আমেরিকার বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় এই নিরামিষ ভারতীয় আইসক্রিম
সব ধরনের মানুষের কথা মাথায় রেখে রকমারি স্বাদের আইসক্রিম নিয়ে এসেছে এই কোম্পানি।
নয়ের দশকে বরফের গোলা বা মালাই গাড়ির ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ছুটে ঘর বেরিয়ে আসত বাচ্চা-বুড়ো সকলেই। কত দুপুরে বাবা-মায়ের কাছে বায়না করে ছোট্ট শিশুর কপালে জুটেছে শুধু বকা। আবার কোনও সময় সাধ মেটাতে তাঁরাই কিনে দিয়েছে ঠান্ডা মিষ্টি গোলা বা মালাই আইসক্রিম। শৈশবের এইসব স্মৃতি ভোলার নয়। আজকের আইসক্রিম আর ২৫ বছর আগের আইসক্রিমের মধ্যে ফারাক অনেক। তবে আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু। কিন্তু ভারতীয়দের আইসক্রিমের প্রতি দুর্বলতা তৈরির নেপথ্যে রয়েছে ভাদিলাল। আমূল, রসনার মতোই গুজরাত থেকে পথচলা শুরু করে এই আইসক্রিম প্রস্তুতকারী সংস্থা। স্বাধীনতার আগে হাতে তৈরি আইসক্রিম থেকে আজ সাফল্যের শীর্ষে যেভাবে পৌঁছলো ভাদিলাল সংস্থা, তা জানলে চমকে উঠতে হয়।
তখনও পরাধীন ভারতবর্ষ। স্বাধীনতার প্রায় চল্লিশ বছর আগে ১৯০৭ সালে গুজরাতের আহমেদাবাদে জন্ম নেয় ভাদিলাল নামক আইসক্রিম প্রস্তুতকারী এই সংস্থা। তবে প্রথমদিকে সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ভাদিলাল গান্ধী সোডা বিক্রী করতেন। ব্যবসায় লাভের পরিমাণ কমতে থাকলে সেই ব্যবসা ছেড়ে দেন তিনি। এরপরেই আইসক্রিম তৈরি শুরু করেন ভাদিলাল গান্ধী। তবে শুরুর দিকে চিরাচরিত কোঠি পদ্ধতিতে হাতে চালানো মেশিনে দুধ, বরফ এবং নুন ভালোভাবে মিশিয়ে তৈরি হত আইসক্রিম। নিজের হাতে তৈরি করা আইসক্রিম বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতেন ভাদিলাল। ধীরে ধীরে ব্যবসা ও লাভ দুইই বেড়ে চলেছিল।
১৯২৬ সালে ছেলে রাঞ্চোড লাল গান্ধী ব্যবসার দায়িত্ব নেন। ছেলে যোগ দেওয়ার বছরেই জোড়া সাফল্য আসে কোম্পানির হাতে। সেই বছর জার্মানি থেকে আইসক্রিম তৈরির জন্য মেশিন কেনে তাঁরা। দ্বিতীয় সাফল্য হিসেবে ওই বছর প্রথম আউটলেট শুরু করে এই সংস্থা। বাবা-ছেলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ব্যবসা আরও বাড়তে থাকে। স্বাধীনতার সময়েই ভাদিলাল কোম্পানির চারটি আউটলেট ছিল দেশে । সত্তরের দশকে ভাদিলালের দুই নাতি রামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণ গান্ধীও পারিবারিক এই ব্যবসায় যোগ দেন। ততদিনে আউটলেটের সংখ্যা চার থেকে বেড়ে দশ হয়ে গেছে।
ক্রেতাই যে লক্ষ্মী, তা ভালোমতোই জানতেন ভাদিলাল।তাই তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেই চলতেন তিনি। সম্পূর্ণ নিরামিষ পদ্ধতিতে তৈরি এই আইসক্রিমই ছিল কোম্পানির ইউএসপি (ইউনিক সেলিং প্রপোজিশন)। বাজার ধরতে বিজ্ঞাপনেও ছিল কারসাজি। এই সংস্থার বিজ্ঞাপনে দেখানো হত, নিরামিষ এই আইসক্রিম আপনি উপোস করেও নির্দ্বিধায় খেতে পারেন।
