দুর্যোধনের ভাই হয়েও দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় প্রতিবাদ! ব্যাতিক্রমী বিকর্ণ রয়ে গেলেন নিভৃতেই
Bikarna Mahabharat: বিকর্ণই একমাত্র কৌরব যিনি রাজসভায় দুর্যোধন যখন যুধিষ্ঠির তথা পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদীর অপমান করছিলেন তখন তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।
দ্যুতসভা। শকুনির পাশার চালে যুধিষ্ঠির পথের ভিখারি। পাশা খেলায় সব খোয়া গেছে তাঁর। এমনকী ভাইদের বাজি রেখেও হেরেছেন। তখন সর্বহারা যুধিষ্ঠিরকে শকুনি বললেন, “কেন এবার দ্রৌপদী! তাঁকে পণ রেখে যদি যেতেন!’’ কী সাংঘাতিক চাল! আসলে কৃষ্ণাকে সেই সভায় অপমান করাই ছিল উদ্দেশ্য। এবারও যুধিষ্ঠির জিততে পারলেন না। সভায় দীর্ঘশ্বাস পড়ল, অন্যদিকে দুর্যোধন ও তাঁর বন্ধুরা আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। ধৈর্য হারিয়ে দুঃশাসন ছুটে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে দ্রৌপদীকে টানতে টানতে নিয়ে এলেন সভায়। দুর্যোধনের দল হইহই করে বলতে লাগলেন, “দ্রৌপদী এখন রানি কোথায়, সে তো এখন দাসী। আমাদের ভজনা করবে।” এই বিপদে দ্রৌপদী সখা কৃষ্ণের নাম করতে লাগলেন। তখনই শোনা গেল বিকর্ণর কণ্ঠস্বর। দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিবাদ করলেন একশ ভাইয়ের এই একজনা।
“খল শকুনি দেখছে সবই, বস্তুত সে ধ্বংস চায়,
ঘরের মাটি লাল হয়ে যাক, দেশবিভাগের যন্ত্রণায়।
সুশীল সভায় ঘটছে যখন, রাজঅপরাধ জঘন্য,
ঠিক তখনই তার বিরোধে, চেঁচিয়ে ওঠেন বিকর্ণ।”
মহাভারতের কথা অমৃতসমান। যেমন তার বিস্তার, তেমনই বিচিত্র তার চরিত্রসমূহ। মহাকাব্যটি পৌরাণিক সময়কে ধারণ করে রইলেও আজকের দিনেও তাকে মনে হয় আধুনিক। মহাভারতের আলোয় তাই আজও বিচার করা যায় সমকালকে। তাই বিকর্ণ কেবল মহাকাব্যিক চরিত্র নয়, তিনি এই সমাজেরও প্রতিনিধি। যুগে যুগে যাজ্ঞসেনীদের অপমানের প্রতিবাদে বিকর্ণদের দরকার পড়েছে। তাই সবাইকে একবার হতেই হবে বিকর্ণ, এমনটাই বলেছিলেন কবি আর্যতীর্থ। কেন?
“সব যুগে বিকর্ণদের প্রয়োজন। বিকর্ণ কারা? ক্ষমতাসীন দলের মধ্য থেকে যাঁরা ভাবতে পারেন যে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। আমরা দেখি, যে যেই পতাকার নিচে থাকেন, মানে দেশ হোক, ধর্ম হোক, বা পাড়ার ক্লাব হোক, তিনি সেটাকে অন্ধভাবে সমর্থন করেন। বিকর্ণ ঠিক এই খানে আলাদা। এমন নয় যে তিনি সব ব্যাপারে প্রতিবাদী, বিরোধী। তাঁর একটা পক্ষ আছে, সেটা বেশিরভাগ সময় ক্ষমতাশালীর দিকে। তবুও যখন অন্যায় হয়, সংখ্যাগুরুর মত না নিয়ে তিনি প্রতিবাদে গলা তোলেন।”
আরও পড়ুন-ভাইদের ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে! ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র হয়েও কেন এত অবহেলিত যুযুৎসু
বিকর্ণ হলেন মহাভারতে বর্ণিত তৃতীয় কৌরব, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর পুত্র এবং যুবরাজ দুর্যোধনের ভাই। দুর্যোধনের কাছে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির তাঁর রাজ্য সহ সব কিছু হারিয়ে ফেলেন। বিকর্ণই একমাত্র কৌরব যিনি রাজসভায় দুর্যোধন যখন যুধিষ্ঠির তথা পাণ্ডবদের স্ত্রী দ্রৌপদীর অপমান করছিলেন তখন তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর যে শতপুত্র জন্মগ্রহণ করে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ধার্মিক ছিলেন বিকর্ণ। দুর্যোধনের ভাই হলেও তিনি, তাঁর বাকি ভাইদের মতো বদমেজাজি ও অহংকারী ছিলেন না। পাণ্ডবদের পাশাখেলায় পরাজয়ের কারণে সভামধ্যে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময়ে ধৃতরাষ্ট্র আর এক বৈশ্য দাসীর পুত্র যুযুৎসু ছাড়া একমাত্র প্রতিবাদ করেছিলেন তিনিই। এমনকী প্রতিবাদে তিনি সেই সভাস্থলও ত্যাগ করেন। অবশ্য তাঁকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন রাজার পার্ষদরা। এটা কি সিংহাসনের প্রতি আনুগত্য?
