অন্য কালীঘাট
পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য কালীমন্দিরগুলোর মধ্যে কলকাতার কালীঘাট অন্যতম । তাই তো বছরভর পূণার্থীদের ভিড় লেগে থাকে এই মন্দির চত্বরে । বর্তমানে কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে আকর্ষণ কেড়েছে কালীঘাট । কলকাতার কালীঘাট প্রসঙ্গে সচরাচর দুটি বিষয় উঠে আসে । দেবী কালীর আরাধনার সঙ্গে উঠে আসে কালীঘাটের বিবাহ প্রসঙ্গও । কখনো এই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে থাকে পবিবারের সদস্যদের সাক্ষী রেখে আবার কখনো পরিবারের অনুমতি না মিললে মানুষ শাস্ত্রীর মতে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কালীঘাটে ভিড় জমায় । বাংলায় এতো কালীমন্দির থাকতে কেন মানুষ ছুটে আসে কালীঘাটে বিয়ে সারার জন্য , সে কথা বলবো অন্যদিন । আজ বরং বলি কলকাতার কালীঘাটের মতোই অন্যরকম সব কালীঘাটের কথা , যেখানে পরিবার কিংবা সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে দুটি মানুষের প্রেম এক পূর্ণতা লাভ করতো ।
প্রথমেই বলি , গ্ৰেটনা গ্ৰিনের কথা । গ্ৰেটনা অবস্থিত ছিল ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের সীমানায় । এই গ্ৰেটনা গ্ৰিনে অবস্থিত একটি চার্চ ছিল উনিশ শতক অবধি ইংল্যান্ডের কালীঘাট । খাতায় -কলমে এবং ভূগোল ও আইনে গ্ৰেটনা তখন ছিল স্কটল্যান্ডের অধীনে । সমস্ত ইংলিশ চার্চ থেকে খারিচ হওয়া পাত্র -পাত্রীদের শেষ ঠিকানা ছিল এই গ্ৰেটনা । রাত -বিরেতে কোন ভগবান গ্ৰেটনার চার্চে ছিল না কারণ চার্চটি আসলে ছিল নন-অফিসিয়াল । গ্ৰেটনায় আর কলকাতার কালীঘাটের পুরোহিতরা ছিলেন সমশ্রেণীর । গ্ৰেটনায় যারা পাদরি সেজে এই বিবাহ কাজ সম্পন্ন করতেন তারা আসলে ছিলেন পাশেরই কোন গ্ৰামের চাষি কিংবা কামার গোষ্ঠীর লোক । হয়তো এই কারণেই গ্ৰেটনায় কোন নির্দিষ্ট দক্ষিণা ছিল না অর্থাৎ যে যেমন দেয় আর কী । একবার এক সাহেব দক্ষিণা বাবদ এক পাদরিকে দিয়েছিলেন কুড়ি পাউন্ড আবার এক গরীব চাষি দিয়েছিলন কেবল এক পেগ হুইস্কি । তবে গ্ৰেটনায় যারা আসতেন তারা বেশিরভাগই ছিলেন উচ্চবিত্ত কারণ গ্ৰেটনার এই চার্চ ছিল শহরতলি থেকে বেশকিছু দূরে , যাতায়াত বেশ কয়েকদিনের মামলা তাই যে সাহেবের, চার ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে আসতে বিন্দুমাত্র অনুতাপ হবে না তারাই মূলত এই চার্চকে বিকল্প পথ হিসাবে বেছে নিতেন । এইখানে আবার হানিমুনের ব্যবস্থাও ছিল । চার্চের পাশেই নাকি ছিল সারি সারি ঘর । ব্যবস্থাপকরা নিজেই বলে গেছে এই ঘরগুলোর উদ্দেশ্যে ছিল বিয়ের ভীতকে খানিক মজবুত করা । এই ঘরগুলোকে বলা হত ‘নেপচুয়াল চেম্বার’। গ্ৰেটনা যেহেতু ছিল নন-অফিসিয়াল তাই অভিভাবকরা এই বিয়ে অস্বীকার করলেও ‘নেপচুয়াল চেম্বার’কে অস্বীকার করার মূর্খামো নিশ্চয়ই করবেন না ।
