শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিই নীতি! এক দশকে ধ্বংস হল সরকারি চাকরির স্বপ্ন
এই বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার, সন্দেহ নেই, তৃণমূলের শিক্ষা দুর্নীতির নগ্ন এবং ভয়ংকর রূপটিকেই তুলে ধরছে। সেই করাল রূপের আলোকে খতিয়ে দেখা যাক এই দুর্নীতির গোড়ার কথা।
তৃণমূল এবং দুর্নীতি প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে গত দশ বছরে। নানা খাতে দুর্নীতির ধাক্কায় ব্যতিব্যস্ত সাধারণ মানুষের এখন প্রায় খাবি খাওয়া অবস্থা। না আছে হাতে চাকরি, না আছে যোগ্যতামাফিক দিন গুজরানের সুযোগ। কেন্দ্র সামরিক ব্যবস্থাকেও চুক্তির কাঠগড়ায় তুলছে, ভেঙে দিচ্ছে পেনশনের আশ্রয়, রাজ্যের অবস্থা আরও সঙ্গিন। শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি প্রায় নেই বললেই চলে। তার উপরে গেঁথে বসেছে দুর্নীতির শিকড়বাকড়। এসএসসি পরীক্ষা হয়, মানুষ চাতকের মতো ফলাফলের দিন গোনে, দুর্নীতির অভিযোগে সেইসব বহু সাধনার চাকরি মামলায় ঝুলে থেকে যায়। প্রথম প্রথম লোকে দুঃখ পেত, তারপর ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল, শিক্ষকতার ক্ষেত্রটিতেই পা রাখতে চাইত না একদা শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখা বহু তরুণ। বছর বছর এসএসসি হওয়ার সম্ভাবনাও কমছিল ধীরে ধীরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য চেষ্টা করছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু সেখানেও যে বিরাট পরিমাণ চক্রব্যূহ তৈরি হয়েছিল, তা পেরিয়ে চাকরির নাগাল পাওয়া হয়ে উঠছিল দুঃসাধ্য। খবর মোটামুটি সবাই জানত একরকম। কোর্টের রায়ে তাই উঠে আসছে সামনে। তবে এই বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার, সন্দেহ নেই, তৃণমূলের শিক্ষা দুর্নীতির নগ্ন এবং ভয়ংকর রূপটিকেই তুলে ধরছে। সেই করাল রূপের আলোকে খতিয়ে দেখা যাক এই দুর্নীতির গোড়ার কথা।
বাম আমল থেকেই 'দাদা ধরে' কলেজে ভর্তি একরকম ইউনিয়ন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও সেইসব একই রকম ছিল। পুরনো তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাদের সরিয়ে স্থানীয় এলাকাগুলোতে নানা পরিচিত মুখ ছাত্র সংগঠন সামলাতে শুরু করল। মোটামুটি তখনই বোঝা গিয়েছিল, ভর্তির ক্ষেত্রে তোলাবাজি, বিশিষ্ট দাদার সূত্রে ভর্তি হলে তার সংগঠনের সঙ্গে ওঠাবসা, প্রচার, সেই ইউনিয়নকেই ভোট দেওয়া এইসব অলিখিত নিয়ম মেনে চলতে হবে। স্থানীয় দাদার ভ্রমণের পরিকল্পনা ব্যহত হওয়ায় কলেজে নির্বাচন হতে দেওয়া হয়নি—এমন উদাহরণও রয়েছে। ছাত্রদের ওপর চড়াও হওয়ার অভিযোগ তো রয়েইছে।
সেই সময় অনলাইন ভর্তির সুযোগসুবিধা এসে গিয়েছে। নানা বিষয় মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত হলো, অনলাইন প্রক্রিয়ায় ছাত্র ভর্তি বাধ্যতামূলক করা হবে সমস্ত কলেজে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, মত বদলে গিয়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। শিক্ষা দফতর জানাল ২০১৪-'১৫ শিক্ষাবর্ষে সব কলেজে অনলাইন ছাত্রভর্তি বাধ্যতামূলক নয়। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তিত্বই তখন জানিয়েছিলেন, মন্ত্রীর এহেন মত পরিবর্তনের নেপথ্যে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে।
আরও পড়ুন: পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উত্থান ও পতন
এককথায় সম্পূর্ণ অনলাইন পদ্ধতিতে ভর্তি শুরু হলে ভর্তি প্রক্রিয়ার ওপর শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের দাদাদের প্রভাব কমবে, কলেজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। ব্যাপারটা খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। ফলে মত বদলাতে বাধ্য হন পার্থ। সেসময় যদিও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সেকথা অস্বীকার করেন। কিন্তু ছাত্র ভর্তিতে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে অনলাইন ভর্তির কথা ঘোষণা করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। সেদিকে কয়েক ধাপ এগিয়েও এতদূর পিছিয়ে আসাতে সরকারেরই মুখ পুড়ল বলে মন্তব্যও করেছিলেন অনেকে। আদতে সেই ছিল সমঝোতার শুরু। ২০১৪-'১৫ শিক্ষাবর্ষ অনলাইন ছাত্র ভর্তির ঘোষণা করেছিলেন সদ্য-বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু স্বয়ং। হঠাৎ করে এই উল্টোপথ অনেককেই সন্দিগ্ধ করেছিল। সমঝোতার জমিনে দুর্নীতির ছত্রাক এরপর বেড়েছে অবাধে।
