"না খেতে পেয়ে মরার চেয়ে ইজরায়েলে মরা ভালো,' পরিযায়ী শ্রমিকদের কেন যুদ্ধের দেশে পাঠাচ্ছে ভারত?

Haryana Unemployment : প্রতি মাসে ১.৩৭ লাখ টাকার বেতনের প্যাকেজে ইজরায়েলে পাঠানো হবে এই শ্রমিকদের।

যুদ্ধ শেষ হয়নি। ইজরায়েল গাজার উপর হামলা চালিয়েই যাচ্ছে। গত ৭ অক্টোবর প্রথম ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস ইজরায়েলে মিসাইল হামলা করেছিল। তারপর থেকে গাজাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে ইজরায়েল। দুই দেশই যুদ্ধের ঘা নিয়ে রয়েছে। আর এই যুদ্ধের দেশেই ভারত থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠাচ্ছে দেশ। নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করার জন্য ইজরায়েলে পাঠানো হবে ভারতের শ্রমিকদের। সরকারি একটি কর্মীনিয়োগ কেন্দ্র থেকে ইজরায়েলে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এই ঘোর যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইজরায়েল? কাজ করতে চাওয়া শ্রমিকরা বলছেন, হরিয়ানায় থাকার চেয়ে যুদ্ধের দেশে চাকরি নিয়ে মরে যাওয়াও ভালো।

হরিয়ানার কয়েকশো বেকার যুবক, রোহতকের মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই স্কিল টেস্টে নেমেছেন। এই যুবকদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু স্নাতকোত্তর। তাও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে নিজেদের দক্ষতা পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন তারা। তাদেরই একজন জিতেন্দর সিং। কুরুক্ষেত্রের পেহোয়ার বাসিন্দা। স্নাতক তিনি। হরিয়ানা রোজগার কৌশল নিগম লিমিটেডের মাধ্যমে একটি চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। দুই মাসের মধ্যে সেই চাকরি চলেও যায়।

জিতেন্দর বলছেন, হরিয়ানায় কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি সবাই জানেন। সুদূর ইজরায়েলে চাকরির প্রতিশ্রুতি মিলেছে। তাই নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। কোনও চাকরি না থাকার চেয়ে যে কোনও জায়গায় চাকরি পেয়ে চলে যাওয়া ভালো। জিন্দের রোহতাশ কুমারও একই মনে করছেন। জিন্দের চৌধুরী রণবীর সিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়েছিলেন রোহতাশ। বিশ্বের কী পরিস্থিতি তিনি জানেন, তিনি জানেন হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ইজরায়েলের অবস্থা ঠিক কেমন, তা নিয়ে তিনি সচেতন। তবে ইজরায়েলে না মরলে হরিয়ানায় মরবেন। এই রাজ্যে চাকরি না পেয়ে খিদেয় মরে যাওয়ার চেয়ে ইজরায়েলে কাজ করতে গিয়ে মারা যাওয়া ভালো, স্পষ্ট জানাচ্ছেন তিনি। কর্নালের অন্য একজন প্রার্থী বলছেন, বিদেশে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্ব ভারত সরকার নেবে বলেই আশ্বস্ত করা হয়েছে তাদের।

আরও পড়ুন- মাসের ১৫ দিনেই ৭,৫০০ কর্মী ছাঁটাই! যে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আইটি কর্মীরা

কিছু প্রার্থী আবার এই নিশ্চিত চাকরির প্রতিশ্রুতিতে এজেন্টদের ১.৫ লাখ টাকা দেওয়ার দাবিও করেছেন। রাজস্থানের সিকারের মণীশ কুমার জানাচ্ছেন, একজন এজেন্ট ইজরায়েলে ঠিকা শ্রমিকের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য ১.৫ লক্ষ টাকা চেয়েছেন তার থেকে। একইভাবে, রাজস্থানের চুরুর রামনিবাস জানাচ্ছেন, প্রথমে সিকারে একটি ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন তিনি এবং তার সঙ্গে আরও কয়েকজন। তাদের বলা হয়েছিল, ভারত ছাড়ার আগে রোহতকে আরেকটি ইন্টারভিউ হবে। ওইটাই শেষ। ইজরায়েলে এই কাজ পাওয়ার জন্য ১.৫ লক্ষ টাকাও দিতে বলা হয়েছিল।

মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা আবিদ আলি জানাচ্ছেন, হরিয়ানা এবং বাইরের প্রার্থীদের নথিপত্র যাচাই করতে এবং দক্ষতা পরীক্ষার করতেই ডাকা হয়েছিল। এই তথ্য যাচাইয়ের ভিত্তিতে, পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। HRKNL রাজ্য সরকারের জারি করা বিজ্ঞাপন মেনেই এই নিয়োগের কাজ করছে। আবেদনকারীদের প্লাস্টারিং, লোহার বার বাঁকানো, টালি মেরামত এবং কাঠের কাজের দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।

পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে, প্রতি মাসে ১.৩৭ লাখ টাকার বেতনের প্যাকেজে ইজরায়েলে পাঠানো হবে এই শ্রমিকদের। ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫০০ জনেরও বেশি চাকরি প্রার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। মহর্ষি দয়ানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৫৫০ প্রার্থী, বেশিরভাগই হরিয়ানা, রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশের।

রোহতকের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপের কাছে বসে ডাক আসার অপেক্ষায় ছিলেন ২২ বছরের অশ্বিনী কুমারও। ইজরায়েলে বার বেন্ডারের চাকরির জন্য 'দক্ষতার পরীক্ষা' দিতে এসেছেন তিনি। বিদেশে চাকরি তার কাছে সুবর্ণ সুযোগ। স্নাতকের পাট চুকিয়েছেন হরিয়ানার কাইথালের বাসিন্দা অশ্বিনী কুমার। জানিয়েছেন, তার অনেক বন্ধুই বিদেশে যাওয়ার জন্য এজেন্টদের লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েছে, সবটাই অবৈধভাবে। কোন দেশে যেতে চান তার উপর নির্ভর করে এজেন্টরা ২০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা অবধি চায়! এখানে সরকারকে ১০,০০০ টাকা দিতে হবে আর নিজের জন্য ফ্লাইটের টিকিট কিনতে হবে। এর আগে একটি বেসরকারি নির্মাণ সংস্থায় দুই বছর কাজের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার।

আরও পড়ুন- ২ কোটি চাকরি কোথায়? ১০ বছরে দেশের বেকারদের অবস্থা কী? ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ্যে

এই মুহূর্তে গ্রামে অল্প সময়ের ঠিকাদারের সঙ্গে কাজ করে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা রোজগার তার। ফলে ইজরায়েলের চাকরি তো সুবর্ণ সুযোগই! “যুদ্ধ হচ্ছে মানে তো এই নয় যে পুরো দেশটাই অনিরাপদ," বলছেন অশ্বিনী। ইজরায়েলের টাকায় প্রতি মাসে ১.৩৭ লক্ষ টাকা, প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ এবং সর্বোচ্চ ৬৩ মাসের মেয়াদে কাজ। পাশাপাশি এই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বীমা এবং পিএফও রয়েছে!

রাজস্থানের চুরুর নেমি চাঁদ জানিয়েছেন, রাজ্যের বেশিরভাগ প্রার্থী এর আগে ৮-১০ বছর ধরে বিদেশে কাজ করেছিলেন। টাইলস মিস্ত্রির চাকরির জন্য আবেদন করা ৩৮ বছর বয়দি নেমির কাছে 'ভয়' বলে কিছু নেই। তার দাবি, তার জেলার কিছু মহিলা ডাক্তারি পড়ুয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইজরায়েল থেকে ফিরে এসেছিলেন এবং নিউজ চ্যানেলকে জানিয়েছিলেন "তারা সেখানে নিরাপদ ছিলেন।" যুদ্ধ তো চিরকাল থাকবে না, খিদে থাকবে। তাই যে দেশেই হোক না কেন চাকরির জন্য যাবেন তিনি। তিনি আরও জানান, ওয়ার্কশপে ইজরায়েলের কর্মীদের ছোট ছোট ভিডিও দেখানো হয়েছিল তাদের, বলা হয়েছিল ইজরায়েল আসলে নিরাপদ জায়গা।

রোহতকের হরিয়ানা সিআইটিইউ সহ-সভাপতি সতভীর সিং এই নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন। সতভীর বলছেন, বেকার যুবকদের বিদেশে উজ্জ্বল সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকার আসলে বিভ্রান্ত করছে তাদের। ঠেকে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে। শ্রমিক সংগঠনগুলো এর বিরোধিতা করলেও, রাজ্যের বেকার যুবকদের কাছে এই মুহূর্তে অন্য কোনও উপায় নেই।

More Articles