ছেলের থেকে যৌবন ধার! যযাতির জরাতেই লুকিয়ে মহাভারতের পারিবারিক যুদ্ধের বীজ?

Myth of Yayati: শুক্রাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে যযাতিকে বার্ধক্যে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপ দিলেন। রাজা অভিশাপ প্রত্যাহারের জন্য বহু অনুনয় করলে শুক্রাচার্য জানালেন, তিনি চাইলে তাঁর দুরারোগ্য বার্ধক্য তাঁর কোনও ছেলেকে দিতে পারবেন।

“আর্যসমাজে যত কিছু জনতি ছড়াইয়া পড়িয়াছিল তাহাদিগকে তিনি (ব্যাস) এক করিলেন। জনশ্রুতি নহে, আর্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস, তর্কবিতর্ক ও চারিত্রনীতিকেও তিনি এই সঙ্গে এক করিয়া একটি জাতির সমগ্রতার এক বিরাট মূর্তি এক জায়গায় খাড়া করিলেন। ইহার নাম দিলেন মহাভারত। ...’’

                                                                           রবীন্দ্রনাথ

এই মহাভারতকে আশ্রয় করেই নানা কল্পকাহিনি শাখা প্রশাখা মেলেছে। শর্মিষ্ঠা, দেবযানী এবং রাজা যযাতির ত্রিমুখী প্রেম সমকালীন এক গল্পের রূপ নিলেও রঙে-রসে যযাতিকে ঘিরে গল্প যেদিকে মোড় নিয়েছে, তা এককথায় একটা বংশ শাখা প্রশাখা মেলার আগের ছবিটা তুলে ধরে। তাতে যোগ হয়েছে একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস। মহাভারতের কথা বললে অনেকেই পাণ্ডব ও কৌরবদের কথা বোঝেন, তাঁরা সকলেই বংশ বিচার করলে কিন্তু যযাতির বংশধর। পাণ্ডব ও কৌরবদের বংশ ছিল একই। মহারাজা কুরুর বংশে জন্ম তাঁদের। কুরুর অনেক পুরুষ আগে ছিলেন মহারাজা পুরু। পুরুর বাবা হলেন যযাতি। সেই অর্থে এঁরা সবাই হলেন রাজা যযাতির বংশোধর।

যযাতির প্রথমা পত্নী দেবযানী, শুক্রাচার্যের কন্যা। তাঁর দুই পুত্র হয়েছিল। দ্বিতীয়া পত্নী শর্মিষ্ঠা, দৈত্যরাজ বৃষপর্বার কন্যা। তাঁর তিন পুত্র, পুরু কনিষ্ঠ। কালক্রমে যদু ও তুর্বসু নামে দেবযানী দুই ছেলের জন্ম দিলেন। আর শর্মিষ্ঠার গর্ভে জন্ম নিল দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু নামে তিন ছেলে। তাঁদের সকলের পিতা ওই রাজা যযাতি। একদিন দেবযানী স্বামী যযাতির সঙ্গে বাগানে বেড়াতে এসে দেখলেন ফুট ফুটে ৩টি বাচ্চা ছেলে খেলা করছে। দেবযানী বাচ্চাগুলির কাছে তাঁদের বাবা-মার নাম জানতে চাইলেন, তখন বাচ্চাগুলি যযাতি আর শর্মিষ্ঠাকে দেখিয়ে জানায় এঁরাই তাদের বাবা-মা। তখন দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে পাপী, কামুকি, নষ্টা ইত্যাদি বলে গালমন্দ করলেন। তখন শর্মিষ্ঠা জানালেন দেবযানী যখন রাজা যযাতিকে বিয়ে করেন তখন শর্মিষ্ঠাও তাঁকে মনে মনে পতিরূপে বরণ করে নিয়েছিলেন। আরও বললেন- যিনি আমার সখীর পতি, ধর্মানুসারে তিনি আমারও পতি।

আরও পড়ুন- ভাইদের ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে! ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র হয়েও কেন এত অবহেলিত যুযুৎসু

স্বামী যযাতির এমন পরনারী আসক্তি দেখে দেবযানী রাজার উপর রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গেলেন। দেবযানীর পিছন পিছন রাজা যযাতিও শুক্রাচার্যের কাছে পৌছালেন। দেবযানী তাঁর বাবাকে রাজার অপকর্মের কথা জানালেন। সব শুনে শুক্রাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে যযাতিকে বার্ধক্যে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপ দিলেন। রাজা তখন বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়ে অভিশাপ প্রত্যাহারের জন্য বহু অনুনয় করলে শুক্রাচার্য জানালেন, তিনি চাইলে তাঁর দুরারোগ্য বার্ধক্য তাঁর কোনও ছেলেকে দিতে পারবেন। যযাতি বললেন- “আমার যে ছেলে আমাকে তাঁর যৌবন দেবে সেই ছেলেই রাজ্য পাবে এবং পুণ্যবান কীর্তিমান হবে।” যযাতি রাজধানীতে এসে তাঁর বড় ছেলে যদুকে বললেন- “আমি শুক্রের অভিশাপে জরাগ্রস্ত হয়েছি কিন্তু যৌবনভোগে এখনও তৃপ্ত হইনি। আমার জরা নিয়ে তোমার যৌবন আমাকে দাও, হাজার বছর পরে আবার তোমাকে যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে নিজের জরা ফিরিয়ে নেব।”

