টাইটানিকের শুটিংয়ে খাবারে মেশানো হয়েছিল বিষ, মৃত্যু হতে পারত কেট উইন্সলেটের

টাইটানিক সিনেমার সাফল্যের নানা কারণ থাকলেও আসল চাবিকাঠি ছিল জ্যাক ও রোজের চরিত্রে অভিনীত লিওনার্দো ডি-ক্যাপরিওর এবং কেট উইন্সলেটের অভিনয়।

চলচ্ছিত্রের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে খোদাই করা আছে যে সিনেমার নাম-তা টাইটানিক। ১৯৯৭ সালে ডিসেম্বরে মুক্তি পায় এই সিনেমা। অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ববাসীর মণিকোঠায় স্থান দখল করে নেয়। 20th Fox Century-র প্রযোজনা ও পরিচালক জেমস ক্যামেরন নির্মিত এই সিনেমা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম বক্স অফিসে ২ বিলিয়নের বেশি গণ্ডি অতিক্রম করার সাথে সাথে ইতিহাস রচনা করে। আজকের এই বদলে যাওয়া বিশ্বে, এত বিখ্যাত বিখ্যাত সিনেমার ভিড়ের মাঝেও দর্শকদের কাছে টাইটানিক আজও দর্শকের পছন্দের তালিকায় রেখেছে। সিনেমাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নস্টালজিয়া, আছে জ্যাক-রোজের প্রেমের করুণ পরিণতি, আর ভয়াবহ দুর্যোগের আখ্যান। পর্দার গল্প যতটা রোমহর্ষক, ভয়াবহ, বেদনাদায়ক ও প্রেমময়, এই সিনেমাকে পর্দায় প্রকাশ করার পিছনের গল্পও কিন্তু ঠিক ততটাই ভয়াবহ।

টাইটানিক সিনেমার সাফল্যের পিছনে অনেক উপাদান থাকলেও তার মধ্যে বিশেষ চাবিকাঠি ছিল জ্যাক ও রোজের চরিত্রে অভিনীত লিওনার্দো ডি-ক্যাপরিওর এবং কেট উইন্সলেটের অভিনয়। লিওনার্দো তখন যুবক, তার সুদর্শন, ছিপছিপে পাতলা গড়ন, ও অভিনয়ের দক্ষতা হাজার নারীর মনে ঝড় তুলেছিল। সিনেমার হিরোর জন্য প্রায় একশো জন হিরোকে পছন্দের তালিকায় রেখেছিলেন ক্যামেরন। ব্র্যাড পিট, টম ক্রুস, জনি ডেপ প্রমুখ বিখ্যাত তারকারা কিন্তু পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিল রিভার ফিনিক্স। সিনেমা তৈরির আগেই ফিনিক্সের মৃত্যু ঘটায় জ্যাকের চরিত্র শেষ পর্যন্ত পান লিওনার্দো। পিছিয়ে ছিলেন না অভিনেত্রী কেট উইন্সলেটও, তাঁর লাবণ্যময়ী রূপ আগুন ধরিয়েছিল সেটে। রোজের চরিত্রে অভিনয় করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

ক্যামেরন বলেন কেট নাকি রোজের চরিত্রটি পাওয়ার জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে পরিচালকের সঙ্গে দিনরাত লেগেছিলেন তিনি। ক্যামেরনকে বলেছিলেন রোজের চরিত্রটি নাকি শুধুমাত্র কেটের জন্যই তৈরি, অন্য কেউ এই চরিত্রকে তাঁর মতন করে ফোটাতে অক্ষম। কেটের এই আবেদন ফেলতে পারেননি পরিচালক বা বলা ভালো কেটই তাকে মুখ ফেরাতে দেননি, তবে চরিত্র ছিনিয়ে তিনি যে পরিচালককে হতাশ করেননি তা বলার অপেক্ষা রাখেন না পর্দার রোজ।

