এই গ্রামে নেই পুরুষের প্রবেশাধিকার! পৃথিবীতে মহিলাদের আশ্চর্য বসতির নেপথ্যে যে কারণ

Village of No Men: ১৯৮০-র দশকে মধ্য কেনিয়ায় ব্রিটিশ সেনাদের আক্রমণে সাম্বারু মহিলাদের উপর নেমে এসেছিল ‘ধর্ষণ মহামারী’৷

মাঝে মাঝেই সংবাদ চ্যানেলে উত্তেজিত সঞ্চালক আক্রমণের ভয়াবহতা বোঝাতে ‘পুরুষশূন্য গ্রাম’ শব্দের ব্যবহার করে থাকেন। সংবাদপত্রও থেমে থাকে না, গ্রাম কতটা ভয়ে, অসহায়তায় রয়েছে বোঝাতে এই শব্দবন্ধ প্রয়োগ করে। আসলে পুরুষহীন বাড়ি মানেই তা অনিরাপদ, তা সহজেই আক্রমণযোগ্য, তা সততই অসহায় কারণ মুখে ভাত তোলার মতো টাকা উপার্জনকারী সেখানে নেই। অসহায়, অবলা, ‘লাচার’- মহিলাদের ত্রাতা যেখানে অনুপস্থিত সেই ‘পুরুষশূন্য’ গ্রাম ও মহিলারা তাই করুণাযোগ্য। এই ধারণার গালে সপাটে থাপ্পড় কষিয়েছেন রেবেকা। উত্তর কেনিয়ার (যাকে সারা বিশ্ব পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বলেই জানি) সাম্বুরুর তৃণভূমিতে এমন একটি গ্রাম গড়েছেন রেবেকা, যা আক্ষরিক অর্থেই পুরুষশূন্য। এই গ্রামে কেবল বাস মহিলাদের, কোনও পুরুষ ত্রিসীমানায় ঘেঁষতেও পারেন না। গ্রামের নাম উমোজা, সোয়াহিলিতে যার অর্থ ‘ঐক্য’।

সাম্বুরু উত্তর-মধ্য কেনিয়ার নিলোটিক জনগোষ্ঠী। সাম্বুরুরা মূলত আধা-যাযাবর যারা প্রধানত গবাদি পশু পালন করে। চরম পিতৃতান্ত্রিক এই জনগোষ্ঠী মূলত বহুবিবাহবাদী। বংশ পরম্পরায় সাম্বুরু উপজাতির মধ্যে মহিলাদের যৌনাঙ্গ ছেদন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রথা। একবার যোনিচ্ছেদ হয়ে গেলে কিশোরীকে প্রায় ঠাকুর্দার বয়সী পুরুষের সঙ্গেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সাম্বুরু উপজাতিতে চিরকালই মহিলারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তাঁদের জমি বা অন্যান্য ধরনের সম্পত্তি যেমন গবাদিপশুর মালিকানাও দেওয়া হয় না, স্বাভাবিক মর্যাদাও না। প্রথানুযায়ী, মেয়ের বাবা একজন বয়স্ক ‘যোদ্ধা’ পুরুষকে বেছে নেন যার সঙ্গে মেয়ের অস্থায়ী বিবাহ হয়। এই বিয়েতে গর্ভধারণ নিষিদ্ধ, কিন্তু গর্ভনিরোধকও নেই। যদি ওই মেয়ে গর্ভবতী হয়, তবে তাঁকে জোর করে গর্ভপাত করানো হয়, যা করেন গ্রামের অন্যান্য মহিলারাই।

আরও পড়ুন- উলঙ্গ হয়ে ষাঁড় ধরা, ঠোঁট কেটে চাকতি বসানো, অবাক করবে আফ্রিকার আদিবাসীদের যেসব রীতি

রেবেকা লোলোসোলি

নিজের পরিবারেই যৌন নির্যাতন তো স্বাভাবিক ছিলই, তার উপর ১৯৮০-র দশকে মধ্য কেনিয়ায় ব্রিটিশ সেনাদের আক্রমণে সাম্বুরু মহিলাদের উপর নেমে এসেছিল ‘ধর্ষণ মহামারী’৷ সাম্বুরু উপজাতির ৫০০-৬০০ জন মহিলা কয়েক দশক ধরে লড়াই করেছেন এটা প্রমাণের জন্য যে তাঁরা সত্যিই ব্রিটিশ সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। ধর্ষণের ফলে যে মহিলাদের গর্ভধারণ হয়েছে এবং যাঁরা আর পাঁচটা আফ্রিকান শিশুদের চেয়ে হালকা গায়ের রঙের শিশুদের জন্ম দিয়েছে তাঁদের পরিত্যাগ করেছিল স্বামী ও পরিবার। ওই মহিলাদের গ্রাম ছেড়ে যেতেও বাধ্য করা হয়।