এইরকম আরো দুটি কালীঘাটের কথা বলা যাক । তবে এই চার্চ দুটি ছিল এদেশীয় । একটি চার্চ ছিল পর্তুগিজদের আর অন্যটি ইংরেজদের । ভারতবর্ষে যখন ইংল্যান্ড থেকে কোন লোক আসতো তখন সে আসতো একাই । কিন্তু একা কি আর জীবন কাটানো যায় । ইংরেজরা পরলেন ভারী বিপদে । অন্যদিকে পর্তুগিজরা পুরানো খ্রীষ্টান হবার কারণে তাদের ওতো বাছবিচার ছিল না । ভারতে এসে তারা অতি সহজেই ভারতীয় মহিলাদের বিয়ে ঘরকন্না করেছেন । সুতরাং ইংরেজদের ক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম শিথিল করা হল , তবে তারমধ্যেও আবার তারতম্য ছিল । কেবলমাত্র সাজেন্টের থেকে নীচু পোস্টে যারা কাজ করতেন , তারা চাইলে এই পর্তুগিজ-পন্থা অবলম্বন করতে পারতেন কিন্তু অন্যদিকে সাজেন্টের থেকে যারা উঁচু পোস্টে কাজ করতেন তাদের জন্য পূর্বের অবস্থাই বহাল থাকলো । তাই বাধ্য হয়ে তারা ধরল বিকল্প পথ , কালীঘাটের পথ । কলকাতার ডালহৌসির সেন্ট জন চার্চ ছিল এরকমই এক ইংরেজদের কালীঘাট।
সেইসময় এদেশে যারা পাদরি হিসাবে আসতেন , তারা থাকতেন রাজার হালে । বছর বছর তাদের মাইনে বাড়তো , সাথে বাড়তে থাকতো বিয়ে কিংবা শ্রাদ্ধের দক্ষিণাও । এতকিছুর পরেও পাদরিদের চার্চের কাজে মন বসতো না । ম্যাকর্যাবি লিখেছেন , কলকাতার কোন পাদরি ছিলেন শিকারে পারদর্শী , কারোর ব্যবসা আবার সৈন্যদলে বলদ পাচার করা , কারোর আবার চিনা পদ্ধতিতে বাগান করার শখ । কেউ আবার ডুবে থাকতেন জুয়ার নেশায় । একটা সময় মৃত কোন ব্যক্তিকে কবর দিতে হলে পাদরিদের রীতিমতো তুলে নিয়ে আসতে হতো জুয়ার আড্ডা থেকে । ব্যারিস্টার হিকি সাহেব লিখেছেন , কলকাতার সৈন্যবাহিনীর এক পাদরি এক একদিন অতিরিক্ত মদ্যপান করে নাচ-গান করে দেখার মতো কাণ্ড করে বসতো । বোঝাই যায় , ইংরেজি কালীঘাট কীরকম এক খোরাকের স্থান ছিল।
এবার আসা যাক , পর্তুগিজদের কালীঘাটের কথায় । এই কালীঘাট ছিল কলকাতা থেকে ২০মাইল দূরে ব্যন্ডেলে । বাংলার সবচেয়ে পুরানো গির্জা এটি । স্থাপিত হয়েছিল ১৫৯৯ সালে । ব্যন্ডেলের এই গির্জায় ‘নানারি’ ছিল একটি । সেখানে থাকতো সুন্দরী এবং কম বয়েসী খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনীরা । তারা সবাই যে পর্তুগিজ ছিলেন এমন নয় , ইউরোপীয়ও না হয়তো । কিন্তু যেহেতু সবাই ছিলেন খ্রিষ্টান , তাই যেখানে যত খ্রিষ্টান পুরুষ ছিল সবাই মাঝে মাঝেই ছুটে আসত এই স্থানে । এখানে নাকি এই মেয়েদের পাত্রী হিসাবে কিনতে পাওয়া যেত । এসিয়াটিকাস নামে এক ছদ্মবেশী এই কথা শুনে ১৮০৩সালে একবার গেছিল ব্যন্ডেলে , কিন্তু তখন সব অতীত ।
এই ছিল অন্যরকমের কিছু কালীঘাটের গল্প । এরকম হয়তো অনেক চার্চই তখন ছিল যা কালের প্রবাহে আজ নিশ্চিহ্ন । কিন্তু কলকাতা এতো বছর পরেও স্বমহিমায় বিদ্যমান । কবিতার কথায় বলতে হয়, কলকাতা আছে কলকাতাতেই ।
- তথ্যসূত্র – শ্রীপান্থ রচিত ‘কলকাতা’।