ঝড়বৃষ্টি হলেই বাড়ছে হাঁপানি? জানেন কোন কঠিন অসুখের শিকার আপনি?

আপনি কি জানতেন হাঁপানি বা অ্যালার্জির সঙ্গে বাজ ও ঝড় দোসর হয়ে আপনার শরীরের কতটা মারাত্মক ক্ষতি করছে?

আপনি যদি ক্রমাগত হাঁপানি বা অ্যালার্জির মতো সমস্যায় ভোগেন, আপনি ইতিমধ্যেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে থাকবেন ঝড়বৃষ্টির মতো আবহাওয়ার সঙ্গে আপনার হাঁপানি বা অ্যালার্জির সমস্যা কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এরকম আবহাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়েই কেবল দেখা যাচ্ছে তা নয়, যেখানে হওয়ার কথা নয়, সেখানেও দেখা দিচ্ছে এরকম আবহাওয়া। কিন্তু আপনি কি জানতেন হাঁপানি বা অ্যালার্জির সঙ্গে বাজ ও ঝড় দোসর হয়ে আপনার শরীরের কতটা মারাত্মক ক্ষতি করছে?

ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বা শেষ হওয়ার পর অ্যাজ়মা বা হাঁপানিতে জর্জরিত হলেই তাকে বলা হচ্ছে 'থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মা'। 'থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মা' যে কোনও হাঁপানি বা অ্যাজ়মায় ভোগা রোগীর সঙ্গে ঘটতে পারে। তবে যাঁরা সিজ়নাল অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে ভোগেন তাঁদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এদিকে সিজ়নাল অ্যালার্জিতে যাঁরা ভোগেন, তাঁদের এমনিতেই বসন্ত, গ্রীষ্ম, এবং শরৎকালে শোচনীয় অবস্থা হয়। 

'থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মা' বা বজ্রঝড়ের হাঁপানির ঘটনা প্রথম নয়। গত শতকের আটের দশকে এই ঘটনা প্রথম ঘটে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডে। আর তারপর থেকেই বাড়তে থাকে এই ধরণের ঘটনা। তবে 'থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মা' নজর কাড়ে ২০১৬ সালে, যখন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বিদ‍্যুৎবর্ষণ ও ঝড়ঝাপটার ফলে রাতারাতি ন'হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে ছুটে যান অ্যাজ়মা বা হাঁপানির চিকিৎসার জন্য। হাঁপানিতে জর্জরিত হয়ে মারা যান অন্তত আট জন। সেখান থেকেই প্রশ্ন আসে, কাদের মধ্যে থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মায় ভোগার প্রবণতা বেশি।

আরও পড়ুন: করোনার পর কোন ভাইরাস? অতিমারীর ভয়াল দিন ফেরাচ্ছে জলবায়ুর ভোলবদল?

আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কাদের বেশি?
মে মাসে জার্নাল অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজি-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী দুশো আঠাশ জন ঋতুভিত্তিক অ্যালার্জিতে ভোগা রোগীর মধ্যে একশো চুয়াল্লিশ জনের বক্তব্য তাঁরা থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার শিকার হয়েছেন। হিসেব করলে দাঁড়ায় অংশগ্রহণকারী পঁয়ষট্টি শতাংশ ব্যক্তি থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার শিকার। এঁদের মধ্যে অনেকেরই বজ্রঝড়ের প্রভাবে গুরুতর হাঁপানির সমস্যা দেখা দেয়। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ব্যক্তিকেই বজ্রঝড়ের পর হাঁপানির সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগে ভর্তি হতে হয়।

কাদের ক্ষেত্রে থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার কবলে পড়ার সম্ভাবনা বেশি, জানালেন এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা। এই তালিকায় পড়ছে হাঁপানির সঠিক চিকিৎসা যাঁরা করাচ্ছেন না তাঁরা, বা যাঁদের ক্ষেত্রে হাঁপানির সমস্যা চরম, তারা। র‍্যাপিড এসক্যালেশন টেস্টে যাঁদের স্কোর কম, তাঁরা এবং যাঁদের শরীরে নির্দিষ্ট ধরনের অ্যান্টিবডি (ইমিউনোগ্লোবিউলিন-ই) আছে, তাঁরাও আছেন এই তালিকায়। এছাড়া যাঁদের রক্তে ইওসিনোফিল শ্বেতকণিকা বেশি এবং নিশ্বাসের সঙ্গে যাঁরা অধিক পরিমাণ নাইট্রিক অক্সাইড ত্যাগ করেন, তাঁদেরও অত্যন্ত বেশি সম্ভাবনা আছে থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার কবলে পড়ার।

