জলের নিচে যোগাসন! সাধারণ ব্যায়ামের থেকে বহুগুণে বাড়াবে মনোবল

জীবনে নতুনভাবে বাঁচার জন্য যোগাসন অত্যন্ত জরুরি। হতাশা, মানসিক অবসাদ কাটানোর পাশাপাশি মনকে শান্ত রাখতেও যোগাসন গুরুত্বপূর্ণ। জলের নিচে করা যোগাসন মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।

 

প্রতিদিন সকালে উঠে শারীরিক কসরত করতে কারই বা ভালো লাগে? এর থেকে শুয়ে শুয়ে বই পড়া, মোবাইল ঘাঁটা, ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করা অনেক বেটার। সকালে উঠে ব্যায়ামের কথা ভাবা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই বিরক্তিকর। কিন্তু সকালে ব্যায়াম করে শরীর ঘামানো যতই অপছন্দের হোক, সুস্থ থাকতে ব্যায়ামের বিকল্প আর নেই। তাই যাঁরা ওয়ার্কআউট করতে পছন্দ করেন না, তাঁদের জন্য যোগাসন বেস্ট অপশন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যোগাসন এখন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর হবে নাই-ই বা কেন? যোগব্যায়ামের দ্বারা তৈরি হওয়া মনঃসংযোগ যে কতটা উপকারী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শরীর আর মন চাঙ্গা রাখতে যোগব্যায়াম অনন্য।

যোগাসন কবে থেকে শুরু হয়েছে, এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। কিছুদিন আগেও পশ্চিমের শিক্ষিতরা এটাই বিশ্বাস করতেন যে, যোগাসন আবিষ্কৃত হয় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যখন বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রপাত হয়। যদিও, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর সর্বশেষ খননকার্যের ফলে যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাতে যোগাসনের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবিও আছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে, খ্রিস্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগেও যোগাভ্যাসের প্রচলন ছিল। সে যাই হোক, আমাদের সুবিধের জন্য আমরা যোগাসনের ইতিহাসকে ৬টি যুগে ভাগ করে নিয়েছি। আমরা এই আধুনিক যুগে যে যোগাসন করি, তার সঙ্গে হয়তো পুরনো কোনও যুগের ব্যায়ামের মিল নেই কিন্তু অনেকের অনুমান, পতঞ্জলির যোগব্যায়ামের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের আধুনিক যোগব্যায়াম তৈরি হয়েছে।

২১ জুন, ২০২২-এ ছিল আন্তর্জাতিক যোগব্যায়াম দিবস। এই বছরের থিম ছিল ‘Yoga for Humanity’। যোগব্যায়ামের ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্বিত। প্রাচীনের সঙ্গে নতুনের মিলন সবসময়ই কিছু না কিছু সুন্দর জিনিসের সৃষ্টি করে। যোগব্যায়ামের।ইতিহাসে তাই নতুন এক সংযোজন হলো ‘আন্ডারওয়াটার যোগাসন’। নামে যেমন নতুনত্ব, তেমনই এই যোগাসন অন্য যোগাসনের থেকেও একটু ভিন্ন।

আরও পড়ুন: নতুন জীবন দেবে এই অভ্যাস, সুস্থ থাকতে আজও যোগাসনের বিকল্প নেই

প্রত্যেকদিন একই বোরিং যোগাসন করতে করতে মন খারাপ? তাহলে আর কী, নিজের শরীর, মন আর আত্মাকে সতেজ করতে ঝাঁপ দিন সুইমিং পুলে। জলের নিচে ওয়ার্কআউট বেশিরভাগ মানুষের কাছেই নতুন বিষয় নয়। গবেষণাতেও দেখা গেছে যে, জলের নিচে ওয়ার্কআউট করলে আমাদের ওজন কমে, টোনড মাসল ও স্ট্যামিনা বাড়াতেও সাহায্য করে। এই আন্ডারওয়াটার যোগা-র বিশেষত্ব হল এই যোগাসনে।জলের নিচে থাকাকালীন যোগব্যায়ামের নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। শরীর ফিট রাখতে আর মনোবল বাড়াতে শরীরচর্চার আরেক নাম এই আন্ডারওয়াটার যোগা। জলের নিচে দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাস ধরে রাখা এক অভিনব ক্ষমতা। সকলের তা থাকে না। যারা সুইমিং করতে ভালবাসেন, তাদের পক্ষে জলের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস ধরে রাখা সহজ।

হরিয়ানার হিসার জেলার আর্য নগর গ্রামের কমল কালোই দীর্ঘদিন ধরে জলের নিচে যোগব্যায়াম করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন। তবে তিনি শুধু তাঁর গ্রাম বা রাজ্য নয়, সারা বিশ্বে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। কমল কালোইয়ের দাদা সতেন্দ্র কালোইয়ের কথায়, কমল কালোই দেশের প্রথম যোগব্যায়াম শিক্ষক, যিনি গিনেস বুকে নিজের নাম নথিভুক্ত করেছেন। প্রানায়ামের মাধ্যমে তিনি শ্বাসপ্রশ্বাসকে এতটাই শক্তিশালী করেছেন যে, তিনি ৮ মিনিটের জন্য জলের নিচে শ্বাস আটকে রাখতে পারেন। তিনি জলের নিচে যে যে যোগব্যায়ামগুলি করেছিলেন, তা হল ধনুরাসন, পরিবৃত্ত জুন শীর্ষাসন, হনুমানাসন, উপবিষ্ঠ কোনাসন, পূর্ণচক্রাসন ইত্যাদি। কমল কালোইয়ের কথায়, মেঝেতে বসে যে আসনগুলো কঠিন মনে হয়, জলের নিচে সেই আসন করা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। জলের চাপে শরীরের ওপরেও চাপ পড়ে যার ফলে হাত-পা চালাতে অনেক শক্তির ক্ষয় হয়। যত সময় বাড়তে থাকে, তত অক্সিজেন কমতে থাকে আর সেই সঙ্গে শরীরের শক্তিও আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকে।