১৯৯০ সালে এই ধর্ষিতা, নির্যাতিতা আশ্রয়হীন মহিলাদের নিয়েই জন্ম নেয় উমোজা উয়াসো (সোয়াহিলি ভাষায় উমোজা মানে ঐক্য আর উয়াসো একটি নিকটবর্তী নদী)। এই গ্রাম সম্পূর্ণ মাতৃতান্ত্রিক। ১৫ জন মহিলার জন্য খানিক ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবেই এই গ্রাম গড়েছিলেন রেবেকা। যে গ্রামের অর্থনীতি, জীবনযাপন, আনন্দ-উৎসবে কোনও ঠাঁই নেই পুরুষদের। আন্দোলনের সূচনাকারী রেবেকা লোলোসোলি দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, “একজন নারী হিসেবে আপনার কোনও অধিকার নেই। স্বামী যদি আপনাকে খুন করতে চায় তবে যে কোনও সময় আপনাকে হত্যা করার অধিকার তার আছে কারণ নারী আসলে সম্পত্তির মতোই। লোকজন আমাদের গ্রাম ধ্বংস করতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা প্রতিরোধ করেছি। ওরা আমাদের মেরে ফেললেও আমরা এক ইঞ্চিও নড়ব না।”

রেবেকা উমোজা মহিলা গ্রামের মাতৃপতি এবং মহিলাদের অধিকারের রক্ষার জন্য নিয়মিত সওয়াল করে যান তিনি। ১৮ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে চারপাশের মহিলাদের দুর্দশা দেখে তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়া মহিলাদের সাহায্যের বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেন। মেয়ের এই জননেত্রী সুলভ মনোভাব মোটেই সুনজরের দেখার কথা নয়, ফলে বাড়িতে জোটে মারধর, স্বামীর নিগ্রহ। স্বামীকে ছেড়ে চলে আসেন রেবেকা। অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য উমোজা উয়াসো গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। উমোজা কেনিয়ার পিতৃতন্ত্রের মরুভূমিতে মহিলাদের জন্য হয়ে ওঠে এক নিরাপদ মরুদ্যান। প্রচুর হুমকি, আক্রমণের মুখে পড়েও ভেঙে পড়েনি এই গ্রাম।

আরও পড়ুন- চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি মানুষ! কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী ওটা বেঙ্গার কাহিনি সভ্যতার লজ্জা

এই গ্রামে নারী ও শিশুরা তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য নিয়মিত উপার্জন করেন। শিশুদের মধ্যে, ছেলেদের বয়স ১৮ বছর হলে, তাঁদের গ্রাম ছেড়ে যেতে হয়। অল্পবয়সী মেয়েদের তাঁদের পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়, কিন্তু গ্রামের বাইরে। যখন এই মেয়েরা গর্ভবতী হয়, তখন তাঁদের সন্তানরা গ্রামে থাকতে পারে কিন্তু পুরুষদের আঠারো বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতেই হবে। সমস্ত সিদ্ধান্ত সম্মিলিতভাবে সম্প্রদায়ের মহিলারাই নিয়ে থাকেন। যৌন হিংসা ও নির্যাতন থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে ওঠা উমোজা প্রায় ৫০ জন মহিলা ও ২০০ শিশুকে বেড়ে ওঠার সুস্থ পরিবেশ দিয়েছে।

বাইরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে উমোজাকে এখন কাঁটাতার দিয়ে আটকানো হয়েছে এবং মহিলারাই নিজেদের রক্ষা করার জন্য সারা রাত পাহারা দেন। উমোজার মহিলারা সাফারি পর্যটকদের জন্য ক্যাম্পসাইট চালান এবং পর্যটকদের গ্রাম পরিদর্শনের জন্য প্রবেশমূল্য নেন। গ্রামের মধ্যে, মহিলারা কারুশিল্প কেন্দ্রে রঙিন পুঁতির নানান অলঙ্কার এবং অন্যান্য জিনিস তৈরি করে বিক্রি করেন। বয়স্ক মহিলারা ছোটদেরকে মেয়েদের যৌনাঙ্গ ছেদ, জোর করে গর্ভপাত ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষা দেন, এককালে যেগুলির শিকার হয়েছেন তাঁরা। এখানেই শেষ নয়, উমোজাতে মহিলারা নিজস্ব জমিতে একটি স্কুলও তৈরি করেছেন। রেবেকার নিজের মেয়ে এখন জার্মানিতে পড়াশোনা করেন। ‘পুরুষশূন্য’ গ্রাম আসলে হয়ে উঠেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতার খোলা বারান্দা। যেখানে আদিবাসী মহিলাদের নিজস্ব তন্ত্র তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখেনি, মর্যাদার সহজ পাঠ শিখিয়েছে।

More Articles