ইস্টবেঙ্গলের মোটা টাকার হাতছানি এড়িয়েছেন বারবার, মোহনবাগানই জীবন ছিল বদ্রু ব্যানার্জির

পাঁচের দশকে বাঙালি পৌরুষের সেক্স সিম্বল হওয়ার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন বদ্রু। অবশ্য তাতে খুব একটা কিছু যায় আসে না, কারণ ফুটবল মাঠে তাঁর ঈর্ষণীয় সাফল্য অনন্যসাধারণ বললে কম বলা হয়।

সালটা ১৯৫৩। ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির বিরুদ্ধে মোহনবাগানের ম্যাচ। যে সে ম্যাচ নয়, প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ডুরান্ড কাপ ফাইনাল। মোহনবাগানের অধিনায়ক শৈলেন মান্না চোট পেয়ে ফাইনালে খেলতে অপারগ। এর আগে ফাইনালে উঠেও ডুরান্ড কাপ জেতা হয়নি মোহনবাগানের। মহামেডান আর ইস্টবেঙ্গল ইতিমধ্যেই ঘরে তুলেছে এই গর্বের ট্রফি। মোহনবাগান সিদ্ধান্ত নিল, ন্যাশনাল ডিফেন্সকে দম ফেলার সুযোগ দেওয়া যাবে না। প্রথম থেকেই আক্রমণে ক্ষুরধার হতে হবে। বছর তেইশের এক ফরওয়ার্ড আক্রমণভাগকে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করলেন। ক্লাবে তিনি নবাগত ঠিকই, কিন্তু ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছেন একজন উল্লেখযোগ্য তারকা। দশ মিনিট কাটতে না কাটতেই রবি দাসের পাসে গোল দিলেন তিনি। অ্যান্টনির পাসে রামান লিড দ্বিগুণ করলেন প্রথমার্ধেই। দ্বিতীয়ার্ধে আবার গোল করলেন রামান। তাঁর সামনে সুযোগটা সাজিয়ে দিলেন তেইশ বছরের সেই ফরওয়ার্ডই। ডিফেন্স অ্যাকাডেমির হাল বেহাল করে দিয়ে চতুর্থ গোলটা ফের দিলেন তিনিই। গোটা বিংশ শতাব্দীতে কোনও ডুরান্ড কাপ ফাইনাল স্কোরবোর্ডের বিচারে এতটা একপেশে হয়নি। ষোলো বারের ডুরান্ড কাপজয়ী দলের প্রথম ভিকট্রি সেটা। অধিনায়ক এবং কিংবদন্তি ডিফেন্ডার শৈলেন মান্নার অভাব টেরই না পেতে দিয়ে ক্লিনশিট রেখে ৪-০ গোলে মোহনবাগানের এই জয়ের প্রধান নায়ক, দুটো গোল এবং একটি অ্যাসিস্ট করে সমর্থকদের হৃদয় সিংহাসনে নিজের জায়গা আরও পাকা করে ফেলেছিলেন। তাঁর নাম সমর ব্যানার্জি। ময়দানে অবশ্য বদ্রু নামেই তাঁকে একডাকে চেনে সবাই।

হাওড়ার বালিতে বদ্রুর বাড়ি। কট্টর মোহনবাগান সমর্থক পরিবারে খেলাধুলোর যথেষ্ট চর্চা ছিল। সান্ধ্য আড্ডার বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান ছিল ফুটবল। বাবার কড়া শাসন উপেক্ষা করে সেইসব আলোচনা মন দিয়ে শুনতেন বালক বদ্রু। তাঁর দাদাও ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড়। দাদা রাধানাথ তাঁর চেয়ে ঢের বড় ফুটবলার হতে পারতেন, এমন কথা বারবার বলতেন বদ্রু। রাধানাথ তাঁর সম্ভাবনা পূরণ করতে পারেননি এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। খেলার মাঠেই মারাত্মক চোটটা লেগেছিল তার। বদ্রু তখন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। পড়াশোনা আর খেলাধুলো ব্যালেন্স করে চালাচ্ছিলেন। দাদার মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নেন, ফুটবলটাই খেলবেন। দাদার অধরা স্বপ্ন পূরণ করবেন। তখনকার দিনে খেলে যশ যদি বা হতো, টাকা হতো না। ডাক্তার হওয়ার সুযোগ হেলায় ত্যাগ করে ফুটবলের প্রতি এই সমর্পণ বদ্রুর অদম্য জেদের প্রতীক। ময়দানের বাঘাটে ডিফেন্ডাররাও ভয় পেতেন এই একই জেদকে।

বালি প্রতিভা ক্লাবের হয়ে খেলে অনেক নামী ক্লাবের দৃষ্টি আকর্ষণ ছাত্রাবস্থাতেই করে ফেলেছিলেন বদ্রু। তারপর বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়েকে প্রায় একার কাঁধে টেনে ফার্স্ট ডিভিশনে তুলে এনেছিলেন তিনি। তাঁকে মোহনবাগানের পক্ষ থেকে 'স্কাউট' করেন ফুটবল বলতে অজ্ঞান এক নামজাদা অভিনেতা– জহর গাঙ্গুলি! ময়দানে একটি ম্যাচের পর সরাসরি এসে জহর বদ্রুকে জিজ্ঞেস করেন, মোহনবাগানে তিনি খেলতে চান কি না। বিস্ময়ে মুখে কথা ফোটেনি বদ্রুর। ১৯৫২ সালে মোহনবাগানের হয়ে সই করেন তিনি।

আরও পড়ুন: ‘অসুস্থ তো স্টেজে নেমেছেন কেন!’ একরাশ অপমান নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাংলার প্রথম ম‍্যাটিনি আইডল

অবশ্য টলিউডের সঙ্গে তাঁর চমকপ্রদ জীবনের যোগাযোগ আরও জোরালো হয়েছিল জনপ্রিয় অভিনেত্রী তপতী ঘোষের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায়। বদ্রুর সলজ্জ স্বীকারোক্তির থেকে আমরা জানতে পারি যে, টলিউডের সুন্দরী নায়িকার সঙ্গে তাঁর প্রেমের সূত্রপাতটাও কিছু কম ফিল্মি ছিল না। পুরীর সমুদ্র-সৈকতে লাল হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থায় খালি গায়ে ভোরবেলা তাঁকে দৌড়তে দেখে নাকি মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন তপতী ঘোষ। অনেক সুপুরুষ নায়কের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন একাধিক সিনেমায়, কিন্তু রাজপুত্রের মতো চেহারা, টকটকে গায়ের রং আর তীক্ষ্ণ নাকসমেত বদ্রুর চার্মটাই ছিল অন্যরকম। তপতীকে 'তপাই' বলে ডাকতেন উত্তমকুমার। তাঁর হাতের রান্নার খুব ভক্ত ছিলেন। মোহনবাগানের ভক্ত উত্তমকুমার সহজেই হয়ে ওঠেন বদ্রুর পারিবারিক বন্ধুর মতো। প্রায়ই আড্ডা দিতেন দু'জন।

উত্তমকুমারের উত্থানের সঙ্গে বদ্রুর কেরিয়ারের সময়টা ক্ল্যাশ করে যাওয়ার জন্যই বোধহয় মোহনবাগানের এই সুপার-স্টার পপুলার কালচারে তেমন বড় দাগ রেখে যেতে পারেননি। তাছাড়া একই সময়ে উঠে এসেছিলেন চুনী গোস্বামীও। পঙ্কজ রায় ক্রিকেট মাঠ দাপাচ্ছেন তখন। বদ্রুর কেরিয়ারের একেবারে শেষদিকে 'অপুর সংসার' মুক্তি পাওয়ার পর সৌমিত্রকে ঘিরে জন্ম নিয়েছিল অন্যমাত্রার এক ক্রেজ। এইসব কারণেই মনে হয় পাঁচের দশকে বাঙালি পৌরুষের সেক্স সিম্বল হওয়ার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন বদ্রু। অবশ্য তাতে খুব একটা কিছু যায় আসে না, কারণ ফুটবল মাঠে তাঁর ঈর্ষণীয় সাফল্য অনন্যসাধারণ বললে কম বলা হয়।

১৯৫২ সালে, মোহনবাগানে তাঁর প্রথমে সিজনে দল আইএফএ শিল্ড জিতেছিল। পরের বছর বাংলার হয়ে বদ্রু জেতেন সন্তোষ ট্রফি। ১৯৫৩ সালের ডুরান্ড কাপের ফাইনালের কথা তো আগেই বলেছি। সেই টুর্নামেন্টের গোটাটা জুড়েই মাতিয়ে গেছিলেন বদ্রু। সেমিফাইনালে মোহনবাগানের মুখোমুখি হয়েছিল একটানা পাঁচবারের রোভার্স কাপ চ্যাম্পিয়ন হায়দরাবাদ সিটি পুলিশ দল। শৈলেন মান্না ডিফেন্সে একটা মাস্টারক্লাস দেখিয়েছিলেন। রামানের পাসে দুরন্ত একটি গোল করেন বদ্রু। মোহনবাগান ম্যাচ জেতে ২-১ গোলে। ১৯৫০ সালে তাদের প্রথম ডুরান্ড কাপ ফাইনালে এই হায়দরাবাদ সিটি পুলিশের কাছেই নতিস্বীকার করতে হয়েছিল মোহনবাগানকে। তাই সবুজ-মেরুন ভক্তরা এই সেমিফাইনাল জয়কে মধুর প্রতিশোধ হিসেবেই দেখতে ভালোবাসেন।

বালির ওয়েলিংটন ক্লাবে ইস্কুল থেকে ফিরে অনেক সময়ে প্র্যাকটিস করতেন বদ্রু। সেখানেই বুটজুতো পরে ফুটবল খেলার অভ্যেস গড়ে ওঠে তাঁর। বদ্রুর অনেক সতীর্থই যখন খালি পায়ে খেলতে বেশি স্বচ্ছন্দ, তিনি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জুতো পরেও একইরকম তীক্ষ্ণ ছিলেন।

১৯৫৪ সালে মোহনবাগান ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম ডাবল জিতে কলকাতা লিগ আর আইএফএ শিল্ড ঘরে তুলে। শিল্ড ফাইনালে ফের হায়দরাবাদ পুলিশের সঙ্গে খেলা পড়েছিল মোহনবাগানের। সবুজ-মেরুন ব্রিগেড জেতে ১-০ গোলে। গোলটা কে দিয়েছিলেন সেটা আন্দাজ করার জন্য কোনও পুরষ্কার নেই। বদ্রু ফাইনাল ম্যাচগুলোয় নিয়ম করে গোল করে বড় ম্যাচের খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছিলেন।

১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কলম্বো কাপের তৃতীয় সংস্করণে ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়। এই টিমের উজ্জ্বল সদস্য ছিলেন বদ্রু।

১৯৫৫ সালে মোহনবাগান শিল্ড না পেলেও, রোভার্স কাপ আর কলকাতা লিগ জিতেছিল। মোহনবাগানের প্রথম রোভার্স কাপ জয়ের অন্যতম কারিগর আবারও ছিলেন বদ্রু। মহামেডান স্পোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে ফাইনালে প্রত্যাশিতভাবেই গোল দিয়েছিলেন তিনি।

১৯৫৬ সালে ফের লিগ আর শিল্ডের ডাবল সম্পন্ন করে মোহনবাগান। কলকাতা লিগে মোহনবাগানের হ্যাট্রিক শিরোপাজয় সেই প্রথমবার। সিজনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন বদ্রু। তবে সেইবছর আরও অনেক বড় একটা সম্মান অপেক্ষা করে ছিল তাঁর জন্য। খবরটা এসেছিল মহাষ্টমীর রাতে। বদ্রুদের পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে রেডিও বাজছিল। শ্রোতারা কান খাড়া করে গান না শুনে, শুনছিলেন খবরের সম্প্রচার। রাত আটটার খবরের শেষদিকে খেলার খবরের পালা আসতেই শ্রোতারা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকলেন। একটু বাদেই মেলবোর্ন অলিম্পিকের ফুটবল টিম ঘোষণার খবরটা বলা হলো। তারপর যোগ করা হলো সেই সংবাদটা, যেটা শোনার জন্যে পাড়ার মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে বসেছিলেন- বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। পাড়ার সবাই মিছিল করে গিয়েছিলেন বদ্রুর বাড়িতে। মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল। বালি তখন প্রায় পাড়াগাঁ। সেখানকার একটা ছেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মঞ্চে দেশের অধিনায়কত্ব করবেন, এটা ভেবেই আনন্দে উদ্বেল হয়ে গেছিলেন প্রতিবেশীরা। তবে এই অধিনায়ক হওয়ার ব্যাপারটা বিতর্কিত ছিল না বললে মিথ্যেই বলা হবে। প্রভাবশালী কর্তা বেচু দত্তর হাত ছিল এই সিলেকশনের পিছনে। মোহনবাগানের গোলরক্ষক ফিশাইকে বাদ দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণের লবির চাপে। এমনকী, চুনীও টিমে জায়গা পাননি। পরিবর্তে বদ্রু, সিনিয়র খেলোয়াড়দের সরিয়ে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড পরার সুযোগ পেয়েছিলেন। মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের ক্যাপ্টেন করার একটা ট্র্যাডিশন আগে থাকতেই ছিল। তবে সিদ্ধান্তটা বিতর্কিত হলেও, ভারতের অধিনায়কত্ব কোনও অযোগ্য ব্যক্তি করছেন, এমনটা কেউই দাবি করতে পারেননি।

