যাত্রীদের দেহের ছিটেফোঁটাও মেলেনি! অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজ হারিয়ে গেল কীভাবে?
Titan Submersible Missing: এই সাবমার্সিবলগুলির ভিতরের দিক একদম ছোট, খানিকটা মিনিভ্যানের মতো জায়গা। শুধুমাত্র একটি টয়লেট আছে, কোনও আসন নেই।
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের সন্ধানে বেরিয়েছিল টাইটান। রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গিয়েছে সেই ডুবোজাহাজ। পাঁচ যাত্রীদের সকলেই মৃত। সমুদ্রের অতলে আর কোনওদিনই হারিয়ে যাওয়া পাঁচ যাত্রীর দেহাবশেষটুকু মিলবে কিনা, তাও বলা যাচ্ছে না নিশ্চিত করে। মার্কিন কোস্ট গার্ড জানাচ্ছে, গভীর সমুদ্রের পরিবেশ অবিশ্বাস্যরকম, সেখানে একবার হারিয়ে গেলে কিছু আদৌ মিলবে কিনা বলা যায় না। এই ঘটনার আকস্মিকতা আর মর্মান্তিক পরিণতি স্তব্ধ করেছে গোটা বিশ্বকেই। যে মানুষরা হারিয়ে গিয়েছেন, সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী। অথচ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সব শেষ। কীভাবে রওনা হওয়ার পৌনে দু' ঘণ্টার মাথায় যোগাযোগ হারিয়ে ফেলল টাইটান সাবমার্সিবল? কীভাবেই বা মৃত্যু হলো পাঁচ যাত্রীর?
রবিবার সকালে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জন'স উপকূল থেকে পাঁচজন অভিযাত্রীকে নিয়ে সাবমার্সিবলটি রওনা হয় এবং জলের গভীরে নামার মোটামুটি দেড় থেকে পৌনে দু' ঘণ্টার মধ্যেই পৃষ্ঠের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মার্কিন এবং কানাডিয়ান কোস্ট গার্ডের মিলিত প্রচেষ্টায় সেদিনের পরেই বিশাল অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান শুরু হয়।
বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ঘটনাটি ঘটার চারদিন পরে মার্কিন কোস্ট গার্ড জানায়, ২২ ফুট (৬.৭-মিটার) টাইটানের পাঁচটি প্রধান টুকরো মিলেছে। জাহাজের লেজের একটি অংশ এবং প্রেসার চেম্বারের দু'টি অংশ মিলেছে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। মানুষের দেহাবশেষ দেখা গিয়েছে কিনা তা উল্লেখ করা হয়নি।
মার্কিন কোস্ট গার্ডের কথা অনুযায়ী, টাইটানিকের স্থান থেকে প্রায় ১,৬০০ ফুট দূরে সমুদ্রতটের উপর এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪ কিমি নীচে এই ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে। সম্ভবত অবতরণের সময় বিস্ফোরণ ঘটেই এই বিপত্তি। টাইটান ডুবোজাহাজটিতে অক্সিজেন ছিল সীমিতই। ফার্স্ট কোস্ট গার্ড ডিস্ট্রিক্টের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, টাইটানিকের আশেপাশের এলাকায় যেখানে ডুবোজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে সেখানে অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে। কিন্তু কখন, কীভাবে এই ঘটনাটি ঘটেছে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
আরও পড়ুন- ফাদার্স ডে-র উপহার! ভয় সত্ত্বেও টাইটানিক খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে গেলেন বাবা ছেলে দু’জনেই…
মার্কিন কোস্ট গার্ডের দাবি, নিখোঁজ সাবমার্সিবলটি অবতরণের সময় একটি বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এতে থাকা পাঁচজনই নিহত হন। অন্যদিকে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদনে বলছে, মার্কিন নৌবাহিনীর জলের তলদেশে ব্যবহৃত মাইক্রোফোনগুলিতে টাইটানের অবতরণ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে সন্দেহজনক এক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছে।