কাঠফাটা গরমে দু'দণ্ড শান্তির জন্য চেখে দেখতেই হবে এই আমগুলো

তবু যেটুকু বাকি রয়েছে, তাতেই মন ভরায় বাঙালি। বর্তমানে আলফানসো জাতীয় আম বাংলাতেও চাষ হচ্ছে।

গরম পড়ে গিয়েছে জোরকদমে। গাছ ভর্তি আম এখন পাকার সময়। কালবৈশাখীর প্রকোপ তুলনামূলকভাবে এই বছর অনেকটাই কম, ফলে চৈত্রের মুকুল ঝরে যায়নি খুব একটা। গ্রীষ্মের এই প্রচণ্ড দাবদাহে আম খেয়ে তৃপ্তি পায় বাঙালি। কখনও আমপোড়ার সরবৎ, কখনো কাঁচা আম মাখা– শুনেই জিভে জল আসে। আর পাকা আমের মতো উপাদেয় ফল আর কী আছে! সেই কারণেই আম ভারতের জাতীয় ফল, বাংলাদেশের জাতীয় গাছ আমগাছ। পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে কাগজে মোড়া ঠেলা সাজিয়ে আমবিক্রেতারা বিক্রি করবেন আম। সেই আম দর করে ঘরে তুলবেন ক্রেতা। এই দৃশ্য যে কত পুরনো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত সেই নবাবি আমল থেকেই বাংলার আমের সুখ্যাতি রয়েছে। আম খেয়ে হুমায়ুন তো মালদার নামই দিয়ে ফেলেছিলেন ‘জান্নতাবাদ’। মখসুদাবাদ যে নবাবের নামে মুর্শিদাবাদ হল, মুর্শিদকুলি খাঁ, তিনিই বাংলায় নবাবি ধাঁচে আমচাষ শুরু করেন। নানা জাতের সংকর আম তৈরি হয় দক্ষিণ মালদা ও মুর্শিদাবাদের সেই বিরাট বিরাট আমবাগানগুলিতে। নতুন নতুন আম তৈরি হয়েছে অবশ্য মালিদের হাতে। কিন্তু তাঁদের নাম আজ আর জানার উপায় নেই। নবাবদের মনপসন্দ সেইসব নানা জাতের আম ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ আমলে। তবু যেটুকু বাকি রয়েছে, তাতেই মন ভরায় বাঙালি। বর্তমানে আলফানসো জাতীয় আম বাংলাতেও চাষ হচ্ছে। তেমনই কয়েকটি কম পরিচিত আম নিয়ে এই লেখা। এই গরমে এই ক'টি আম

চেখে নিতে একেবারেই ভুলবেন না।

আলফানসো

আলফানসো আমের আরেকটি নাম ‘কাকডি হাপুস’। এর অর্থ কাগজের মতো পাতলা খোসা। আলফানসো এই উপমহাদেশের সবথেকে দামি আমগুলির একটি। আলফানসো ডি আলবুকার্ক ছিলেন এক পর্তুগিজ যুদ্ধবিশারদ। তাঁর নামেই আমের নাম রাখা হয় আলফানসো। ভারতে যে সমস্ত অতি উৎকৃষ্ট মানের আম হয়, আলফানসো তার মধ্যে অন্যতম। মূলত মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি আলফানসো উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। বর্তমানে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গেও চাষ হচ্ছে আমটি। এছাড়া মুম্বই, বেঙ্গালুরু প্রভৃতি অঞ্চলেও এর চাষ রয়েছে। এতই এর সুগন্ধ যে, পাকা আলফানসো হাতে রাখলে নাকি হাত পর্যন্ত সুগন্ধি হয়ে যায়। আলফানসো আমের গাছ খুব একটা বড় হয় না। মাঝারি আকৃতির। আমটি গোলাকার। পাকলে সম্পূর্ণ হলুদ হয়ে যায়। শাঁসও হলুদ। কোনও আঁশ না থাকায় বাণিজ্যিক ব্যবহার প্রচুর, অর্থাৎ ম্যাঙ্গো জুস, জ্যাম, জেলি ইত্যাদিতে বহুল পরিমাণে ব্যবহার করা হয় এই আম। বলা হয় রাতে দুর্বল দৃষ্টি, অন্ধত্ব প্রতিরোধে দারুণ কাজে দেয় এই আম। এর কচি পাতার রস দাঁতের ব্যাথা উপশমে সাহায্য করে।