টাইটানিক সিনেমার মূল ভিত্তি কিন্তু পরিচালক জেমস ক্যামেরন। হিরো হিরোইন যতই ভালো অভিনয় করুক না কেন, একটা সিনেমার প্রধান সাফল্য কিন্তু নির্ভর করে প্লটের বুননে, ও সিনেমা তৈরির উপাদানের উপরে আর এই উপাদান যোগানে ও গল্পের বুননে কোনও ফাঁক রাখেননি পরিচালক। ক্যামেরন ছবিটি নির্মাণের পুর্বে ডুবন্ত জাহাজের ভিতরে প্রায় বারো বার ঘুরে আসেন। প্রতিবার নাকি প্রায় ১৬ ঘণ্টার মতো তিনি সেখানে থেকে জাহাজকে ভালো করে নিরীক্ষণ করেন, যাতে গল্পে উনি আসল টাইটানিককে তুলে ধরতে পারেন। ভাবা যায়? এখানেই কিন্তু শেষ নয়, এখনো অনেক চমক বাকি।

ছবি নির্মাণের জন্যও ক্যামেরন যে জাহাজের মিনিয়েচার মডেল তৈরি করেন তা মেক্সিকোর প্লায়াস দি রিসারতো-তে প্রায় চিল্লিশ একর সাইজের জলাধারের উপর রাখা হয়েছিল। প্রায় সতেরো মিলিয়ন জল লেগেছিল পুরো সিনেমাটি শুটিং করতে। জাহাজের সামনের দিককে এমনভাবে বানানো হয়েছিল যা প্রায় নব্বই ডিগ্রি উপর নীচ করতে পারত, যার ব্যাবহার আমারা ক্লাইম্যাক্সে জাহাজ ডোবার সিনে দেখতে পাই। ক্যামেরন ছোটখাটো বিষয়েও এতটা নজর দিয়েছিল যে আসল টাইটানিকের মতো হুবহু একই কার্পেট, ডাইনিং রুম, ঝাড়লণ্ঠন, কাপপ্লেটের যোগার করেছিলেন তিনি। এতটা নিখুঁতভাবে ছবিটি বানাতে গিয়ে প্রায় দুশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচা হয়। ক্যামেরনের পরিশ্রমের ব্যাপকতা দেখেই বোঝা যায় কতটা মন-প্রান
ঢেলে তিনি আজ এই সিনেমা নির্মান করেছিলেন!

ছবি নির্মানের সময় ক্যামেরন এতটাই সতর্ক ছিলেন যে কোনও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সহ্য করতে পারতেন না। ফলে টিমের বাকি সবাইকেকাজে কোনও ভুল হলে যথেষ্ট বকা খেতে হত। তিনি এতটাই হম্বিতম্বি করতেন যে কেউ একবার নাকি রাগ করে পুরো টিমের খাবারে ড্রাগ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় আশিজন খাবার খাওয়ার পরেই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন ও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ক্যামেরনও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ভাগ্যবশত কারোর প্রান হানি হয়নি। কে এই ঘটনা ঘটিয়েছিল তা আজ অবধি যানা যায়নি।

ক্যামেরন আসল টাইটানিকে সওয়ার হওয়া দশজন চরিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন ছবি ও সংবাদপত্র থেকে জানতে পারেন ও সিনেমাতে তাদের আদলে চরিত্র ব্যাবহার করেন। এছারাও সিনেমাতে দেখান সেই বৃদ্ধ দম্পতির কথা মনে আছে? যারা বিছানায় শুয়ে মৃত্যু বরণ করেন! এই চরিত্রদ্বয় কিন্তু একদমই কাল্পনিক ছিল না। বাস্তব জাহাজেও এরম দম্পতি ছিলেন নাম ছিল- ইডা ও ইসডেওর স্ত্রেয়াস যারা নিয়ু ইয়র্কের মেসাস ষ্টোরের মালিক ও মালকিন ছিলেন ও দুর্ঘটনায় মারা যান।

