'দাদা-বৌদি': বেড়ার দোকান থেকে আলিশান হোটেল, কোন মন্ত্রে লাখো মানুষের মন জয়

কলকাতার বিরিয়ানি, হায়দরাবাদি বিরিয়ানি তো অনেকেই খেয়েছেন, কিন্তু দাদা-বৌদির বিরিয়ানি বারাকপুর তথা শহর ও শহরতলি-সংলগ্ন মানুষের নয়নের মণি।

কলকাতার বিরিয়ানিপ্রেমী অথচ দাদা-বৌদির নাম শোনেননি, এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বারাকপুর রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকে একটু এগোলেই একটি দোকানের সামনে শয়ে শয়ে মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যস, একদম জায়গামতোই পৌঁছে গেছেন, মাথা তুলেই দেখবেন বোর্ডে লেখা 'দাদা-বৌদির হোটেল'। কলকাতার বিরিয়ানি, হায়দরাবাদি বিরিয়ানি তো অনেকেই খেয়েছেন, কিন্তু দাদা-বৌদির বিরিয়ানি বারাকপুর তথা শহর ও শহরতলি-সংলগ্ন মানুষের নয়নের মণি।

এই প্রসঙ্গে এক অভিজ্ঞতার কথা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। স্কুলজীবনের পুরো সময়টাই কেটেছে বারাকপুরে। বহুবার বহু লোকের থেকে শুনেছি, "ধুর বারাকপুরে যাস আর দাদা-বৌদির বিরিয়ানি খাসনি, কী করলি তবে জীবনে? তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। একা একা স্কুলে যাতায়াত করি। বাবা স্কুলের মাইনেবাবদ যে টাকা দিয়েছিলেন, তার অর্ধেক দিয়ে প্রথমবার দাদা-বৌদির বিরিয়ানি খেতে ঢুকেছিলাম। কলাপাতায় সাজানো বিরিয়ানির সঙ্গে ধনেপাতার চাটনি টেবিলে আসতেই শেষ। পরে অবশ্য স্কুলে লেট ফি-র জন্য বাড়িতে বকা খেয়েছি, কিন্তু ওই বিরিয়ানির স্বাদের কাছে খুবই ফিকে মনে হয়েছিল। এতটাই ভালবাসা জড়িয়ে দাদা-বৌদির বিরিয়ানির সঙ্গে। শুধু কলকাতা নয়, দেশ-বিদেশের মানুষ ছুটে আসেন এই বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য। প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে ব্যবসা করে চলেছে দাদা-বৌদির বিরিয়ানি।

বিহারের চম্পারণ জেলার মতিহারির বাসিন্দা রামপ্রসাদ সাহা। একসময় সেই ভিটেমাটি ছেড়ে ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন। পেট চালানোর তাগিদে ১৯৬১ সালে বারাকপুর স্টেশন-সংলগ্ন ঘোষপাড়া রোডের ওপর হোটেল চালু করেন রামপ্রসাদ। মেনুতে ছিল শুধুমাত্র রুটি-সবজি আর ডাল। বছর পনেরো পর দোকানের দায়িত্ব নেন রামপ্রসাদের ছেলে ধীরেন সাহা। হোটেলের ভার নিজের কাঁধে নিয়েই তিনি একাধিক পদ যোগ করেন মেনুতে। ভাত, মাছের ঝোল, মুরগির ও পাঁঠার মাংসের ঝোল, সবই জায়গা করে নিল মেনুতে। ২০০ স্কোয়ারফিটের সেই হোটেল একবারে বাঙালিয়ানায় ভরপুর। কিছুদিন পর ধীরেনের স্ত্রী সন্ধ্যা সাহাও হোটেলের কাজে স্বামীকে সাহায্য করতে যোগ দেন ব্যবসায়। সেই থেকেই লোকের মুখে হোটেলের নাম হয়ে যায় 'দাদা-বৌদির হোটেল'।

