তথ্যের মালিকানা ও পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রতি বছর আলাদা মাত্রা নিচ্ছে। দক্ষিণ চিন সাগরে মার্কিন রণতরীর ঘোরাফেরা চর্চার নতুন কোন বিষয় নয়। এত অত্যাধুনিক সামরিক প্রস্তুতির পরেও দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্যতম প্রধান কারণ তথ্যের মালিকানা।
ঊনবিংশ শতকে কোন দেশের শক্তি বিচার করা হতো সেই দেশের কাছে থাকা কয়লা ও স্টিলের পরিমাণের নিরিখে। বিংশ শতকে কোন দেশের শক্তি বিচারের মাপকাঠি ছিল সেই দেশে থাকা খনিজ তেল ও জ্বালানীর ভাণ্ডার। তবে একবিংশ শতকে চিত্রটা বদলেছে। এই মুহূর্তে যে দেশের কাছে যত বেশি তথ্য থাকবে সামরিক ক্ষেত্রেও ততটাই এগিয়ে থাকবে সেই দেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ৫জি প্রযুক্তিতে যে দেশ এগিয়ে থাকতে পারবে শতাব্দীর বাকি সময় বিশ্ব শাসন করবে তারাই। আর এই কারণেই চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলি ক্রমশ তথ্য পাওয়ার জন্য আরও বেশি মরিয়া হয়ে উঠছে। তবে শুধু অন্য দেশের তথ্য নিজের ভাড়ারে নেওয়ার জন্য করসত ছাড়াও নিজের দেশের তথ্য যেন অন্য দেশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে পৌঁছে না যায় সেই জন্যেও সতর্ক হচ্ছে বিশ্বের তাবড় দেশগুলি।
চলতি বছরে চিনের ক্যাব শেয়ারিং অ্যাপ ডিডি নিউ ইয়র্ক শেয়ার বাজারে ট্রেডিং শুরু করে। এর পরেই চিনের প্রশাসন ও সরকারি সুরক্ষা সংস্থা ডিডি অফিসে হানা দেয়। চিনে প্রায় 38 কোটি গ্রাহক এই ক্যাব সার্ভিস ব্যবহার করেন। এছাড়াও প্রায় দেড় কোটি ড্রাইভার এই অ্যাপের অধীনে ক্যাব চালান। এই সব চিনা নাগরিকদের নাম, ফোন নম্বর, লোকেশন ও অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য ডিডি সার্ভারে গচ্ছিত রয়েছে। লগ্নিকারীদের খুশি করতে এই তথ্য কোনভাবে মার্কিন প্রশাসনের হাতে পৌঁছলে সমস্যায় পড়তে পারে চিন। ডিডি সার্ভারের তথ্য বিদেশি সরকারের হাতে পৌঁছনো রুখতে তৎপর হয়েছিল চিন সরকার। একই কারণেই চিনের বাইরে ব্যবসা করার সময় বারবার সরকারি বাঁধার সামনে পড়তে হয়েছে সেই দেশের বিভিন্ন কোম্পানিকে। তবে চিন সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে ডিডি গ্রাহকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তথ্য নিয়ে চিন যে কাজ করছে সেই কাজ যেন কোন প্রতিযোগী দেশ করতে না পারে সেই বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে প্রতিবেশী দেশটি।
তবে চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তথ্যের এই যুদ্ধ নতুন নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের টিকটক ও হুয়ায়েইয়ের মতো চিনা কোম্পানিকে আগেই মার্কিন মুলুক নিষিদ্ধ করেছিল। ৫জি প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বেশি করে শুরু হলে তথ্যের পরিমাণ এক লাফে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। নতুন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তিতে এক বর্গ মাইলে ৩০ লক্ষের বেশি কানেকটেড ডিভাইস থাকবে। ৪জি জামানায় এই সংখ্যা ছিল ১০,০০০।
৪জি নেটওয়ার্ক তৈরির যন্ত্রাংশের জন্য বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল চিনের কোম্পানি হুয়ায়েই। ৫জি নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে চিনের কোম্পানির আধিপত্য খর্ব করতে মরিয়া ছিল মার্কিন প্রশাসন। নিজের দেশের নেটওয়ার্ক ডেটা অন্য দেশের হাতে যাওয়া বন্ধ করতেই ট্রাম্প প্রশাসন হুয়ায়েইকে নিষিদ্ধ করেছিল বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
একবিংশ শতকে যে দেশের কাছে যত বেশি তথ্য থাকবে সামরিক সমরে তত এগিয়ে থাকবে সেই দেশ। তথ্য মানে শুধুমাত্র নাগরিকদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর নয়, গোটা দিনে কয়েকশো কোটি মানুষ কী করছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন, কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, এইসব তথ্যকে একত্রিত করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে একটি প্রবণতা খোঁজার চেষ্টা চলে।
প্রত্যেকবার পকেট থেকে স্মার্টফোন বার করে তা আনলক করলে আপনি নতুন কোন তথ্য তৈরি করে ফেলছেন। ফোনে করে কোন অ্যাপ কত সময় ব্যবহার করছেন, কোন অ্যাপে কী করছেন এই সবই নতুন তথ্য তৈরি করছে। এই রকম কয়েকশো কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের তথ্য সংগ্রহ করে চলছে বিশ্লেষণের কাজ। আর এই বিপুল পরিমাণ তথ্য যে কোন দেশের সুরক্ষাকে প্রশ্নচিহ্নর সামনে ঠেলে দিচ্ছে।
