ধর্ম নয়, চাকরিই পথ! ত্রিপুরাতে কি এবার হারানো গড় ফিরে পাবে বামেরা?

Tripura Assembly Election 2023: রাজ্য ভাগাভাগি না করেই সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই আদিবাসীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে চায় বামেরা।

ভুখা পেটের লড়াইয়ের মূলগত জায়গা থেকে নড়েনি বামেরা। পশ্চিমবঙ্গেও নির্বাচনে বারেবারে চাকরির দাবি ও ক্ষমতায় এলে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতিই হয়ে উঠেছে হাতিয়ার। সারা দেশে বামেদের ঘাঁটি বলতে যা যা পরিচিত, কেরল বাদে সর্বত্রই লাল ঝান্ডা স্তিমিত। ত্রিপুরার মতো শক্তপোক্ত ঘাঁটি বিজেপি এসে ছিনিয়ে নেয় ২০১৮ সালে। সেই ত্রিপুরাতে ফের বিধানসভা নির্বাচন সমাগত। অসম, মণিপুরের মতো ত্রিপুরার মানুষও কি দ্বিতীয়বারের মেয়াদে বেছে নেবে বিজেপিকেই? বিজেপিকে ঠেকাতে সিপিআইএম কতখানি তৎপর এবার? ত্রিপুরার বিরোধী দল CPI(M)-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট গত শুক্রবার বিধানসভা নির্বাচনের জন্য দলীয় ইস্তেহার প্রকাশ করেছে। বিজেপির আগ্রাসনকে ঠেকাতে এখানেও বামেরা চাকরির প্রতিশ্রুতিকেই প্রাধান্য দিয়েছে, ক্ষমতায় এলে ২.৫ লক্ষ নতুন চাকরি, দরিদ্র প্রবীণ নাগরিকদের পেনশন, পুরনো পেনশন স্কিম ফেরানো এবং প্রতি বছর সরকারি কর্মচারীদের জন্য দু'টি ডিএ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বামেরা।

১৫ পাতার ইস্তেহারে ১০,৩২৩ জন ছাঁটাই হওয়া শিক্ষকদের পুনর্বহাল, চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের পরিষেবা নিয়মিত করা এবং উপজাতি পরিষদকে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বামেরা। বিজেপির জেপি নাড্ডা সম্প্রতিই দাবি করেছেন, ত্রিপুরা রাজ্যটি একসময় (বাম জমানায়) অবরোধ এবং বিদ্রোহের জন্যই পরিচিত ছিল। বিজেপি আসার পর থেকে রাজ্যের চতুর্দিকে কেবলই শান্তি, সমৃদ্ধি এবং উন্নয়ন। ত্রিপুরা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নারায়ণ কর অবশ্য বলছেন, ২০১৮ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে ত্রিপুরায় গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- ছাত্রীদের স্কুটি, আদিবাসীদের স্বাধীনতা- ত্রিপুরায় এবার যে মন্ত্রে জিততে চাইছে বিজেপি

বিজেপি এবং তার জোটসঙ্গী আইপিএফটির শাসনে ত্রিপুরার সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার খর্ব হয়েছে। জনগণ স্বাধীন মত প্রকাশে ভয় পান। যে ভয় কাটাতে পারে একমাত্র বামফ্রন্টই, দাবি লাল দলের। ত্রিপুরা যদি ফের বামেদের উপর আস্থা রাখে তাহলে আগামী পাঁচ বছরে আড়াই লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করবে বামফ্রন্ট, নির্দেশিকা অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদেরও নিয়মিত করা হবে। ৬০ বছরের বেশি বয়সী এবং বার্ষিক আয় ১ লক্ষ টাকার কম- এমন মানুষদের সামাজিক পেনশন দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে বামদলগুলি। ব্যাঙ্কিং, আইএএস এবং আইপিএস পরীক্ষার জন্য পেশাদার কোচিং সেন্টার স্থাপন এবং রাজ্যে সেনা নিয়োগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি চালু করারও আশ্বাস দিয়েছে বামেরা।

