"থিও ভ্যান গঘ: ১৮৫৭-১৮৯১" - অচেনা বই, অচিন এক জীবনের খোঁজ
Theo Van Gogh Anirban Roy Book Review : বাংলায় ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে বহু লেখা হলেও থিও-র জীবন নিয়ে কোনও এই প্রথম লেখা হলো।
ইদানিং কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলমেন্ট কথাটা বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে উঠেছে - হয়তো নোবেল লাভের ঘটনা থেকে। সে হোক ভালোই, আরও বেশি করে আলোচিত হোক এটি। তবে এই বই পড়তে পড়তে এনট্যাঙ্গেলমেন্টের ছোঁয়া মনে করিয়ে দিল। পরতে পরতে, এ এক বাস্তব জীবনের এনট্যাঙ্গেলমেন্টের গল্প।
বইয়ের নাম ‘থিও ভ্যান গঘ: ১৮৫৭ – ১৮৯১’ , লেখক অনির্বাণ রায়। কে এই থিও, কেন এই থিও? বিখ্যাত ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ভাই এই থিও। অজস্র চিঠি সারাজীবনে লিখেছেন ভিনসেন্ট, তার ভাই থিও-কে। 'ডিয়ার থিও' নামের সেই সংকলন এখন বিখ্যাত, বহুল বিক্রিত। ভ্যান গঘকে নিয়ে জানা, পড়া, গবেষণা সমস্ত কিছুর মূলেই এই চিঠি। এখান থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভ্যান গঘ গবেষক, বিশেষজ্ঞরা তার জীবনী, চলচ্চিত্র রচনা করেছেন। কিন্তু এই থিওর জীবনী? কেমন ছিল তাঁর জীবন, আর কেনই বা এই এনট্যাঙ্গেলমেন্ট! থিও ছাড়া ভিনসেন্ট অসম্পূর্ণ; আবার ভিনসেন্ট ছাড়া থিও-ও অসম্পূর্ণ।
১৮৫৭ তে জন্ম থিও ভ্যান গঘের। ভিনসেন্টের থেকে চার বছরের ছোটো, প্রথাগত স্কুলের শিক্ষা ছিল না। ভালো স্বাস্থ্যও ছিল না তাঁর। ১৮৭৩-এ কাকার সুপারিশে চাকরি পান ব্রাসেলসের গুপিল অ্যান্ড সি কোম্পানিতে, যা ছিল ছবি কেনা-বেচার দোকান। কাজ ছিল ছবি মোড়া, ছবি ক্যাটালগ তৈরি করা, প্রকাশকদের ক্যাটালগ থেকে ছবির প্রতিলিপি পাঠানো। এই কাজের সুবাদে সমকালীন বিভিন্ন শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ হয়ে গেল। তখনই ছবিকে চিনতে বুঝতে শিখলেন। পরবর্তীকালে বহুবার তিনি ভিনসেন্টকে ছবি নিয়ে নিজের মতামত জানাচ্ছেন। এই চাকরি থেকেই দিনের পর দিন দাদাকে পাঠাচ্ছেন টাকা, ছবি কেনার সরঞ্জাম। দাদাকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন ছবি আঁকতে। জার্মানির হেগ থেকে গুপিলের বিদেশি শাখায় কাজ করার জন্য প্যারিসে গেলেন, আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে গুপিলকে সাহায্য করার সূত্রে ছবি কেনাবেচা সম্পর্কে ভালোরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এলেন। গুপিলের বুলেভার্ড মঁমার্ত শাখায় থিও ম্যানেজার হয়ে উঠলেন। ভিনসেন্টের হাতখরচ তিনিই চালাবেন বলে বাবাকে জানালেন - দাদা শুধু সৃষ্টিতে মগ্ন থাক এই তাঁর উদ্দেশ্য। দাদার কোনও কাজ করার দরকার নেই, শুধু ছবি আঁকা ছাড়া।
বাড়িতে সেই নিয়ে মনোমালিন্য হলেও সব সামলে রাখতেন থিও, দাদাকেও ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। দু'তিনজন মহিলার সঙ্গে প্রণয় ব্যর্থ হয় তাঁর। শেষে জো বোঙ্গারকে বিয়ে করে থিও কিছুটা থিতু হলেন। কিনতে থাকেন বেশকিছু আর্টিস্টদের ছবি - মানে, পিসারো, রেনয়া, তুলুজ লোত্রেক, সুরা, দেগা, সিসিলি এদেরো। পল গগাঁর সঙ্গেও আলাপ হয়। পরে এই গগাঁকে ভিনসেন্টের কাছে থাকতে পাঠান, তাঁর একাকীত্ব দূর করার কথা ভেবে। যতবার ভিনসেন্টের অসুস্থতার খবর পেয়েছেন, ডাক্তারের ব্যবস্থা করা, স্যানেটোরিয়ামে রাখা, ওষুধপত্রের খরচ পাঠানো সব করেছেন থিও। অধীর আগ্রহে সুস্থতার প্রতীক্ষা করেছেন আর রং-তুলি-ক্যানভাস পাঠিয়ে দাদার সৃষ্টিকে অব্যাহত রাখেন। নিজের ছেলে হলে তাঁর নামও রাখেন দাদার নামের সঙ্গে মিলিয়ে - ভিনসেন্ট ভিলেম।
কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে ঝগড়া, মাইনে কম সব লেগেই আছে। সংসার চালানোও বেশ অসম্ভব হয়ে উঠছে। নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য না রাখলেও দাদার জন্য ভাবনার অন্ত নেই থিও-র। সব সাহায্য করেই চলেছেন তিনি। লিখে চলেছেন চিঠির পর চিঠি, "আশা করি যতটা পারি তোমাকে সাহায্য করতে পারব, যতদিন না তুমি নিজে কিছু উপার্জন করো।"
"প্রিয় জো-এর সঙ্গে আমার সুখের দিন ঘনিয়ে আসছে সম্ভবত। তোমার সত্যি খুব বাজে দিন আসছে। ওর একটা বিভ্রান্তি ছিল যে, সে যথসাধ্য বেশি করে আমার জীবনের অংশ হতে চায়। তুমি তাঁরও একজন ভাই হয়ে উঠবে, যেমন তুমি আমার ভাই হয়ে আছো। অন্তরের অন্তস্থঃল থেকে বিশ্বাস করি যে, তুমি স্বাস্থ্য ফিরে পাবে। আবার কাজ শুরু করবে।"
"পরের চিঠিতে জানাও কেমন জায়গায় আছো? কেমন যত্নআত্তি পাচ্ছ, খাওয়াদাওয়া কি যথেষ্ট হচ্ছে? যাদের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে সেই লোকগুলো কেমন? মোটের উপর, নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলো না। বরং এখন চেষ্টা করো যাতে সেই শক্তি ফিরে পেতে পারো।"
"রাহাখরচ হিসেবে ১৫০ ফ্রাঁ পাঠালাম, যদি কম মনে হয় আমাকে জানিও।"
"যে রংগুলো পাঠাতে বলেছিলে টাসেট আজ সেগুলো পাঠিয়ে দেবে। তাঁগি সেদিন আমাকে বলেছিল টাসেটের টিউবগুলো অনেকটাই ছোটো, তাতে রং কম থাকে। যদি তাই হয় আমাকে বলো, আমি দাম কমানোর ব্যবস্থা করতে পারি। তোমার আসবাবপত্র এসে গেলে অনেকটাই শান্তি পাবে, তাহলে তোমার সঙ্গে থাকার জন্য একজন ডাচ সহকর্মীকে খুঁজে নিতে পারবে হয়তো।"
"চিঠির সঙ্গে ৫০ ফ্রাঁ পাঠালাম..."
এরকম অজস্র অজস্র ভালোবাসার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে ভিনসেন্টকে লেখা থিওর চিঠিতে। যা থেকে ভালোবাসার এনট্যাঙ্গেলমেন্ট বুঝতে অসুবিধা হয় না। কর্মক্ষেত্রে বিবাদ, নিরন্তর অর্থচিন্তা , ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার গুজবের মধ্যেও দাদার বুকে গুলি করার খবর শুনে সব ফেলে থিও ছুটলেন অভার্সে। গিয়ে দেখলেন বিপদ কাটেনি। একদিন পরে ২৯ জুলাই, ১৮৯০ সালে ভিনসেন্ট চলে গেলেন চিরতরে। কবরস্থিত করে থিও জো-কে লিখলেন, "I miss him so, it is as if everything reminds me of him."
ভিনসেন্টের চলে যাওয়ার ধাক্কা সামলাতে পারলেন না থিও। ভেঙে পড়ল তাঁর শরীর, ওষুধ নিলেন না, এদিকে কাশি বেড়েই চলল। ঘটলো মানসিক বিপর্যয় - dementia paralytica, সিফিলিসের শেষ অবস্থা। হাসপাতালে ভর্তির সময় চিনতে পারলেন না নিজের স্ত্রী জো-কেও। মাত্র ৩৩ বছর বয়েসে ২৫ জানুয়ারি ১৮৯১-এ থিওর জীবনাবসান হলো।
বাংলায় ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে বহু লেখা, ভাই থিও-কে লেখা চিঠির অনুবাদ হলেও থিওর জীবন নিয়ে কোনও এই প্রথম লেখা হলো। সঙ্গে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে থিও-র লেখা ৪৭টি চিঠি এই বইয়ের অমূল্য সম্ভার। এই বই চিনিয়ে দেয়, দাদার প্রতি ভালোবাসা কোন স্তরে গেলে সেই দাদা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ হয়ে ওথেন। “শেষ চিঠিতে তুমি লিখেছিলে যে, অনেকগুলো কারণে আমরা ভাই। আমিও তাই মনে করি। আমার হৃদয় তোমার মতো ততটা সংবেদনশীল নাও হতে পারে। কখনও কখনও কল্পনা করে নিতে পারি কী দুর্দশার মধ্যে দিয়ে তুমি যাচ্ছ। কারণ, অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হয়নি এখনও। নিরাশ হয়ো না, মনে রাখবে তোমাকে কী পরিমাণে চাই।" এই হলো থিও, এক পরিপূরক সমান্তরাল জীবনের ভিনসেন্ট যা বাংলায় ভ্যান গঘ চর্চার অগ্রপথিক। সামান্য কিছু মুদ্রণপ্রমাদ চোখকে পীড়া দিলেও এই বই সঙ্গী হয়ে ওঠে ভ্যান গঘ চর্চার এনট্যাঙ্গেলমেন্ট হিসেবে।
থিও ভ্যান গঘ: ১৮৫৭ – ১৮৯১
অনির্বান রায়
উড়োপত্র, প্রকাশ- ২০২২
দাম ২৫০ টাকা
ISBN 978-81-954086-7-2