বিজেপিকে রুখতে কেন কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের বাদ দিয়ে তৈরি হবে তৃতীয় ফ্রন্ট?
Third Front: কংগ্রেসিদের দাদাগিরি মানব না বলে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলি।
ন্যাড়া তো একবারই বেলতলায় যায়! রাজনীতিকরা বোধহয় যান বারবার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের বৈঠকের পর আবার একবার মিডিয়ার মুখরোচক আলোচনায় এসেছে তৃতীয় ফ্রন্ট। অখিলেশের সঙ্গে বৈঠকের পর, মমতা যাবেন ওড়িশা। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা। তারপরে দিল্লিতে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ডাকা বৈঠকেও মমতার থাকার কথা।
এসব তৎপরতার মাঝে তৃতীয় ফ্রন্টের আলো দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেও এরকম উদ্যোগ আমরা দেখেছিলাম। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে মমতার ডাকা সভায় বিরোধী দলের নেতারা বিজেপিকে হারাতে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। সে জোটের নাম হয়েছিল ফেডেরাল ফ্রন্ট। মমতা সেই সময় নিজের রাজ্যে প্রচারে ঝড় তোলার আগেই অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর ডাকে সে রাজ্যে প্রচার করতে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু নির্বাচনের আগেই ফেডেরাল ফ্রন্টের পালে হাওয়া খারাপ বুঝেই যে যার মতো নিজেদের রাজ্যে নিজেদের রাজত্ব বাঁচাতে সেঁধিয়ে গিয়েছিলেন। ফলাফল আমাদের সকলের জানা। বিজেপি বিপুল সংখ্যায় আসন জিতে দ্বিতীয় বারের জন্য দিল্লির তখ্তে আসীন হয়েছিল।
সেই 'বেলতলায়' আবার যাবেন মমতা-অখিলেশেরা? এই তৃতীয় ফ্রন্টের হাওয়া যে আবার উঠেছে, তার মূল মন্ত্র কী কী? এক, বিজেপিকে হারাতে হবে। দুই, কংগ্রেসকে মাথায় রাখা যাবে না।
বিজেপিকে হারাতে হবে তো ঠিক আছে। তার জন্য সর্বভারতীয় জোটের অর্থ হলো, সবাইকে সমানভাবে বিজেপিকে হারাতে একে অপরকে সাহায্য করতে হবে। অর্থাৎ যার যেখানে শক্তি বেশি তাকে সেখানে লড়তে হবে বিজেপির বিরুদ্ধে। একের বিরুদ্ধে এক লড়াই হতে হবে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কতটা রয়েছে? কমিউনিস্ট পার্টিগুলি কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে সেই ফর্মুলায় রাজি হবে? মমতাই কি এই ফর্মুলায় লড়বেন পশ্চিমবঙ্গে? অথবা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে? আম আদমি পার্টি কি পাঞ্জাবে লড়বে এই সূত্র ধরে?
আরও পড়ুন- সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফলাফলের বার্তা: সংখ্যালঘুরা শুধু ভোটব্যাঙ্ক নন
দ্বিতীয় মন্ত্র, কংগ্রেসকে এই জোটে রাখা যাবে না বা জোটের নেতৃত্ব দেওয়া যাবে না। যে দলটি বিজেপির সঙ্গে ১০০-র বেশি আসনে সরাসরি লড়াই করবে, তাকে বিজেপিকে হারানোর জোটে রাখা নিয়ে আপত্তি! এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কংগ্রেসের নেতৃত্ব-হীনতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। তা বলে যেখানে তাদের আগে থেকেই সংগঠন রয়েছে এবং বিজেপির সঙ্গে তারা মৌলিক লড়াই লড়ছে, সেখানে আপ, তৃণমূল গিয়ে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করবে?
গুজরাত, গোয়া, ত্রিপুরায় কী হয়েছে আমরা দেখেছি। আপ এবার ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশেও বিধানসভা নির্বাচন লড়তে চায়। বিজেপিকে হারাতে একজোট হওয়ার চেষ্টা কোথায়? শুধুই মুখে?