আন্ডারওয়াটার যোগব্যায়ামের সুবিধা

আমরা সবাই জানি যে, নিয়মিত যোগব্যায়াম করলে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা কমায়, ফ্যাট কমে এবং শরীরকে ফ্লেক্সিবল করে তোলে। কিন্তু জলের নিচে যোগব্যায়াম, মাটিতে বা মেঝেতে করা যোগব্যায়ামের তুলনায় আরও বেশি সুবিধা দেয়।

১. মানসিক চাপ কমায়

আজকের দিনে মানসিক চাপ এক গুরুতর সমস্যা। তরুণ থেকে প্রবীণ, সকলেই এই মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে ওষুধ নয়তো রিহ্যাবের দ্বারস্থ হন। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য যা মোটেই উপকারি নয়। মানসিক চাপ থেকে অবসাদ, বিষণ্ণতা আসে। আর যোগাসনের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ নতুন নয়। তবে জলের নিচে মেডিটেশন করার কৌশল অবলম্বন করে হতাশা কাটানো সম্ভব।

২. শারীরিক ভারসাম্য বজায়

জলের নিচে থাকাকালীন জল একটি বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের শরীরকে ঊর্ধ্বমুখে ঠেলে দেয়। তাই এই ধরনের পরিবেশে জটিল যোগব্যায়াম করা অনেক সহজ হয়ে যায়। একজন লো স্ট্যামিনা এবং মিনিমাম ফ্লেক্সিবিলিটির ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই আন্ডারওয়াটার যোগাসন ‘শাপে বর’-এর মতো কাজ করে।

৩. হার্ট সুস্থ রাখে
জলের নিচে থাকলে নাকি আমাদের হার্ট ভালো থাকে। জলের নিচে থাকাকালীন জল আমাদের শরীরের সমস্ত অংশে সমানভাবে চাপ সৃষ্টি করে যার ফলে হৃদপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন সহজ হয়। অন্যদিকে জল আমাদের রক্তচাপ এবং হার্ট রেট কমিয়ে দেয়, যা আমাদের স্ট্যামিনা তৈরিতে সাহায্য করে।

৪. শ্বাসকষ্ট কমায়
শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি দূর করতে আন্ডারওয়াটার যোগাসন করতে পারেন। সাঁতার আর ডাইভিং-এর মতো জলের নিচে শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষমতা বাড়াতে এই যোগাসন কার্যকর।

কী করবেন আর কী করবেন না
এই যোগব্যায়াম যতই আকর্ষণীয় বা উত্তেজনা সৃষ্টিকারি হোক না কেন, যে কোনও যোগব্যায়ামই যদি সঠিক উপায়ে না করা হয়, তাহলে তা ভালোর থেকে ক্ষতি করে বেশি। যোগাসন এক্সপার্ট আম্রপালি পাটিলের কথায়, “যোগব্যায়াম হলো মন-শরীরের আত্মার মিলন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল, যাকে আমরা প্রাণায়াম বলে থাকি। এটি আমাদের শরীরে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড আদানপ্রদানের ওপর ফোকাস করে।" কিছু মানুষ এই যোগাসন সুইমিং পুলে করেন, কেউ আবার জলের নিচে ১২-১৫ মিটার গভীরে গিয়ে এই যোগাসন করা পছন্দ করেন। তবে তাঁর মতে, বুক অবধি জলেই এই যোগাসন করা সবথেকে ভালো।

যোগাসন যত বেশি কঠিন হবে, তত বেশি মানসিক শান্তি অর্জন করতে পারবেন। আমাদের দেশে এই আন্ডারওয়াটার যোগাসন কনসেপ্টটি নতুন হলেও ২০২০ সালের ১ মে দুবাইতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অনলাইন আন্ডারওয়াটার যোগাসন। সম্প্রতি একটি খবর থেকে জানা যায় যে, মালদ্বীপে একটি জলের নিচে থাকা রেস্তোরাঁ ভেঙে ফেলে সেখানে আন্ডারওয়াটার যোগাসন শেখানোর কথা ভাবা হচ্ছে। আর শুধু যোগাসন করা মানুষই নয়, সমুদ্রের নিচে থাকা কচ্ছপ, ডলফিন, হাঙরও আপনাকে ঘিরে থাকবে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

জীবনে নতুনভাবে বাঁচার জন্য যোগাসন অত্যন্ত জরুরি। হতাশা, মানসিক অবসাদ কাটানোর পাশাপাশি মনকে শান্ত রাখতেও যোগাসন গুরুত্বপূর্ণ। জলের নিচে করা যোগাসন মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। জলের নিচে অনেকক্ষণ বসে যোগব্যায়াম করা আমাদের ধৈর্যের আরেক পরীক্ষা বলতে পারেন, যা আমাদের স্থির হতে শেখায়। গরমকালে জলের নিচে যোগব্যায়াম অনেক প্রচলিত। কিন্তু যারা নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন, তাঁরা সারা বছর ধরে এই যোগাসন করতে পারেন। তবে যাঁরা জলে অভ্যস্ত নন, তাঁরা অবশ্যই বিশেষজ্ঞর সাহায্য ছাড়া জলের নিচে যোগাসন করতে যাবেন না, তাতে হিতে-বিপরীত হতে পারে।

 

More Articles