বর্তমানে ইডি-উদ্ধৃত টাকার অঙ্ক নিয়ে ফের আতঙ্কিত সকলে। শোনা যাচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ হারাতে পারেন ৫৪,০০০ কর্মী। কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে ৪৩,০০০ প্রাথমিক শিক্ষকের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শুধু তাই নয়, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশনের গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি-র পাশাপাশি নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির নিযুক্ত শিক্ষকদেরকেও তদন্তের অধীনে রাখছে সিবিআই। ক্ল্যারিকাল কাজে বহু মানুষ সরকারের বদান্যতায় জায়গা করে নিয়েছেন বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর স্কুল সার্ভিস কমিশনের গ্রুপ ডি পদে ২৫ জনের চাকরি বাতিল করে বেতন বন্ধর নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। এরপর গ্রুপ ডি পদেই একসঙ্গে চাকরি খুইয়ে বসে ৫৭৩ জন। এই বছরেই ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা হাই কোর্ট সেই রায় দিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও নাকি নিয়োগ হয়েছিল। বেতন বন্ধর পাশাপাশি বেতন ফেরতেরও রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। বেনিয়মের অভিগে শয়ে শয়ে তরুণ-তরুণী চাকরি খুইয়েই চলেছে। ২৭৩ জন প্রাথমিক শিক্ষককে গত মাসে বরখাস্ত করা হয়েছে। এঁরা বেশিরভাগই চাকরি পেয়েছিলেন গ্রামীণ স্কুলগুলিতে। এর মধ্যে কে নেই? তৃণমূল পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যর ছেলে যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে এক সিপিআইএম নেতার স্ত্রী, তৃণমূল যুবনেতার দুই ভাই— বিবিধের মাঝে দেখি মিলন মহান।
এখন প্রশ্ন, কেন হলো এই ধরনের অবস্থা? সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন চাকরি পাচ্ছেন না। যোগ্য মানুষ চাকরি পাচ্ছেন না। তবে চাকরি পাচ্ছেন কারা? যাদের ওপরমহলে যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু শুধু কি তারাই? বেনিয়মে চাকরি যাদের হয়েছে, তারা কি সবাই অযোগ্য? কখনওই তা নয়, কিন্তু তাদের চাকরি পাওয়ার পদ্ধতিটি ঘুষ দিয়ে। দুর্নীতির বৈশিষ্ট্য এই, যে সে যোগ্য মানুষকেও নীতির ফাঁকফোকর দেখতে বাধ্য করে। আসল বিষয়, সুযোগ করে দেওয়া। যে নীতি ক্ষমতাবানরা চালাবেন, সেভাবেই মানুষ চাকরি পেতে চাইবেন— এ তো স্বাভাবিক। দিনের পর দিন যে যোগ্য মানুষ দেখবেন কোনওরকম যোগ্যতা ছাড়াই পাশের মানুষটি ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে, তিনিও তখন বিপথে চালিত হবেন।
বস্তুত 'সরকারি চাকরি'-কে একটি দুর্মূল্য বস্তু করে তোলার পিছনে এই মানসিকতাও রয়েছে। একদিকে উদ্দেশ্য যেমন বেসরকারিকরণ, অপরদিকে সোনার মতো দুর্মূল্যতা আরোপ করে 'সরকারি চাকরি' নামক সোনার হরিণের পিছনে মানুষকে ঠেলে দিয়ে ব্যবসা করার ঝোঁকটি এখন কেন্দ্র থেকে রাজ্য- সর্ব স্তরেই দেখা যাচ্ছে। তাকেই কাজে লাগিয়েছে এই দুর্নীতি। এই ঝোঁক না থাকলে সাধারণ মানুষ দুর্নীতিতে শামিল হতেন কেন? এক-একটি সরকারি চাকরির পরীক্ষা থেকে সরকার যা আয় করে, ফর্ম ফিল আপ থেকে শুরু করে যাত্রীদের যাতায়াতের ভাড়া, হোটেল ভাড়া বা খাওয়াদাওয়ার ট্যাক্স, তাতে বহু পরীক্ষার্থীকে সারা বছর বেকার ভাতা দেওয়া যায়। কেন এত এত মানুষ দৈনন্দিন সরকারি চাকরির পিছনে ছোটেন? পাড়ার মোড়ে, বাড়িতে, আড্ডায় তো সকলেই আলোচনা করেন 'আর সরকারি চাকরি বলে কিছু থাকবে না!' তারপরেও চাহিদা কমে না। তৃণমূল তার সুযোগ নিয়ে মোটা দাগে আইনি পথের বাইরেও টাকা নিয়েছে, এবং তার ফল এখন ভুগতে হচ্ছে।
যারা সাধারণ মানুষের টাকা নিয়েছেন, তাদের বেনিয়মে চাকরি পাইয়ে দিতে প্রলুব্ধ করেছেন, তাদের কড়া শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু ততদূর জল কি গড়াবে? প্রতিবারের মতো কিছু বলির পাঁঠা খাড়া করে এড়িয়ে যাওয়া হবে না তো যে, আদতে নীতিটাই দুর্নীতি? 'সরকারি চাকরি'-কে কেন এভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্মূল্য করে তোলা হচ্ছে, সেই জবাব কি চাইবে কোনও আদালত? দেখা যাক।

Whatsapp