যদু বাবার প্রস্তাবে রাজি হলেন না, অন্য ছেলেদের কাছে যৌবন চাইতে আর্জি জানালেন। রাজা অসন্তুষ্ট হয়ে যদুর সন্তানদের রাজ্যের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। তারপর যযাতি একে একে তাঁর অন্যান্য ছেলে তুর্বসু ,দ্রুহ্যু এবং অনুকে একই প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু কেউই জরা নিয়ে যৌবন দিতে রাজি হলেন না। যযাতি তুর্বসুকে আভিশাপ দিলেন, তুর্বসু অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ জাতির রাজা হবেন এবং তাঁর বংশলোপ হবে। দ্রুহ্যুকে অভিশাপ দিলেন অতি দুর্গম দেশে গিয়ে ভোজ উপাধি নিয়ে বাস করবেন এবং কখনও অভীষ্ট লাভ করবেন না। অনুকে অভিশাপ দিলেন শীঘ্রই জরান্বিত হবেন ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াহীন হয়ে রইবেন। তাঁর সন্তানরাও যৌবনলাভ করেই মারা যাবে।

অন্যদিকে যযাতির সবচেয়ে ছোট ছেলে পুরু তাঁর বাবার অনুরোধ শুনে তখনই বাবাকে তাঁর যৌবন দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন। রাজা যযাতি খুশি হয়ে আশীর্বাদ করলেন, পুরুর রাজ্যে সকল প্রজা সর্ব বিষয়ে সমৃদ্ধি লাভ করবেন। পুরুর যৌবন পেয়ে রাজা যযাতি প্রাণভরে ভোগ করলেন, প্রচুর ধর্মকর্মের অনুষ্ঠানও করলেন। এইভাবে হাজার বছর পার হয়ে গেলে তিনি পুরুকে বললেন-

“ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।

হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।

যৎ পৃথিব্যাং ব্রীহিযবং হিরণ্যাং পশবঃ স্ত্রিয়ঃ।

একস্যাপি ন পর্যাপ্তং তস্মাৎ তৃষ্ণাং পরিত্যজেৎ।।”

অর্থাৎ, “কাম্য বস্তুর উপভোগে কখনও কামনার শান্তি হয় না, ঘৃতসংযোগে অগ্নির ন্যায় আরও বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীতে যত ধান্য, যব, হিরণ্য, পশু ও স্ত্রী আছে তা একজনের পক্ষেও পর্যাপ্ত নয়, অতএব বিষয়তৃষ্ণা ত্যাগ করা উচিত।”

আরও পড়ুন- প্রবল প্রেমে মাতোয়ারা হয়েই একে অন্যকে অভিশাপ! কচ ও দেবযানীর যে আখ্যান শিহরণ জাগায়

তারপর রাজা যযাতি পুরুকে তাঁর যৌবন ফিরিয়ে দিলেন। পুরুকে নিজের রাজ্য বুঝিয়ে দিয়ে যযাতি কিছু দিন বনে বাস করলেন। বনবাসের পরে তিনি স্বর্গলোকে গেলেন। কিন্তু স্বর্গে গিয়ে তিনি ইন্দ্রের কাছে গর্ব করে বলেলেন, দেবতা-মানুষ-গর্ন্ধব আর ঋষিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি তপস্যা করেছেন। এই আত্মপ্রশংসার ফলে ইন্দ্র যযাতিকে স্বর্গচ্যুত করলেন। তখন যযাতি ভূতলে না পড়ে কিছুকাল অন্তরীক্ষে অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমান ও শিবি এই চারজন রাজর্ষির সঙ্গে ধর্মালোচনায় কাটালেন। এরা ছিলেন যযাতিরই নাতি। অতঃপর যযাতি পুনরায় স্বর্গলোকে গেলেন।

পুরুবংশ আসলে প্রাচীন চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতির পুত্র পুরুর বংশধারা। এই মহান বংশের বীজ বিষ্ণু। বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে জাত বিধাতা ব্রহ্মা। তাঁর পুত্র অত্রি। অত্রির পুত্র চন্দ্র। চন্দ্রের নামেই একে চন্দ্রবংশ বলা হয়। এই বংশে বহু বিখ্যাত রাজ-রাজর্ষির জন্ম হয়েছে। কৌরব-পাণ্ডব, ভীষ্ম, দুষ্মন্ত, ভরত, জরাসন্ধ, নহুষ, যযাতি, কুরু, হস্তী এবং এই চন্দ্রবংশেরই রাজা যযাতির প্রথম পুত্র যদুর বংশধারায় শ্রীকৃষ্ণ জন্ম গ্রহণ করেন।

এই বংশলতিকা খুব ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মহাভারতের যুদ্ধ এই চন্দ্র বংশেরই বংশধরদের মধ্যে হয়। এই বংশেই অজমীঢ়ের পুত্র নীলের বংশধারায় পরবর্তীকালে পাঞ্চালবংশের সৃষ্টি হয় (দ্রুপদ, দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতির জন্ম এই বংশে)।

অনেক দেশি-বিদেশি পণ্ডিত মনে করেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আসলে কৌরব ও পাঞ্চালদের যুদ্ধ। সে যাই হোক, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে মহাভারতকে আশ্রয় করে এরপরও নানা কল্পকাহিনি কিংবা ‘জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস’ নানা দিকে মোড় নিতে থাকে। মহাকাব্যটি ধারণ করে আছে নানা কাহিনি, মহাভারতের আলোয় আজও বিচার করা যায় সমকালকে।

More Articles