের কারণে। এটিএম এবং ব্যাঙ্কের বাইরে লম্বা লাইন দিয়ে নাজেহাল হতে হলো সাধারণ মানুষকে। বহু মানুষকে তাঁদের সম্বল ছাড়তে হলো শুধু নোট পাল্টানোর জন্য। ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন, নোটবন্দির কারণে মাত্র ৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে তিনজন ছিলেন ব্যাঙ্ক কর্মী এবং একজন ছিলেন এসবিআই-এর একজন গ্রাহক। কিন্তু, এই সংখ্যাটা চারজন নয়, বরং আরও অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নোটবন্দি প্রথম থেকেই একটা ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, নোটবন্দির প্রথম অনুমানটাই ভুল। ভারত সরকার ভেবেছিল, যাঁরা ক্ষমতাশালী, তাঁরা নিজেদের কালো টাকা ক্যাশ হিসেবে বাড়িতে জমা করে রেখেছিলেন। কিন্তু আসলে, এই পুরো কালো টাকা যাঁদের কাছে থাকে, তাঁরা সুইস ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে সহজেই কালো টাকাকে সাদা করে নিয়েছিলেন। এছাড়াও অনেকে শেল কোম্পানির মতো বিভিন্ন ফরেন অ্যাসেট ব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময় ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের রূপে সরাসরি ভারতীয় অর্থনীতিতে এই টাকা বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু, নোটবন্দির প্রভাব সরাসরি পড়েছিল ভারতীয় অর্থনীতি এবং ভারতীয় টাকার ওপর, যেখানে কালো টাকা ভারতীয় টাকা হিসেবে স্টোর করাই হয় না। ফলে, কোনও লাভই হলো না নোটবন্দির ফলে।
নোটবন্দির সিদ্ধান্তের ৬ বছর পর এখন ভারত সরকারও এই সিদ্ধান্তকে ভুল বলে মেনে নিয়েছে। তার প্রমাণ, প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির ৬ বছরের গুড শিটে কোথাও নোটবন্দির চিহ্নমাত্র নেই। অনেকে বলেন, নোটবন্দির জন্যই নাকি ভারতে অনলাইন পেমেন্ট এবং অনলাইন ট্রানজাকশন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে, এটা আসল বিষয় না। আসলে, নোটবন্দির আগে থেকেই ভারতে অনলাইন পেমেন্ট কাজ করত। সেক্ষেত্রে হয়তো ইউপিআই-এর কোনও অপশন ছিল না বা সরাসরি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে অনলাইন পেমেন্ট কেউ করত না। কিন্তু সেসময়েই পেটিএম-এর মতো কিছু মোবাইল ওয়ালেটের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। এছাড়াও প্রতিটি কোম্পানি তাদের অফিসিয়াল অ্যাপে একটি করে মোবাইল ওয়ালেট যুক্ত করত। ফলে সেইভাবেও অনলাইন পেমেন্ট ব্যবহার করা যেত।
পাশাপাশি যখন ইউপিআই মাথাচাড়া দিতে শুরু করে, তখন গুগল পে কিংবা ফোন পে বা অ্যামাজন পে-র মতো প্ল্যাটফর্ম ক্যাশব্যাক দেওয়া শুরু করেছিল। অর্থাৎ, তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে পেমেন্ট করলে কিছু ক্যাশব্যাক ব্যবহারকারীরা পাবেন। এই বিষয়টাও অনলাইন পেমেন্টের বৃদ্ধির একটা বড় কারণ ছিল। তবে অনলাইন পেমেন্টের কারণে যে শুধুমাত্র ভালো হয়েছে, তা বলা যাবে না। আর্থিক দুর্নীতি এবং টাকা আটকে যাওয়ার ঘটনা এই অনলাইন পেমেন্টের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। আমেরিকার মতো দেশ অনলাইন পেমেন্ট খুব একটা বেশি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয় ঠিক এই কারণের জন্যই। অনেক দোকানদার এখন অনলাইন পেমেন্ট নিতে চাইছেন না কারণ, এই অনলাইনের মাধ্যমে অনেককেই সহজে ঠকানো সম্ভব। আর ভারতের মানুষ যে অনলাইন পেমেন্টের ওপর ভরসা কিছুটা হলেও ত্যাগ করতে শুরু করেছেন, এটা ভারতের বর্তমান ক্যাশের পরিমাণ থেকেই স্পষ্ট। তাই, মোদি সরকার ও বিজেপি যে কারণেই নোটবন্দি করুক না কেন, এই সিদ্ধান্ত প্রথম থেকেই ছিল ভ্রান্ত ধারণার ওপর নির্ভরশীল। ফলে নোটবন্দির সিদ্ধান্তের ব্যর্থতা সামনে আসতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি।