স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দেওয়া সতী নাকি নিখোঁজ রাজকন্যা! ভাদু আসলে কে

অবিভক্ত বাংলার রাঢ় অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় ২০০০বছর আগে যেসব লোকউৎসবের প্রচলন হয়েছিল ভাদু তার মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে সামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের ঢেউয়ে এই লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে।অথচ এও বাংলার সংস্কৃতি, বাঙালির সংস্কৃতি।

ভাদ্র মাসের প্রথমদিন বাড়ির কুলুঙ্গি পরিষ্কার করে, গোবরের দিয়ে নিকিয়ে সেখানে একটি পাত্রে কিছু ফুল ও বিভিন্ন গাছের লতাপাতা দিয়ে ভাদুর মূর্তি(পূর্বে কোনো মূর্তির চলন ছিলনা,ভাদুর বিমূর্ত কাঠামো পূজা হত) স্থাপন করা হয়। প্রতিদিন ফলমূল, মুড়ি বাতাসা,কড়কড়া ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।একমাস ধরে বিশেষ রীতিতে চলে ভাদুপুজো।ভাদ্র সংক্রান্তিতে পুজাপাঠ সেরে হয় মায়ের বিসর্জন। ভাদ্রের প্রথম দিনটিতে ভাদুর মূর্তি স্থাপন করে মেয়ে-বৌরা ভাদুর আগমনী গান গায়।যেমন-

আমার ঘরকে ভাদু এলেন
কুথাকে বসাবো,
পিয়াল গাছের তলায়
আসন পাতাবো
না না না না রে
‌আমার সোনার ভাদুকে
কোলে তুলে লিব।

আমার ভাদু খাবেক কড়কড়া
মোতির দাঁতে আওয়াজ দিবে
‌ কুটুর মুটুর মড়মড়া।

আরো একটি ভাদু আগমনী গান-
ভাদু রানী আইলো আজি
মোদের প্রাঙ্গনে
খুশির জোয়ার বইছে
আজ মোদের পরানে
মোদের ভাদুর আগমনে
পুজো করবো সারারাত্রি
জ্বালিয়ে সবাই মাটির বাতি।

ভাদু কখনো মা, আবার ভাদু কখনো কন্যা। সোনার বরণ তার রূপ,তাকে কোলেও তুলে নেওয়া যায়। ভাদু কি খাবে, এমনকী কেমন করে খাবে তার বর্ননাও আছে। আবার জাগরনের পরদিন বিসর্জনের সময় দু্ঃখের গান গাওয়া হয়-

বিদায় দিব কেমনে
বলোনা ভাদু।
মোদের মন কইরেছ চুরি,
দিয়ে তোমার জাদু।
যাচ্ছ তুমি যাও মাগো
আবার আইসো ফিরে।
ভুইল্যো না ভুইল্যো না
ভুইল্যো না মোরে।
নীলাম্বরী পড়বি পর,
ভাদু সোহাগিনী।
গরীব সই দের না দেখিলে
মারবো ঝাঁটা কপালে আনি।

 

১৯৮৫ সালে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের,'ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটেরিয়ার পুরুলিয়া' গ্রন্থে একটি কাহিনি প্রকাশিত হয়। কাহিনিটি ছিলো পঞ্চকোট রাজবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা নীলমণি সিং দেও-এর কাহিনী। মহারাজা নীলমনি সিং দেও-এর তৃতীয়া কন্যা ভদ্রাবতীর বিবাহের দিন বিবাহ করতে আসা পাত্রসহ সকল বরযাত্রীর দল পথের মাঝে ডাকাত দের হাতে নিহত হন।ভদ্রাবতী এই শোক সহ্য করতে না পেরে হবু স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জন দেন।মহারাজা নীলমণি সিং দেও তাঁর প্রিয় কন্যাকে স্মরণীয় করে রাখতে 'ভাদু' গানের প্রচলন করেন।যদিও এই কাহিনির স্বপক্ষে কোনো দলিল পাওয়া যায় না,বংশতালিকায় মহারাজের তিন পত্নী ও দশ পুত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো কন্যা সন্তানের প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন-ভাদু উৎসব

রাখাল চন্দ্র চক্রবর্তী রচিত "পঞ্চকোট ইতিহাস" গ্রন্থেও এই ঘটনার বিবরণ নেই।তবু অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন রাজকুমারী ভদ্রাবতীর নামানুসারে 'ভাদু' পূজার প্রচলন হয়েছে।

পক্ষান্তরে বীরভূমের মানুষের বিশ্বাস ভদ্রাবতী হেমাতপুরের রাজার কন্যা।ভদ্রাবতীর সহিত বর্ধমানের রাজপুত্রের বিবাহ স্থির হয়।ইসলামবাজারের নিকটবর্তী চৌপরির শালবনে ডাকাতদের হাতে বরসহ বরযাত্রীরা নিহত হন।বাগদত্ত রাজকুমারের মৃত্যূতে শোকাকূলা রাজকুমারী ভদ্রাবতী লগ্নভ্রষ্টা হবার ভয়ে হবু বরের চিতায় সহমরনে যান। রাজকুমারীর এই আত্মত্যাগ ও ভালোবাসাকে স্মরনীয় করে রাখতে রাজামশাই 'ভাদু' গানের প্রচলন করেন।এই কাহিনির সপক্ষেও কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু কিম্বদন্তী কাহিনি হিসাবে অনেকেই এই ঘটনা বিশ্বাস করেন এবং সমাজে এই কাহিনীর প্রচলন রয়েছে।

ভাদুর বৃতান্তের আরো একটি কাহিনি রয়েছে,সেখানে 'ভাদু'কে গ্রামের মোড়লের মেয়ে হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।এই কাহিনী সত্যতার প্রমান কিছু নেই,কিন্তু ভাদু গানের মধ্যে এই কাহিনীর বর্ণনা করা হয়েছে। পুরুলিয়ার 'লাড়া' গ্রামের মোড়ল ভাদ্র মাসে ধানক্ষেতের আলের ধারে একটি ফুটফুটে শিশু কন্যাকে কুড়িয়ে পান। ভাদ্রমাসে পেয়েছিলেন বলে তার নাম রাখেন ভদ্রাবতী।ডাকনাম "ভাদু"।কন্যাটি যত বড়ো হতে থাকে, তার রূপের খ্যাতি তত ছড়িয়ে পড়ে।একদিন মহারাজা নীলমণি সিং দেও কন্যাটি কে দেখতে আসেন এবং বলেন,এ আসলে রাজকন্যা এবং কন্যাটিকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু ভাদু রাজার সঙ্গে প্রাসাদে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে।এরপর ভাদু পূর্ণ যৌবনা হয় এবং গ্রামেরই কবিরাজের ছেলে অঞ্জনকে ভালোবাসে।তাদের ভালোবাসার গল্পকথা মহারাজার কর্নগোচর হলে তিনি অঞ্জনকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।তখন ভাদু সেই কারাগারের চারিপাশে কেঁদে কেঁদে গান গেয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। মহারাজা তখন অঞ্জনকে মুক্ত করে দেন, কিন্তু 'ভাদু'কে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।সকলের বিশ্বাস সে নদীর জলে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।

অনেকের মতে ভাদু বাঁকুড়ার মল্লরাজার কন্যা,আবার একমতে তিনি কাশীপুরের রাজকণ্যা। অনেকে ভাদু্র সঙ্গে মীরাবাঈ-এর মিল খুঁজে পান।সেখানে কাহিনি অন্য রকম।জন্ম থেকে ভাদু বা ভদ্রাবতী কৃষ্ণভক্ত। মহারাজা তার বিবাহ স্থির করলে বিবাহে অনিচ্ছুক ভাদু মন্দিরে ধ্যানস্থ অবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেন।ভাদুর ভাদ্র মাসে জন্ম এবং ভাদ্র মাসেই মৃত্যু।সেই কারনেই ভাদ্রমাসে হিন্দুদের বিবাহ হয় না।

প্রচলিত কাহিনী যাইহোক, ভাদ্রমাসে এই পুজার প্রচলন পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া,বীরভূম, বর্ধমান,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং বিহার ও ঝাড়ন্ডের দু-একটি জেলায় দেখা যায়।

ভাদু উৎসব গোটা ভাদ্রমাস ধরেই চলে,সঙ্গে গাওয়া হয় ভাদুকে নিয়ে রচিত প্রচলিত গান।এই উৎসব সাধারণতঃ মহিলা কেন্দ্রিক।এই গানের বিষয়বস্তু গ্রামের সাদামাটা গৃহবধূর জীবনের কাহিনি। পৌরাণিক ও সামাজিক ঘটনাবলীর বর্ননাও থাকে;যেমন মহাভারতের কাহিনী,রাধাকৃষ্ণের প্রেমের পৌরাণিক কাহিনি ও বারোমাস্যা, এছাড়াও হালফিলের নানান বিষয় এই গানগুলির মূল কথা।ভাদু মূলত লক্ষ্মী রূপে পুজিতা হন। ভাদু পুজো শুরু হয় ভাদ্রমাসের প্রথম দিন থেকেই এবং ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সারারাত জেগে ভাদু্ পুজো চলে,একে বলা হয় 'জাগরণ'। ভাদু পুজার কোনো মন্ত্র নেই। পাঁচালীর সুরে ছোট ছোট পদ গেয়ে পুজো শুরু হয়।ভাদুকে নিজের বাড়ির মেয়ে ভেবে নিজেদের পছন্দমতো নৈবেদ্য দেওয়া হয়ে থাকে যেমন- (মুড়ি,কলাইভাজা,তালবড়া,তাল- লুচি মিষ্টি ইত্যাদি)"জাগরনে"র সময় সারারাত সুর করে ভাদুর পাঁচালী পড়া হয়:-

নমো নমো নমো ভাদু
নমো তোমার চরণে
আজ পুজেছি শতদলে
কাল পুজিব নীল বরনে।

‌ চিড়ে মুড়ি গুড় বাতাসা
খেতে দিব তালবড়া
শুতে দিব শীতলপাটি
পাখার বাতাস মনোহরা।

চলরে ভাদু দেখতে যাবো
হেমাতপুরের রাজার বাড়ি
দুবরাজপুরে কিনে দিব
জামদানি আর লাল শাড়ি।

বর্তমানে একটি অতি জনপ্রিয় ভাদু গান হ'ল-
ভাদু লে লে
ভাদু লে লে পয়সা দু'আনা
কিনে খাবি
‌ কিনে খাবি মিছরির দানা,
কিনে খাবি মিছরির দানা।

‌ উপর পাড়া যাইয়ো ভাদু
নম পাড়া যাইয়ো না,
মাঝ পাড়াতে সতীন আছে,
‌ মাঝ পাড়াতে সতীন আছে
পান দিলে পান খেয়োনা।

ভাদু গান হলো লোকগান। প্রাচীন লোকসংস্কৃতির অন্যতম হল 'ভাদু' উৎসব ও 'ভাদু' গান। বর্তমানে কিছু শিল্পী এই গানের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে সচেতন মূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন।তারা সারাবছর গান বাঁধেন ,সেই গানের মাধ্যমে ফুটে ওঠে জল অপচয় বন্ধ করার বার্তা,গাছ লাগানোর বার্তা,প্লাস্টিক বর্জন করবার বার্তা,সমাজকে নেশামুক্ত করবার বার্তা,বাল্যবিবাহ বন্ধ করবার বার্তা।গ্রাম বাংলার অনান্য "প্রায় হারিয়ে যাওয়া" লোকসংস্কৃতির মতো ভাদুও হারিয়ে যেতে বসেছে পরিবর্তনের স্রোতে। তবুও কিছু শিল্পী চরম অভাবকে অগ্রাহ্য করেও তাদের বাপ-ঠাকুরদাদার এবং বাংলার পুরাতন ঐতিহ্যকে বাঁচাতে প্রানপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং আগলে রাখতে চেষ্টা করছেন এই সংস্কৃতিকে।

More Articles