 

আরও পড়ুন: রাবীন্দ্রিক ডায়েট || স্ত্রী ছাড়া কারও হাতের জিলিপি খেতেন না রবীন্দ্রনাথ

বঙ্গানাপল্লি আম

বঙ্গানাপল্লি আমের আরেক নাম বেনিশন। মূলত অন্ধ্রের কারনুল জেলায় বঙ্গানাপল্লি অঞ্চলে আমের এই জাতটি ফলে প্রচুর

ভারতের সর্বমোট আমচাষের যে জমি, তার ৭০ শতাংশ বঙ্গনাপল্লি আমগাছেই দখল করে রেখেছে। প্রথম বঙ্গনাপল্লির আমচাষিরাই এই আমের সঙ্গে মানুষের পরিচয় করান। জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি ২০১৭ সালের ৩ মে, আমটিকে অন্ধপ্রদেশের উদ্যান ফসল হিসেবে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের মর্যাদা দিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের নানান অঞ্চলে বর্তমানে এই আম চাষ করা হয়। আমটি ঠিক গোল নয়, ডিম্বাকৃতি। পাকলে সম্পূর্ণ হলুদ। এটিরও শাঁস সম্পূর্ণ হলুদ। আঁশ কম, স্বাদে অতুলনীয়। আমের সিজনের প্রায় শেষদিকে ওঠে এই আম। বিভিন্ন অঞ্চলে আমটির নাম বিভিন্ন। দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য উত্তর ভারতীয় রাজ্যে এর নাম বেনিশন, চাপ্পাটাই, সফেদা ইত্যাদি। আবার রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মালওয়া, মেবার ও অন্যান্য মধ্যভারতীয় রাজ্যে এর নাম বাদাম আম। বঙ্গনাপল্লির নবাবের নামে এই আমের নাম হয়েছে বেনিশন। অন্ধ্রের বঙ্গানাপল্লি, পান্যম ও নন্দিয়ালে এই আমের চাষ হয় বহুল পরিমাণে। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা এবং রয়ালাসীমা এলাকাতেও প্রচুর চাষ হয়। তেলেঙ্গানার খাম্মাম, মেহবুবনগর, রঙ্গারেড্ডি, মেডক এবং আদিলাবাদ জেলাতেও এই আমের চাষ হয়ে থাকে।

 

 

গিরনারের কেসর আম

গিরনারের কেসর আম মূলত গুজরাতের গিরনার অঞ্চলে পাহাড়ের পাদদেশে পাওয়া যায়। এই আমের শাঁস উজ্জ্বল কমলা। এই রঙেই এর পরিচিতি। সঙ্গে রয়েছে অতুলনীয় স্বাদ। ২০১১ সালে আমটিকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালে এই আমের প্রথম ফলন। বনথালীর জুনাগড়ের উজির সেল ভাই সর্বপ্রথম এই আমটি আবিষ্কার করেন। এরপর গিরনারের পাদদেশ অঞ্চল জুড়ে লাল ডোরি খামারে প্রায় ৭৫টি জোড়কলমের চারা লাগানো হয় এই আমের। শোনা যায়, জুনাগড়ের তৃতীয় নবাব মুহাম্মদ মহাবত খান এর কমলা শাস দেখে একে কেশর আখ্যা দেন। সেই থেকে আমটির নাম কেশর।

 

 

তোতাপুরী আম

দক্ষিণের আরেকটি মজাদার রসালো সুস্বাদু আম হল তোতাপুরী। একে লোকে জিনিমুথি নামেও চেনে। কল্লামাই, কিলি মুকু, গিল্লি, মুক্কু, সন্দেশা— ইত্যাদি নানা নাম প্রচলিত বেঙ্গালুরুতে। বেঙ্গালুরুর বাইরে একে সবাই তোতাপুরী বা ব্যাঙ্গালোরা বলে চেনে। টিয়াপাখির সঙ্গে এই আমের খোসার রঙ এতটাই মেলে, যে তোতাপুরী বলে ডাকা হয় একে। ১৯০১ সালে এই আম ভারত থেকে ফ্লোরিডায় রপ্তানি হয়। বর্তমানে ফ্লোরিডার দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় আম অ্যান্ডারসন ও ব্রুকের জন্ম এই আম থেকেই।

 

More Articles