এবার আসা যাক টাইটানিকের বহু চর্চিত দৃশ্য সেই ন্যুড পয়েন্টিঙের সিনে। ছবিতে দেখা যায় জ্যাক রোজের স্কেচ আঁকছে, কিন্তু সিনে দেখানো হাতটি আসলে ছিল পরিচালক জেমস ক্যামেরনের এবং বাকি স্কেচগুলোও তাঁর নিজের আঁকা। স্কেচের এই সিনটাই ছিল টাইটানিকের শুটিং করা প্রথম দৃশ্য কারণ জাহাজের বাকি কাজ তখনও সম্পূর্ন হয়নি। এই শুটিং-এর আর একটি মজার ব্যাপার ঘটেছিল, রোজ জ্যাকের সামনে কাপড় জড়িয়ে এসে দাঁড়ালে জ্যাকের বলার কথা ছিল ‘লাই অন কাউচ’ কিন্তু লিওনার্দো ঘাবড়ে বলে বসেন ‘হভার অন আ বেড, দ্য কাউচ, পরিচালকের এই ডায়ালগটি এতই পছন্দ হয় যে তিনি আর চেঞ্জ করেননি। এমনকি জ্যাকের বলা সেই বিখ্যাত ডায়ালগ ‘আই এম দ্য কিং অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’-ও লিওনার্দোর নিজের সৃষ্টি।

এই ছবিতে ক্যামেরন কোনও গান ব্যাবহার করতে চাননি কিন্তু সিনেমার কম্পোসার জেমস হরনার ও গায়িকা সেলিন ডিওন পরিচালককে লুকিয়ে মাই হার্ট উইল গো অন গানটি তৈরি করেন ও ক্যামেরনকে শোনান। গানটি ক্যামেরনের এতই পছন্দ হয় যে তিনি গানটি সিনেমাতে ব্যাবহার করতে রাজি হয়ে যান ও এই গানের জন্যই সিনেমাটি বেস্ট অরিজিনাল সঙ্গের অস্কার এওয়ারর্ড পায়। আছে আর নানান বিস্ফারিত ঘটনা যেমন জাহাজ ডোবার দৃশ্যে অভিনয় করার সময় কেটের জীবন সংশয় দেখা যায়, কেট নাকি প্রায় ডুবতে বসেছিল ভাগ্য ক্রমে টিমের তৎপরতায় বেঁচে যায়।

অতক্ষণ জলে শুটিং-এর জন্য নায়িকার নিউমোনিয়া পর্যন্ত দেখা দেয়, বাকি টিমের মেম্বারদেরও ফ্লু, কিডনির সমস্যা ও ইনফেকশন দেখা দিয়েছিল। এর থেকেই বোঝা যায় কতটা প্রান হাতে করে সবাই কাজ করেছিল যার ফলে আজও এই মাস্টারপিসকে কেউ টেক্কা দিতে পারেননি।

টাইটানিক ডোবার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় সাতটি ছোটবড় চলচ্ছিত্র নির্মান হয়েছে কিন্তু জেমেস ক্যামেরনের টাইটানিককে আজ পর্যন্ত কেউ টপকাতে পারেননি। স্ক্রিনে এই চলচ্চিত্র ঠিক যতটাই দর্শককে কাঁদিয়েছে, উত্তেজনা দিয়েছে পর্দায় পেছনে ঠিক ততটাই জীবন হাতে করে রক্ত জল করে খেটেছেন টাইটানিক সিনেমার পুরো টিম বিশেষ করে পরিচালক জেমস ক্যামেরন, আর এত নিবেদিতভাবে কাজ করার ফসলই এই সিনেমার মাইলস্টোন রচনা। দর্শকরা সিনেমা
দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন, ভাবেন কলা কুশলীরাই বুঝি প্রধান জাদুকর, কিন্তু সিনেমা তৈরির নেপথ্যে যে মানুষগুলো থাকে তারাই হলেন মুখ্য কলাকুশলী বা বলা ভালো বাজিকর।

More Articles