আরও পড়ুন: নেটদুনিয়ায় ঝড় তাকে নিয়েই, গন্ধরাজ মোমো বানানো বাঁয়ে হাত কা খেল

মাত্র দু'জন কর্মচারীকে নিয়ে ধীরেন ও সন্ধ্যা হোটেলের সব কাজ করতেন। এছাড়া দুই ছেলে সঞ্জীব ও রাজীব স্কুল ছুটির পর তাঁদের সাহায্য করতেন। আটের দশকের শেষ, সদ্য স্কুল পাশ করেছে সঞ্জীব। ছোট ভাই রাজীব মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোলেও আর ভর্তি হয়নি স্কুলে। দু'জনেই পুরোদমে কাজে লেগে পড়েন বাবার হোটেলে। বর্তমানে বারাকপুরের রেস্তোরাঁ থেকে মাত্র ১০ মিনিট দূরত্বে থাকেন দুই ভাই। একজন ভ্রমণপিপাসু আর অন্যজন পশুপ্রেমী। কিন্তু শুরুর দিকে অনেক রাত অবধি হোটেল সামলানো, বাসন ধোয়া, সবই করতেন নিজে হাতে। দুই ভাই মিলেই ব্যবসায় পাঁচ হাজার টাকায় বিনিয়োগ করে বিরিয়ানির পাত্র, বাসমতী চাল এবং মাংস কিনে বিরিয়ানি তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে প্রতিদিন প্রায় তিন কেজি মাংস দিয়ে তৈরি হতো মটন বিরিয়ানি। ১৯৮৬ সাল থেকে তাঁদের আউটলেটে বিরিয়ানি বিক্রি শুরু হয়। রাজীব, সঞ্জীবের হাত ধরেই ব্যবসা বাড়তে শুরু করে হোটেলের।

প্রতি প্লেট বিরিয়ানিতে থাকে ৮০০ গ্রাম চাল, ২০০ গ্রাম ওজনের মাংসের টুকরো, বড় সাইজের আলু, সঙ্গে থাকে ধনেপাতার চাটনি এবং স্যালাড। আজ তাদের তিনটি আউটলেট রয়েছে। ২০১৯ সালে সোদপুরে চালু হয় দাদা-বৌদির রেস্তোরাঁ। কলকাতা এয়ারপোর্ট-সংলগ্ন এলাকায় শীঘ্রই খুলে যাবে আরেকটি নতুন আউটলেট। প্রতিদিন প্রায় ১২০০ প্লেটেরও বেশি বিরিয়ানি বিক্রি হয় এই রেস্তোরাঁয়। বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ১৫ কোটি ছুঁইছুঁই। এই মুহূর্তে বারাকপুরে হাজার একটা নামকরা বিরিয়ানির দোকান খুললেও দাদা-বৌদির বিরিয়ানি এখনও এক নম্বরেই রয়েছে।

তবে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুনাম ধরে রাখার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলেই মনে করেন বর্তমান মালিক সঞ্জীব সাহা। তাঁর কথায়, "বিরিয়ানির আসল উপাদান মাংস। আর সেই মাংস দাদা-বৌদির তরফ থেকে নিজেরাই গিয়ে এখনও কিনে আনা হয়। কোনো কর্মচারীর ওপরেই সেই দায়িত্ব দেওয়া হয় না।' এছাড়া দাদা-বৌদির সমস্ত কারিগরই বংশপরম্পরায় দোকানে রয়ে গেছেন। যাঁরা রান্না করেন, তাঁদের পরিবারের মানুষই শুরুর দিন থেকে কাজ করে চলায় এখনও অমলিন দাদা-বৌদির বিরিয়ানির স্বাদ।

প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক তথা বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এই বিরিয়ানির টানে বহুবার ছুটে এসেছেন বারাকপুর। বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল ক্রেগ এল হল সপরিবারে এসে দাদা-বৌদির আউটলেট পরিদর্শন করে বিরিয়ানি খেয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে বলিউড তারকা হৃতিক রোশনকে দেখা গেছে দাদা-বৌদির বিরিয়ানির বিজ্ঞাপনে।

প্রথমদিকে প্রতি প্লেট মটন বিরিয়ানির দাম ছিল ১১ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে আজ সেই দাম তিনশো ছুঁলেও দাদা-বৌদির বিরিয়ানি ঘিরে মানুষের উন্মাদনা এতটুকু কমেনি। ভোজনরসিক বাঙালির কাছে দাদা-বৌদির বিরিয়ানি আবেগেরই অন্য নাম।

More Articles