যেমন ধরুন, আপনি কোন অ্যাপ থেকে রাতে বিরিয়ানি অর্ডার করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সামান্য তথ্য নিয়ে কোন দেশ কীভাবে আপনার দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে অন্য কোন দেশ? কিন্তু এই তথ্যকে যখন কয়েকশো কোটি পৃথক ডেটার সঙ্গে পাশাপাশি রেখে বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্স প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে সেই তথ্য থেকে প্রবণতা খুঁজে নিয়ে ভবিষ্যতে কী হতে পারে তা অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে। তাই আপনি যখন বিরিয়ানি অর্ডার করছেন একই সময়ে আপনার শহরের, রাজ্যের অথবা দেশের সহ নাগরিকরা কী করছেন তা জেনে বিভিন্ন মডেল তৈরি করছেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং। সাধারণ মানুষের থেকেও সরকারি কর্মচারী, সেনা, গোয়েন্দাদের ব্যক্তিগত তথ্য বেশি সংবেদনশীল। যা সংগ্রহ করে শত্রু দেশ কৌশলগত ছবির ধারনা পেতে পারে। এক কথায় এই সব তথ্য একটি বিশাল পাজেলের ছোট ছোট টুকরো। প্রত্যেকটি অংশ যুক্ত হলেই সম্পূর্ণ ছবি দেখা সম্ভব। আর এই কাজে দিন রাত এক করে দিচ্ছে বিশ্বের তাবড় দেশগুলির গোয়েন্দা ও সামরিক কৌশলবিদরা। বাটারফ্লাই এফেক্ট যেমন গোটা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিতে পারে ঠিক তেমনই যে কোন ছোট তথ্য গোটা দেশের সুরক্ষাাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
প্রতি মুহূর্তে তৈরি হওয়া এই বিপুল পরিমাণ তথ্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখনও বিশ্বের অনেক দেশেই কোন আইন আসেনি। আর তাই যে সব কোম্পানি ও অ্যাপের কাছে কয়েকশো গ্রাহকের তথ্য রয়েছে সেই তথ্য তারা কার কাছে কীভাবে বিক্রি করছে সেই বিষয়েও ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। যা যে কোন দেশের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষাকে বড়সড় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
চলতি বছরেই ভবিষ্যৎ অনুমান করার যন্ত্র নিয়ে আসার দাবি করেছিল মার্কিন সেনা। তথ্য, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে এই কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিল মার্কিন সেনা। গোটা বিশ্বের কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণ করে এই কাজ চলছে। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করে কোথায়, কখন আমন্ত্রণ হতে পারে সেই বিষয়ে কয়েকদিন আগেই সেনাকে সতর্ক করতে পারে নতুন এই প্রযুক্তি। মার্কিন সেনার এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “কোন শত্রু দেশের বন্দর থেকে ডুবোজাহাজ রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেই কোথায় আক্রমণ হবে তা অনুমান করতে পারবে এই প্রযুক্তি।” আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের মাধ্যমে এই কাজ করা সম্ভব হয়েছে। যা যুদ্ধের সময় যে কোন দেশকে শত্রুদের থেকে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করবে।
এদিকে ইতিমধ্যেই চিনে শুরু হয়েছে সোশ্যাল স্কোরিং সিস্টেম। সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের প্রতিদিনের বিভিন্ন ধরনের আচরণের উপর নির্ভর করে একটি নম্বর দেওয়া হচ্ছে প্রত্যেককে। আচরণের উপরে নির্ভর করে নিয়মিত আপডেট হচ্ছে এই নম্বর। যার কাছে যত বেশি নম্বর থাকবে সামাজিক ক্ষেত্রে সেই নাগরিক ততটাই এগিয়ে থাকবে। অগ্রাধিকার পাবেন সরকারি সুবিধাতেও। আর এই গোটা প্রযুক্তি চলছে তথ্যের মাধ্যমে। একই সঙ্গে সেই দেশে ফেস রিকগনিশন সিস্টেম বহুল প্রচলিত। যে কোন সুরক্ষা ক্যামেরায় তোলা ছবি থেকে প্রত্যেক নাগরিকের সোশ্যাল স্কোর রিয়েল টাইমে দেখে নিতে পারেন সেই দেশের প্রশাসন ও গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন গোটা বিশ্বে একই ধরনের সিস্টেম চালু করতে মরিয়া চিন।
আর এই বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণে বড় ভূমিকা নিতে চলেছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। অত্যাধুনিক এই কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে যে দেশ যত এগিয়ে থাকবে সেই দেশ তথ্য দ্রুত আরও বেশি তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারবে। আর যে দেশ যত বেশি তথ্য দ্রুত বিশ্লেষ করতে পারবে সেই দেশ তত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর এই যুদ্ধে বিজয়ীরাই একবিংশ শতকে বিশ্ব শাসন করবে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যুদ্ধবিমান ও বিমানবাহী জাহাজ নয়, তথ্যের মাধ্যমেই শুরু হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।