আগামী বছর পালাতে হতে পারে কলকাতা ছেড়ে! গবেষকদের পরীক্ষায় উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য

Kolkata Air Pollution: গ্রীষ্মকালেও বিমানযাত্রার সময় যেন মনে হয় শহরটা কুয়াশার পাতলা চাদরে মোড়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, তা এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ বেশি থাকার কারণেই ঘটছে।

আপনি কি জানেন এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? গবেষকদের মতে সম্ভবত তা বায়ুদূষণ। শুনে অবাক হলেন তো? তাহলে আপনাদের আরও কিছু তথ্য দেওয়া যাক। ২০১৯ সালে ভারতে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন (এক মিলিয়ন মানে দশ লক্ষ) মানুষ কেবল বায়ুদূষণের কারণে মারা গেছেন। যা ওই বছরে মোট মৃত্যুর প্রায় ১৮ শতাংশ। এই ১.৭ মিলিয়নের মধ্যে এক মিলিয়ন মানুষ মারা গেছেন কেবল বাতাসে ভাসমান এরোসলের কারণে। গত তিরিশ বছরে কেবল এরোসলের কারণেই ভারতে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ বেড়েছে।

দূষণের জন্য ইতিমধ্যেই ভারতের ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যে ক্ষতির সিংহভাগটা উত্তরপ্রদেশের হলেও, পেছনে সারি দিয়ে রয়েছে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য। চলতি বছর শেষ হতে আর হাতে গোনা দিন। তারই মধ্যে দু:সংবাদ দিলেন কলকাতার বোস ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। এলসিভিয়ারের ‘অ্যাটমোস্ফেরিক এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সেই গবেষণাও। সেই গবেষণাতেই উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আগামী বছর আসছে ভয়াবহ দিন। ২০২৩ সালে কলকাতা-সহ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে দূষণের মাত্রা বাড়বে ৮ শতাংশ।

দূষণের মাত্রা বোঝার জন্য মাপা হয়েছে এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ। এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ বলতে বোঝায় বাতাসের থাকা এরোসল অর্থাৎ ধোঁয়া, কার্বন কণা, দূষিত গ্যাস, ধুলোবালির পরিমাণ। নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলের একদম উপরিভাগ অবধি একটি নির্দিষ্ট কলামের মধ্যে কী পরিমাণ এরোসল রয়েছে, তা দিয়ে নির্ধারণ করা হয় ওই অঞ্চলের এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ (AOD)। পুরোটাই করা হয় নির্দিষ্ট যন্ত্রের মাধ্যমে।

আরও পড়ুন- দূষণে নাভিশ্বাস, রাজধানী দিল্লি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে?

৮ শতাংশ শুনতে কম মনে হলেও, সারা বাংলা জুড়ে সামগ্রিক ভাবে যদি এই হারে বৃদ্ধি পায় বায়ুদূষণের হার, তাহলে কিন্তু তার ফল মোটেই ভালো হবে না। অসুস্থতার হার বাড়বেই। বয়স্ক বা ইতিমধ্যে অসুস্থ যারা তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেনই, বাদ পড়বে না যুব ও শিশুরাও। এমনিতেই গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে দূষণের প্রাদুর্ভাব চিন্তায় ফেলে। ২০১৯ থেকে ২০২২-এর মধ্যে এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ যে ক্রমশ বাড়ছে তা চোখে পড়ে বিমানযাত্রার সময়ে। ২০১৯ সালেও যেখানে বিমানযাত্রার সময় নীচে কলকাতা শহর বা বাংলার দিকে তাকালে বেশ স্পষ্ট দেখা যেত নীচের গাছপালা, বাড়িঘর, ২০২০ সালের পর থেকে তা আরও ঘোলাটে হয়েছে। গ্রীষ্মকালেও বিমানযাত্রার সময় যেন মনে হয় শহরটা কুয়াশার পাতলা চাদরে মোড়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, তা এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ বেশি থাকার কারণেই ঘটছে।

কোন রাজ্য কতটা অসুরক্ষিত:

গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ ইতিমধ্যেই ০.৫ এর বেশি। যাকে ইতিমধ্যেই ‘হাইলি ভালনারেবল’ (রেড জো়ন) বা অত্যন্ত অসুরক্ষিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ ০.৭-এর কাছাকাছি পৌঁছবে। গবেষকদের হিসেব বলছে ২০২৩ সালে, পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অত্যন্ত অসুরক্ষিত (হাইলি ভালনারেবল বা রেড জো়ন) রাজ্যগুলির মধ্যে থাকবে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র। বাদ যাচ্ছে না উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরাও।

অন্যদিকে যে সমস্ত রাজ্যে এরোসল অপটিক্যাল ডেপথ ০.৪ থেকে ০.৫-এর মধ্যে, সেই রাজ্যগুলিকে ‘ভালনারেবল’ (অরেঞ্জ জো়ন) বা অসুরক্ষিত অঞ্চলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই রাজ্যগুলির মধ্যে পড়ছে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু বাদে সমস্ত রাজ্য, পশ্চিম ভারতের গুজরাত, এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম ও মেঘালয়। সেখানে দাঁড়িয়ে উত্তরে হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড, দক্ষিণের তামিলনাড়ু এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের মণিপুর অপেক্ষাকৃত কম অসুরক্ষিত থাকবে ২০২৩ সালে।

আরও পড়ুন- প্লাস্টিক দূষণ কমাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আশ্চর্য আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের

দূষণের পারদ বাড়ার নেপথ্যে কারা?

প্রিন্সিপাল কম্পোনেন্ট অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে গবেষকরা জানতে পেরেছেন পশ্চিমবঙ্গ-সহ অত্যন্ত অসুরক্ষিত এবং অসুরক্ষিত রাজ্যগুলির এই পরিণতি হওয়ার নেপথ্যে হাত রয়েছে কয়লা-চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া, গাড়ির জ্বালানির যথেচ্ছ দহন এবং অবশ্যই বিভিন্ন জৈব পদার্থকে পোড়ানো। দ্য গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ়-মেজর এয়ার পলিউশন সোর্সের ২০১৮ সালের রিপোর্ট বলছে, বাড়িতে বিভিন্ন কাজে জৈবপদার্থ (যেমন- গোবর বা শুকনো ডালপালা) এবং বিভিন্ন কারণে আবর্জনা পোড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বায়ু দূষণের পেছনে। তার পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল বা কারখানা থেকে বেরনো ধোঁয়া, শস্যজাত আবর্জনাকে পোড়ানো তো এরোসল বাড়ার কারণ হিসেবে রয়েছেই।

ইন্টারন্যাশানাল এনার্জি এজেন্সির রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতে অকালমৃত্যুর হার হু হু করে বাড়ছে দ্রুত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে। তার দোসর হয়েছে তাপউৎপাদনকারী প্ল্যান্ট ও যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ু দূষণ কমানোর জন্য ভারত সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ‘ন্যাশানাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম" (NCAP)। NCAP-এর উদ্দেশ্য হল বাতাসে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা বা পার্টিক্যুলেট ম্যাটারের পরিমাণ কমানো। এই পার্টিক্যুলেট ম্যাটারগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে PM2.5 ও PM10-কে ।

তবে মূলত ভারতবর্ষ দূষণ-কবলিত শহরগুলির দূষণ নিয়ন্ত্রণেই গুরুত্ব দেয়। শহরতলি বা গ্রামাঞ্চলের দূষণ নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর না দেওয়ায় দেশে  সামগ্রিক ভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। আর তার ফলে এ দেশে সামগ্রিক ভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। ‘দ্য হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউটের’ ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, শহরাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চল দুই জায়গাতেই বাতাসে পার্টিক্যুলেট ম্যাটারের পরিমাণ হু হু করে বাড়ছে। গাঙ্গেয় সমতুলভূমির গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যা এবং ঘরবাড়ি বাড়ায়, গ্রামের বাতাসেও এখন পার্টিকুলেট ম্যাটারের দাপট দেখা যাচ্ছে।

 

More Articles