আমুলগার্লের হাত ধরেই অমরত্বের নৌকায় পা রাখলেন সিলভেস্টর ডাকুনহা

Amul Girl: আমুল গার্লের সঙ্গে সঙ্গেই অমরত্বের নৌকায় উঠে পড়লেন ডাকুনহাও। ভারতীয় বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় আমুল গার্লের মতোই তিনিও থেকে যাবেন আজীবন।

একসময় ভারতে দুধের ব্যবসায় একচেটিয়া ছিল ব্রিটিশদের। সেই সময় দেশে শ্বেতবিপ্লব এনেছিলেন ভার্গিস কুরিয়েন। দুগ্ধব্যবসার আগাগোড়াটাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সংস্থা পোলসন ডেয়ারিকে পিছনে ফেলে উঠে এসেছিল গুজরাটের দেশীয় একটি সংস্থা। ঠিক তেমন ভাবেই বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সিলভেস্টর ডাকুনহা নামে এক ব্যক্তি। আর এই দু'জনকে একটি সুতোয় বেঁধে দিয়েছিল আমুল। প্রথমজন আমুলের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় জন আমুলকে পৌঁছে দিয়েছিলেন ভারতের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে। বলা ভালো, তাঁর তৈরি আমুলগার্ল পৌঁছে গিয়েছিল দেশের কোণায় কোণায়।

আসলে বিজ্ঞাপন মানে তো আর শুধুমাত্র একটি পণ্যের খবরাখবর দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া নয়। কার্যত একটি পণ্যকে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়াটাই উদ্দেশ্য বিজ্ঞাপনের। নব্বই পরবর্তী সময়ে দ্রুত বদলাচ্ছিল দুনিয়া। টিভি, রেডিওর রমরমা মানুষের সামনে খুলে দিচ্ছিল একের পর এক অজানার দ্বার। বিজ্ঞাপনের মেজাজ বদলাচ্ছিল, বদলাচ্ছিল ভাষা। বিজ্ঞাপন শুধু আর বিজ্ঞাপনের গণ্ডিতে আটকে ছিলনা ততদিনে। বরং অবয়বে, শরীরে ক্রমশ শিল্পের কাছাকাছি স্তরে উন্নিত হয়েছিল বিজ্ঞাপন। নব্বই পরবর্তী সময়ে এমন অনেক বিজ্ঞাপনের কথাই আমাদের মনে পড়ে, যা বসে রয়েছে দর্শকের মনের মণিকোঠায়। তার ট্যাগলাইন থেকে জিঙ্গল, আজও ঠোঁটস্থ মানুষের। 'বঙ্গজীবনের অঙ্গ বোরোলিন' হোক বা কাপড়কাচা সাবান 'নিরমা', আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে সেই সব বিজ্ঞাপন। গান বা কথার মতোই মানুষের মনে গেঁথে থাকে দৃশ্যও। আর ঠিক সেই জায়গাতেই ঘা দিয়েছিল আমুল।

আরও পড়ুন: স্বদেশি আন্দোলন থেকে সিনেমা, দেশলাই‌ বাক্সেই লুকিয়ে পুরনো বিজ্ঞাপনের ভান্ডার

আমুল বললে তেমন কোনও ট্যাগলাইন বা জিঙ্গলের কথা মনে পড়বে না সহজে। তবে যেটা এক নিমেষে মনে পড়বে, তা হল একটি ফুটফুটে মেয়ের মুখ। ঠিক ধরেছেন, দুনিয়া যাকে চেনে আমুল গার্ল নামে। মাখন হোক বা দুধের প্যাকেট, এক মুখ হাসি নিয়ে সবসময় হাজির থেকেছে ওই খুদে। বিভিন্ন সময়ের শরিক হয়ে উঠেছে সেই মেয়েটি। অনুষ্ঠান, ঋতু, পরবের কথা মাথায় রেখে নানা রূপে আমাদের সামনে এসেছে সে। আর সেই আমুলগার্লেরই রূপকার ছিলেন সিলভেস্টর ডাকুনহা। যাঁর আঙুলের ছোঁয়ায় সেজে উঠত বিজ্ঞাপনের সেই কন্যা। আর আমুলের পণ্য পৌঁছে যেত দেশের প্রতিটি কোণায়।

চল্লিশের দশকে জন্ম সিলভেস্টরের। তাঁর রক্তে বিজ্ঞাপন। সিলভেস্টরের দাদা গারসন ডাকুনহা ছিলেন বিজ্ঞাপন জগতের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৬ সালে সিলভেস্টরের হাতে জন্ম হয় আমুলগার্লের। গুজরাটের কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন লিমিটেজ সংস্থা ওই বছর প্রথম বার বিজ্ঞাপনের ম্যাসকট তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। সেই কাজের বরাত পেয়েছিল অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড সেলস প্রোমোশন (এসএসপি) নামে একটি সংস্থা। প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা পোলসন ডেয়ারির এমনই একটি বাটার গার্ল ছিল। তাকে টক্কর দিতেই তৈরি হয়েছিল আমুল গার্ল। সে সময় এসএসপপি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন সিলভেস্টর, আর তাঁর আর্ট ডিরেক্টর ছিলেন ইওস্টেস ফার্নান্ডেজ। তাঁরা ঠিক করে ফেলেন, এমন কিছু বানাবেন, যা গৃহকর্ত্রীদের আকর্ষণ করবে। তখন গুজরাট কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশনের লিমিটেডজের চেয়ারম্যান ডক্টর ভার্গিস কুরিয়েন খোদ। তার সঙ্গে বসলেন সিলভেস্টরেরা। কুরিয়েনের পরামর্শে একটি ছোট্ট মিষ্টি হাতে আঁকা মেয়েই হয়ে উঠল আমুলের ম্যাসকট। কুরিয়েন চেয়েছিলেন, সহজসরল কোনও একটি ছবি, যা মানুষের মনে থেকে যাবে। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রেও সহজ হবে কাজটা। আসলে সেসময়ে বিজ্ঞাপন মানেই দেওয়াল লিখন। খুব জটিল কোনও ছবি বারবার একইরকম ভাবে আঁকা কঠিন হতে পারে। তাই সহজ কিছু চেয়েছিলেন তিনি।