পায়ের তলার মাটি শক্ত হতেই ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে মন দেয় এই কোম্পানি। ১৯৮৫ সাল নাগাদ গুজরাত ছাড়াও দেশের একাধিক রাজ্যে আইসক্রিম বিক্রি করতে শুরু করে এই সংস্থা। ১৯৯০ সাল নাগাদ গান্ধী পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মও যোগ দেয় কোম্পানিতে। রামচন্দ্র গান্ধীর ছেলে বীরেন্দ্র ও রাজেশ গান্ধী এবং লক্ষ্মণের ছেলে গান্ধী সংস্থার দ্বায়িত্ব নেন।
১৯৯০ সালেই কোম্পানি ভাদিলাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে নামে বম্বে স্টকমার্কেটের তালিকাভুক্ত হয় এই সংস্থা। তবে সেই বছরই পারিবারিক সমস্যায় আলাদা হয়ে যায় গান্ধী পরিবার। ফলস্বরূপ একই নামে ভাদিলাল কোম্পানির দু'টি শাখা বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে নাম নথিভুক্ত করায়। ২০১৯-'২০ অর্থবর্ষে কোম্পানির আয় ৬৫০ কোটি টাকায় পৌঁছয়।
তবে সংস্থার কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ফ্যাক্টরিতে তৈরি আইসক্রিম অন্যত্র পৌঁছে দেওয়া। সেসময় ফ্রিজিং ব্যবস্থাও এখনকার মতো উন্নত ছিল না। প্রথম ফ্রিজিং গাড়ি আনতে কোম্পানির সময় লেগেছিল পাক্কা তিন বছর। এছাড়াও উদার অর্থনীতির কারণে বিদেশি কোম্পানির আগমন ছিল আরও একবার বড় ধাক্কা। তবে বিদেশি সংস্থার চাপের মুখেও দেশের সব রাজ্যের বাজারেই ছড়িয়ে পড়ে ভাদিলাল আইসক্রিম।
১৯৯৫ সালে ভাদিলাল কোম্পানি মার্কিন বাজারে হিমায়িত সবজি নিয়ে আসা প্রথম ভারতীয় ব্র্যান্ড। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবচেয়ে বিক্রি হওয়া ভারতীয় আইসক্রিম ব্র্যান্ড ভাদিলাল। শুধু তাই নয়, আজ ভারত ছাড়াও ৪৫টি দেশে রপ্তানি হয় ভাদিলাল আইসক্রিম। কোম্পানির সম্প্রসারণের পাশাপাশি এই সংস্থাই প্রথম যারা ভারতে কোন, ডলিস এবং সান্ডাই আইসক্রিম বিক্রি শুরু করে। সঙ্গে আইসক্রিম কোন তৈরির জন্য মেশিনও আমদানি করে বিদেশ থেকে।
২০০১ সালের নভেম্বরে এই সংস্থা 'দ্য লার্জেস্ট আইসক্রিম সান্ডাই' তৈরি করে লিমকা বুক অব রেকর্ডসে জায়গা করে নেয় এই কোম্পানি। ৪৯৫০ লিটারের ওই আইসক্রিম তৈরি করতে ১২৫ কেজি শুকনো ফল এবং ২৫৫ কেজি তাজা ফলের ব্যবহার করা হয়। সঙ্গে প্রায় ৩৯০ লিটার বিভিন্ন ধরনের সস ছিল এই আইসক্রিমে।৬০ মিনিটে ১৮০ জন লোক একসঙ্গে মিলে প্রস্তুত করেছিল এই সান্ডাই আইসক্রিমটি।
বিভিন্ন দামের, সব ধরনের মানুষের কথা মাথায় রেখে রকমারি স্বাদের আইসক্রিম নিয়ে এসেছে এই কোম্পানি। সাধারণ মানের আইসক্রিম থেকে সর্বোচ্চ মানের আইসক্রিম- সবই রয়েছে ভাদিলাল কোম্পানির।
১১৫ বছরেরও পুরনো এই সংস্থা আজও ক্রেতাদের মতামতকে ততটাই গুরুত্ব দেন। বিভিন্ন রকম সোশ্যাল মিডিয়া এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে ক্রেতাদের মতামত গ্রহণ করে এই সংস্থা। সুদীর্ঘ এই যাত্রাপথের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে শ্রম ও সংঘর্ষের কথা।