ত্রিপুরায় এই মুহূর্তে সরকারি কর্মচারী এবং পেনশনভোগীর সংখ্যা ১,৮৮,৪৯৪। ক্ষমতায় এলে উপভোক্তা মূল্য সূচকের ভিত্তিতে বছরে দু'বার সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) বৃদ্ধি এবং পুরনো পেনশন স্কিম ফের চালু করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বামফ্রন্ট। পাশাপাশি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য দরিদ্রদের বছরে ২০০ দিনের কাজের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে ইস্তেহারে। প্রতি পরিবারে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, ভূমিহীনদের জমি বরাদ্দ এবং সরকার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণের উপর নিষেধাজ্ঞাও এই ম্যানিফেস্টোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ত্রিপুরা উপজাতীয় অঞ্চল স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদকে (টিটিএএডিসি) আরও স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কথাও জানিয়েছে বামফ্রন্ট। উল্লেখ্য, এই বিষয়টি অর্থাৎ উপজাতিদের স্বাধীনতার বিষয়টিকেই এবার মূল হাতিয়ার করেছে বিজেপি।

বামফ্রন্টের দাবি, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সংবিধানের ১২৫ তম সংশোধনী মুলতুবি রাখলেও আদিবাসীদের কল্যাণের জন্য দীর্ঘ প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে, যা স্বভাবতই ভুয়ো। এই সংশোধনীটি অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের উপজাতীয় অঞ্চলগুলির প্রশাসনের জন্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা বলে। ত্রিপুরার অন্যতম দল টিপরা মোথার প্রধান প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মা পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছেন। এই প্রসঙ্গে বামেরা জানিয়েছে, বাম দলগুলিও তাই চায়, তবে তা রাজ্য ভাগাভাগি না করেই। ১২৫তম সাংবিধানিক সংশোধনী যা গত পাঁচ বছর ধরে সংসদে ঝুলে আছে তার সুরাহার দাবি উঠেছে এই নির্বাচনের আগে। রাজ্য ভাগাভাগি না করেই সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই আদিবাসীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে চায় বামেরা। তাঁদের দাবি, বাম শাসনামলেই রাজ্যে আদিবাসীদের কল্যাণ হয়েছিল।

আরও পড়ুন- ত্রিপুরা নির্বাচনে লড়বেন না আর! কেন এত বড় সিদ্ধান্ত প্রবীণ বামনেতা মানিক সরকারের?

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখও করেছে বামেরা। নির্বাচন পরবর্তী হিংসার আতঙ্ক থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতে এখন বামেদেরও রীতিমতো অহিংসার ঘোষণা করতে হচ্ছে! দলের সচিব জিতেন্দ্র চৌধুরী বলেছেন, বদলায় বিশ্বাস করে না বামেরা। পরিবর্তনেই বিশ্বাস তাঁদের। তাই মতভেদ থাকলেও শান্তির আবহেই বাঁচবেন তারা। সিপিআই(এম) রাজ্যে ক্ষমতায় এলে ত্রিপুরায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে 'কোনও প্রতিশোধ নেবে না', একথা এখন জোর গলাতে বলতে হচ্ছে বাম দলকেও। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সিপিআই(এম)-এর দুই দশকেরও বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটানোর পর ত্রিপুরায় রাজনৈতিক হিংসার ধারাবাহিক বৃদ্ধি ঘটেছে। বামেদের দাবি, ২০১৮ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে ত্রিপুরায় বামেদের অন্তত ২৪ জন নেতা নিহত এবং ৫০০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বিজেপি অবশ্য সিপিআইএমকেই রাজনৈতিক হিংসার সংস্কৃতির জন্য দায়ী করেছে।

সিপিআই(এম) এবারের নির্বাচনে ৪৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং অন্যান্য বাম দল- ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি এবং সিপিআই- একটি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। পশ্চিম ত্রিপুরার রামনগর কেন্দ্রে বামফ্রন্ট এক নির্দল প্রার্থীকে সমর্থন করছে। আসন ভাগাভাগির চুক্তি অনুযায়ী কংগ্রেস ১৩টি আসনে লড়ছে। ৬০ সদস্যের বিধানসভার জন্য ১৬ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে এবং ২ মার্চ গণনা হবে।

More Articles