পলকা ডটসের ফ্রক, নীল চুল আর মিষ্টি চাহনি। তার সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত সব ওয়ানলাইনার। শুরু হল আমুলের 'আটারলি বাটারলি' ক্যাম্পেন। আপামর দেশবাসীর ঘরের মানুষ হয়ে উঠতে দেরি হয়নি আমুল গার্লের। নানা মরসুমে, নানা সাজ ও বুদ্ধিদীপ্ত সব ট্যাগলাইন নিয়ে হাজির হত সে। দুধ পণ্যটির সঙ্গে যেহেতু বাচ্চাদের একটা যোগ রয়েছে, তাই জরুরি ছিল আমুলের ম্যাসকটকে তারাও যাতে পছন্দ করে। আর ঠিক সেটাই হয়েছিল। আমুলের পণ্য খুব সহজেই উঠে এসেছিল গৃহস্থের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে। এর আগে অবশ্য পোলসন মাখনের বেশ বাজার ছিল। তবে আমুল এসে মাখনের দুনিয়ায় কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। পণ্যের গুণমান যেমন তার একটি কারণ ছিল, অন্য কারণ ছিল অবশ্যই সেই বিজ্ঞাপনের মেয়ে। টিভি, খবরের কাগজ থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, আজও সেই জনপ্রিয়তায় টান পড়েনি এতটুকু।

প্রায় ষাট বছর ধরে আমুলের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে সিলভেস্টরের হাতে তৈরি সেই খুদে। উত্তরোত্তর আরও বেড়েছে আমুলের বাজার, বেড়েছে বিক্রিও। সময়োপযোগী নানা ওয়ানলাইনার নিয়ে বাজারে এসেছে আমুলগার্ল, এবং মন জিতে নিয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে রাজনীতি, সাফল্য থেকে দুঃসময়, কোনও কিছুই বাদ পড়েনি সেখানে।  ওই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গেই আমুলের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে সিলভেস্টরের নাম। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘসময় বাজারে টিকে থাকা বিজ্ঞাপন ম্যাসকট হিসেবে শীর্ষে উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টি। একই সঙ্গে বিজ্ঞাপনের জগতে এক অতুলনীয় এবং অপ্রতিরোধ্য নাম হয়ে উঠেছেন সিলভেস্টরও। যার কথা অনেক অনেক দিন মনে রাখতে বাধ্য হবে বিজ্ঞাপন দুনিয়া। বিজ্ঞাপন যে শুধুই কোনও একটি পণ্যের বাণিজ্যিকরণের পন্থা নয়, তার চেয়েও আরও বেশি, আরও দীর্ঘজীবী এক শিল্প, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন সিলভেস্টর।

আরও পড়ুন: শুধুমাত্র দাড়ির জন্য ব্লেডের বিজ্ঞাপন লিখতে রাজি হননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

২০১৬ সালে আমুল গার্লের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হয়েছিল বেশ বড় করেই। সেসময় পৃথিবী জুড়ে আরও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই বিজ্ঞাপনের মেয়ে। ২০২১ সালে মিজোরামের এক বছর চারেকের খুদে কন্যাকে ব্যবহার করা হয়েছিল আমুলের বিজ্ঞাপনে। ২০২০ সালে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল এস্থার নামে ওই খুদের গাওয়া একটি ভিডিও। সেখান থেকেই আমুলগার্ল হিসেবে উঠে আসে সে। পরে এস্থারের আদলে আমুলগার্লকে একবার সাজিয়ে তুলেছিল আমুল। জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই বিজ্ঞাপনও।

সময়ের আন্দাজে আমুল গার্ল দেখতে দেখতে আজ ৫৭। তার মতোই বয়সের ছাপ পড়েনি তার জনপ্রিয়তাতেও। সম্প্রতি পিতৃহারা হয়েছে সে। না-ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন বিজ্ঞাপন দুনিয়ার কিংবদন্তি সিলভেস্টর ডাকুনহা। গত ২০ জুন মুম্বইতে প্রয়াত হন তিনি। বয়স হয়েছিল আশি বছর। তবে এ রূপকথার শেষ নয় মোটেও। আসলে আমুল গার্লের সঙ্গে সঙ্গেই অমরত্বের নৌকায় উঠে পড়লেন ডাকুনহাও। ভারতীয় বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় আমুল গার্লের মতোই তিনিও থেকে যাবেন আজীবন। যতদিন আমুল থাকবে, ততদিন সিলভারস্টাইন ও তাঁর আমুলগার্লকেও ভুলতে পারবেন না কেউ।

More Articles