তবে এই ধরনের সমস্যা থাকলেই যে থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার কবলে পড়বেন, আপনি তা নয়। বা সমস্যাগুলো থাকলেই যে প্রত্যেক বজ্রঝড়ে মারাত্মক অবস্থা হবে আপনার, তেমনটাও নয়। তবে সম্ভাবনা বা ঝুঁকি এড়িয়ে না গিয়ে, আগেভাগে সাবধান থাকাই ভালো।

'দ্য ল্যান্সেট প্ল্যানেটারি হেলথ' জার্নালে ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান এবং এশিয়ান, বিশেষ করে ভারতীয়দের মধ্যে এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাঁদের জিনগত কারণের জন্য।

বজ্রঝড়ের সময়ে হাঁপানির সম্ভাবনা বাড়ে কেন?থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মা ঘটার পিছনে কতগুলি ঘটনাক্রম রয়েছে। ঝড়ের সময় ঠান্ডা বাতাস নিচের দিকে নেমে আসে, সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসে ধূলিকণা, ফুলের রেণু, ছত্রাকের রেণু বা ফাঙ্গাল স্পোর এবং মোল্ড। যে সমস্ত অঞ্চলে বাতাসে আর্দ্রতাবেশি, সেখানে গিয়ে এই ধূলিকণা, ফুল ও ছত্রাকের রেণু, এবং মোল্ড মেঘের সঙ্গে মেশে। মেঘের মধ্যে মেশার পর এই কণাগুলি আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয় বাতাস, আর্দ্রতা এবং বজ্রপাতের প্রভাবে। সাধারণত বড় আকারের রেণু ফুসফুস পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু আর্দ্রতা পেলে প্রাকৃতিকভাবেই ফুলে ওঠে এবং সহজে ফেটে গিয়ে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয়। বজ্রঝড়ের সময়ে ধেয়ে আসা বাতাসের সঙ্গে এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আরও সহজে ঢুকতে নাক এবং মুখের মাধ্যমে শ্বাসনালী ও ফুসফুসে প্রবেশ করে।

জলবায়ু পরিবর্তন কতটা বাড়াচ্ছে থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার সম্ভাবনা?
বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন এমনিতেই অ্যাজ়মার মতো সমস্যা বাড়ায়। হাঁপানির মতো সমস্যা বাড়ার বড় একটি কারণ বাতাসে নানা রক, ক্ষতিকর গ্যাস এবং ভাসমান পদার্থের বৃদ্ধি, যার মধ্যে অন্যতম হল ওজো়ন গ্যাস, সালফার, সালফার ডাই অক্সাইড এবং সিলিকা।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড়বৃষ্টির ঘটনা কমলেও, আগের থেকে ভয়ংকর ও রূঢ় হয়েছে তাদের প্রকৃতি। স্বাভাবিক ভাবেই তার ফলে থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার আশঙ্কা বাড়ছে।

থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার থেকে বাঁচার উপায় কী? আক্রান্ত হলে কী করণীয়?
দ্য ল্যান্সেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, যাঁদের হাঁপানির সমস্যা ইতিমধ্যেই রয়েছে, এই ধরনের আবহাওয়ায় তাঁদের বাড়ির বাইরে বেরনো যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া ভালো। তবে রোগীদের পাশাপাশি হাসপাতালের আপৎকালীন বিভাগের জরুরি অবস্থার জন্য তৈরি থাকা উচিত, বিশেষ করে যখন এই ধরনের আবহাওয়া দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সংকটজনক অবস্থায় ব্রঙ্কডাইলেটারে খানিকটা উপশম হতে পারে বলেই দাবি করছে ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নের গবেষকরা (সূত্র: জার্নাল অফ ইনফ্ল্যামেশন রিসার্চ, ২০২১)। পাশাপাশি ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান রেস্পিরেটরি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় জানা যাচ্ছে, অ্যান্টি-ইমিউনোগ্লোবিন ই সেবনে সব বয়সের রোগীরা থান্ডারস্টর্ম অ্যাজ়মার হাত থেকে সুরাহা পেয়েছেন।

তবে এই ধরনের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পরিবেশ সম্পর্কে উদাসীনতা কাটিয়ে এবার অন্তত আমাদের সচেতন হতে হবে। কেবল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কেই অবহিত হলে হবে না, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের শরীরের কী কী ক্ষতি নিত্যনৈমিত্তিকভাবে ঘটছে, সে বিষয়েও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

More Articles