এবার জোটের নেতৃত্বের প্রশ্ন। কে নেতৃত্ব দেবেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুপ্ত স্বপ্ন বহুদিনের। ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ঝড়কে রুখে দিয়ে তাঁর জাতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন আরও জোরালো হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়েছে, জাতীয় স্তরে প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ের প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদি অনেক এগিয়ে। ধারে কাছে কেউ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মোদির নয়, লড়াই আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের।
আপ প্রধানের জাতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্নও নতুন নয়। পাঞ্জাবে একক ভাবে সরকার গড়ে সেই স্বপ্নে বান এসেছে। ওদিকে তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও জাতীয় স্তরে নিজেকে তুলে ধরতে নিজের দলের নামই বদলে দিয়েছেন, তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি হয়ে গেছে ভারত রাষ্ট্র সমিতি। জেডিইউ-এর নীতিশ কুমারের তো বরাবরের স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। এনসিপি-র শরদ পাওয়ারের শরীরটা খারাপ, নয়তো তিনিও দিল্লিতে রাজ করার স্বপ্ন দেখেন। মায়াবতীর দলের অবস্থা খারাপ, নয়তো তিনিও এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। পদ এক। দাবিদার অনেক।
জাতীয় স্তরে বিজেপিকে হারাতে গেলে আঞ্চলিক দলগুলি যতই ভালো ফল করুক, কংগ্রেসকেও ভালো ফল করতে হবে। বিজেপি বা কংগ্রেসের মতো জাতীয় দল ভালো ফল করলে তবেই জোটের সম্ভবনা তৈরি হয়। আঞ্চলিক দলগুলি নিজেদের রাজ্যে সব আসন জিতলেও (যেটা সম্ভব নয়) ২৬০-এর আশেপাশে যেতে পারে। বিজেপি অতটাও দুর্বল নয় এখনও। বিরোধীরা অতটাও শক্তিশালী নয় এখনও।
ভারতের নির্বাচন এখন প্রায় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আদলে লড়া হচ্ছে। মোদির বিরুদ্ধে কে? এ প্রশ্ন বিজেপি তুলবেই। রাহুল গান্ধী হলে বিজেপির সুবিধা। তৃতীয় ফ্রন্ট হলে আরও সুবিধা। মুখ অনেক।
১৯৭৭-এর নির্বাচনে জয়প্রকাশ নারায়ণের ইন্দিরা-বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ধরে, জরুরি অবস্থার পরে বিরোধীরা এক জোট হয়েছিল। সমাজবাদীরা থেকে জন সঙ্ঘ এক ছাতার তলায় এসে জনতা পার্টির নামে ও লোক দলের প্রতীকে নির্বাচন লড়েছিল ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। সেরকম কোনও সম্ভাবনাই বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নেই।
এ কথা ঠিক যে, কোনও একক-দল পরিচালিত সরকারের পতনের পরে স্বাধীনোত্তর ভারতে জোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ৭৭-এর পর আবার কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে। ইন্দিরা-রাজীবের পরে তৃতীয় ফ্রন্ট হয়েছে ৮০-র দশকের শেষে। কিন্তু তা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে। নরসিংহ রাওয়ের সরকারের পরে ৯০-এর দশকের শেষেও খিচুড়ি সরকার হয়েছে। আবার বাজপেয়ী সরকারের পতনের পর ২০০৪-এর ইউপিএ জোট সরকার চালিয়েছে কংগ্রেস। বেশিরভাগ জোটই হয়েছে নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে।
আরও পড়ুন- অলক্ষ্যেই ম্যাজিক করছেন রাহুল! হিংসার বিরুদ্ধে মানুষকে জুড়বে ভারত জোড়ো যাত্রাই?
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে আঞ্চলিক দলগুলির শক্তিশালী জোট হওয়া প্রায় অসম্ভব। সাগরদিঘির উপনির্বাচনের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করে দিয়েছেন তিনি কারও সঙ্গে জোট বাঁধবেন না। একাই লড়বেন। যথার্থ সিদ্ধান্ত।
নবীন পট্টনায়েক কারও সাতে পাঁচে থাকেন না। নীতিশ, চন্দ্রশেখর রাও, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নিজের নিজের নির্বাচনী হিসেব রয়েছে। অখিলেশের নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে নিজের দলের হিসেব ঠিক রাখতে হবে যোগীর বিরুদ্ধে লড়ে। দক্ষিণী রাজ্যে কর্ণাটকের জনতা দল সেকুলার নিজেরা সরকারে ফেরার চেষ্টায় আছে।
মহারাষ্ট্রে শরদ পওয়ার যেমন নিজের শক্তি অটুট রাখার চেষ্টা করবেন, তেমনই উদ্ধব ঠাকরে শিবসেনার কর্তৃত্ব হারিয়ে আবার নিজের রাজনৈতিক শক্তি প্রমাণের চেষ্টায় থাকবেন। এআইডিএমকে বা ডিএমকে নিজেদের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে হাত বাড়াতে যাবে না। সেখানেই নিজেদের শক্তি উজাড় করবে। সিপিএম তাদের একমাত্র গড় কেরলে নিজেদের ক্ষমতা অটুট রাখার চেষ্টা করবে।
আর এটাও মনে রাখতে হবে, বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের এই আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে বিশেষ চিন্তা নেই। তারা সঙ্ঘ পরিবারের ধারায় গরম না হোক নরম হিন্দুত্বের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। চিন্তা কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের নিয়ে। কমিউনিস্টদের নির্বাচনী ময়দানে প্রায় বাগে এনে ফেলেছে। আপ-তৃণমূল-সমাজবাদীদের চেষ্টায় সঙ্ঘ পরিবার কংগ্রেসীদেরও নিশ্চিহ্ন করে ফেললেই কেল্লা ফতে।
তৃতীয় ফ্রন্ট এটাই করতে পারে। কংগ্রেসিদের দাদাগিরি মানব না বলে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলি।
এখন আঞ্চলিক দলগুলির কাছে মূল চিন্তা নিজেদের আসন সংখ্যা যতটা সম্ভব বাড়ানো। সেটা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করেই করতে হবে। তাই অখিলেশ-মমতার বৈঠকের পর তৃতীয় ফ্রন্টের হাওয়া মিডিয়ারই তৈরি। খানিকটা জল ঘোলা করার খেলা। খাতায়-কলমে হোক বা পথে-ঘাটে এই ফ্রন্ট এখন অনেক দূরে।