পরবর্তীতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও তিনি কৌরব পক্ষের হয়ে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন। ভীম কৌরবদের একশো ভাইকে বধ করার পণ নিয়ে যখন কুরুক্ষেত্রকে প্রায় শ্মশানে পরিণত করেছেন, তখন বিকর্ণ তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে আহ্বান জানান। ভীম কিছুকাল ভাবেন, তাঁর সভার কথা মনে হতে তিনি বিকর্ণকে বলেন, “তুমি একমাত্র কৌরব যে জানো ধর্ম কী, তুমি সরে দাঁড়াও আমি তোমাকে বধ করতে চাই না। তুমিই একমাত্র যে সেই সভায় দুর্যোধনের প্রতিবাদ করেছিলে।” কিন্তু বিকর্ণ বলেন, “আজ আমার সরে যাওয়াটাও অধর্ম হবে, আমি জানি কৌরবদের এই যুদ্ধে জয়লাভ কোনওদিনই হবে না যেহেতু বাসুদেব কৃষ্ণ পাণ্ডব পক্ষে আছেন, কিন্তু আমি আমার সকল ভাই এবং জ্যেষ্ঠ ভাই দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করতে পারব না। আমি ধার্মিক কিন্তু বিভীষণ নই। আমাকে যুদ্ধ করতেই হবে।” তিনি আরও বলেন, “সেই সভাস্থলে আমার যা কর্তব্য ছিল করেছি কিন্তু এখন আমার কর্তব্য আমার ভাইদের রক্ষা করা। তাই এসো আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব কর বৃকোদর ভীম।” এই কথা শোনার পর ভীম ও বিকর্ণর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। বিকর্ণ বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন- প্রবল প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই একে অন্যকে অভিশাপ! কচ ও দেবযানীর যে আখ্যান শিহরণ জাগায়
এইখানেই শেষ হতে পারত বিকর্ণ-নামা। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, কেন তিনি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করলেন অধর্মী দুর্যোধনের পক্ষে, যাঁর বিরোধে একসময় তিনি প্রতিবাদের কণ্ঠ ছেড়েছিলেন? কৌরব হয়েও দাসীপুত্র যুযুৎসু ও বিকর্ণ ছাড়া কেউই ন্যায়ের পথে হাঁটেননি। দুর্যোধনের তৃতীয় ভাই হওয়া সত্ত্বেও সিংহাসন প্রাপ্তির লোভ তাঁর ছিল না। তাহলে তো তিনি শেষ মুহূর্তে পাণ্ডবদের দিকে ভিড়ে যেতে পারতেন। যুদ্ধের আগে পক্ষ চয়নের সুযোগ তো তাঁর ছিল। কিন্তু সেটা তিনি করেননি। ধর্মের পক্ষে থেকে যে বিকর্ণ দ্যুতসভায় দ্রৌপদীর হয়ে চেঁচিয়েছিলেন, সভাস্থল ছেড়েছিলেন, কুরুক্ষেত্রের ময়দানে তিনি শেষপর্যন্ত ভ্রাতৃধর্ম পালন করলেন। সেই জন্য যুগ কাল পেরিয়েও আদর্শের নাম বিকর্ণ। সমগ্র নারীজাতির হয়ে তিনিই একমাত্র কণ্ঠস্বর। একলা হলেও আজও বোধ, বিবেক ও চেতনার প্রতীক একশো ভাইয়ের একজনা।
আজ এই দেশে মহিলাদের নড়বড়ে অবস্থা, বালিকার যৌন নিগ্রহের হাড়হিম করা প্রতিবেদনগুলি তার প্রমাণ। এই অবস্থায় মহিলাদের নিজস্ব চিৎকার, নিজস্ব রাগকে শক্তি দিতে বিকর্ণদের প্রয়োজন পড়বেই। শেষবেলায় গলা তুলে বলতে হয়-
“অত্যাচারের সামনে এলে, সঙ্গী শুধু চোখের জল
পোষ্যভাবে জাবনা চেবাই, অন্ধ এবং নি-কর্ণ,
প্রার্থনা থাক আমরা যেন, একবার হই বিকর্ণ।
মরার আগে হতেই হবে, রাজার সভায় বিকর্ণ।”