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি রোবোটিক ডাইভিং গাড়ি সমুদ্রের তলদেশে টাইটানের ধ্বংসাবশেষের ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে এবং জাহাজের পাঁচটি প্রধান খণ্ড চিহ্নিত করেছে। মানব দেহাবশেষের কোনও উল্লেখ করা হয়নি। টাইটান তখন টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসস্তূপের দিকে প্রায় ১২,৫০০ ফুট জলের নিচে ছিল। ঠিক তখনই ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী গাড়ি আর টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওশানগেট এক্সপিডিশনস এই অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। ওশানগেট এক্সপিডিশনের সিইও স্টকটন রাশ ছিলেন এই মিশনের পাইলট। তিনিই চালাচ্ছিলেন সাবমার্সিবলটি। ছিলেন ব্রিটিশ বিলিয়নেয়ার এবং অভিযাত্রী হামিশ হার্ডিং, পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ এবং তাঁর ১৯ বছর বয়সী পুত্র সুলেমান। ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী এবং বিখ্যাত টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পল-হেনরি নাগেরোলেট এর আগে বহুবার টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করেছিলেন। এই যাত্রার সঙ্গী ছিলেন তিনিও, অথচ ফেরা হলো না তাঁর।
বৃহস্পতিবার সকালে, দু'টি গভীর জলের রিমোট কন্ট্রোল্ড যান (আরওভি) অনুসন্ধানস্থলে পৌঁছয়। একটি অন্য সাবমার্সিবলও সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছেছে। ফরাসি গবেষণা জাহাজ আটলান্ট থেকে পরিচালিত ভিক্টর ৬০০০-কেও নামানো হয়েছে অনুসন্ধানে। এই ভিক্টর ৬০০০-এ একটি রোবট রয়েছে যা সমুদ্রতলের ৩,৮০০ মিটার (১২,৫০০ ফুট) নীচে পৌঁছাতে পারে এবং টাইটান সাবমার্সিবলকে উপরে তুলতে পারবে এই রোবটই কারণ নৌবাহিনীর সাবমেরিন উদ্ধারের জন্য তৈরি হওয়া যানবাহন যতটা প্রয়োজন ততটা গভীরে যেতে পারে না।
ঠিক কখন হারিয়ে যায় টাইটান?
রবিবার সকালে টাইটানিক ধ্বংসাবশেষের কাছাকাছি পৌঁছেছিল মূল জাহাজটি যেখান থেকে টাইটান সাবমার্সিবলটি জলে নামানো হয়। স্থানীয় সময় সকাল ৮ টায় টাইটান নামতে শুরু করে। আশা করা হয়েছিল বেলা ৩ টে নাগাদ এটি ফিরে আসবে। তবে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কোস্ট গার্ড জানিয়েছে, বিকেল পৌনে ছ'টা নাগাদ, অর্থাৎ ঘটনাটি ঘটার আট ঘণ্টা পরে এই সমস্যার কথা তারা জানতে পারে। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
এর আগে ১৯৭৩ সালে এমনই একটি ঘটনা ঘটে। রজার চ্যাপম্যান এবং রজার ম্যালিনসনকে গভীর জলের নীচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ১,৫৭৫ ফুট গভীরতায় একটি সাবমার্সিবল থেকে উদ্ধার করা হয়। ৭৬ ঘণ্টা গভীর জলে আটকে ছিলেন তারা।
আরও পড়ুন- টাইটানিক খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে গেল ‘টাইটান’! যে পাঁচজন চিরতরে হারিয়ে গেলেন…
টাইটানের বিশেষত্ব কী?
টাইটান তৈরি হয়েছিল কার্বন ফাইবার এবং টাইটানিয়াম দিয়ে। ওজন ২৩,০০০ পাউন্ড! সাবমার্সিবল বেশিক্ষণ জলের নিচে থাকতে পারে না। সবসময়ই জলের উপরে সাহায্যকারী জাহাজের দরকার পড়ে এর। টাইটান সাধারণত টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের সন্ধানে প্রতিটি ডুবে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা ব্যয় করে। সাবমেরিন কিন্তু কয়েক মাস ধরে জলের নিচে থাকতে পারে।
টাইটান ডুবোজাহাজটি ওশানগেট এক্সপিডিশনস পরিচালিত আট দিনের যাত্রার অংশ ছিল। মাথাপিছু এই যাত্রার খরচ ছিল ২৫০,০০০ মার্কিন ডলার!টাইটান ডুবোজাহাজটি এমনভাবেই তৈরি হয়েছিল যাতে পাঁচজনের জন্য ৯৬ ঘণ্টার অক্সিজেন ছিল।
এই সাবমার্সিবলগুলির ভিতরের দিক একদম ছোট, খানিকটা মিনিভ্যানের মতো জায়গা। শুধুমাত্র একটি টয়লেট আছে, কোনও আসন নেই। যাত্রীরা মেঝেতেই বসেন। পোর্টহোল ছাড়া কোনও জানালা নেই। এই পোর্টহোল দিয়েই যাত্রীরা টাইটানিক দেখতে পান।
জলের নিচে কোনও জিপিএস ছাড়াই ডুবোজাহাজটি শুধুমাত্র ভূপৃষ্ঠের জাহাজ থেকে টেক্সট মেসেজ দ্বারাই পরিচালিত হয়। পাইলট একটি ভিডিও গেম কন্ট্রোলার ব্যবহার করে সাবমার্সিবলটি পরিচালনা করেন।