সৈয়দ আবদুল রহিম বা রহিম সাবের ভারতীয় দল ছিল নতুন খেলোয়াড়ে ভর্তি। হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের লজ্জা মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়ে, রামান, সাত্তার, ভেঙ্কটেশ বা শৈলেন মান্নার মত বড় বড় নামকে সরিয়ে যে দলটা গড়া হলো, তার গড় বয়স ছিল তেইশ বছর। দলের মতো কোচের প্ল্যানিংটাও ছিল এক্কেবারে নতুন। দুজন ব্যাক নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত ভারতে তিনি এনেছিলেন তিন ব্যাকের কনসেপ্ট। হাঙ্গেরির যে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স দল ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল, পুশকাস-কচসিস-হিদেগকুটির সেই দলের ট্যাকটিকাল অ্যাপ্রোচ ধার নেওয়ার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন রহিম সাব। হাঙ্গেরির কোচ গুস্তাভ সেবেস হিদেগকুটিকে একজন পিছিয়ে আনা স্ট্রাইকার হিসেবে খেলিয়ে, ম্যান-টু-ম্যান মার্কিংয়ের যুগে বিপক্ষের ডিফেন্সকে বিভ্রান্ত করে দিতেন। ঠিক একই ভূমিকায় বদ্রুকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন রহিম সাব। এই উইথড্রন স্ট্রাইকারের রোলটাকে আধুনিক ফুটবলে নতুন করে জনপ্রিয় করেছিলেন পেপ গুয়ার্দিওলা– মেসিকে বার্সেলোনায় 'ফলস নাইন' হিসেবে সফলভাবে খেলিয়ে। উইথড্রন স্ট্রাইকার হিসেবে সফল হতে গেলে ড্রিবলিং আর ফিনিশিং দক্ষতার পাশাপাশি সুচারু গেমরিডিং ক্ষমতা, পাসিংয়ের পাকা চোখ আর বিচক্ষণ পজিশনাল সেন্স দরকার পড়ে। ভারতীয় দলের নামীদামি ফরোয়ার্ডদের মধ্যে রহিম সাব যে বিশেষভাবে বদ্রুর অল-রাউন্ড ক্ষমতার ভক্ত ছিলেন, তা আর বলে দিতে হয় না।

মেলবোর্নে নভেম্বরে গিয়ে পৌঁছেছিল ভারতীয় দল। ভারতের প্র্যাকটিস মাঠের পাশেই সোভিয়েত দলের হয়ে অনুশীলন করেছিলেন শতাব্দীর সেরা গোলরক্ষক লেভ ইয়াশিন। ভারতের প্রথম ম্যাচের বিপক্ষ হাঙ্গেরি নাম তুলে নেয় টুর্নামেন্ট থেকে। হাঙ্গেরিতে তখন চলছিল ব্যাপক রাজনৈতিক অশান্তি। সোভিয়েতের বজ্রমুষ্টির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল গণ-অভ্যুত্থান। এই হাঙ্গেরীয় বিপ্লবে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি যোগ দেন ফুটবলাররাও। বিশেষত ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স দলের প্রতিভাধর কিপার গ্রসিচস এই সময়ের রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।

ভারত সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়। অস্ট্রেলিয়ার টিম ছিল বেশ শক্তিশালী। তাছাড়া আয়োজক দেশের জাতীয় দল হোম অ্যাডভান্টেজের জোরে খানিকটা সুবিধে তো পায়ই। ১ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ম্যচের শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক খেলছিল ভারত। বদ্রুর একটা শটের রিবাউন্ডের থেকে গোল করে নবম মিনিটে স্কোরিং ওপেন করেন নেভিল ডিসুজা। অস্ট্রেলিয়ার স্বনামধন্য খেলোয়াড় ব্রুস মরো সমতা ফেরান। পিকে-র ক্রসে আবার একটি গোল করেন নেভিল। ফের ইকুয়ালাইজ করেন মরো। দ্বিতীয় অর্ধে কোচের নির্দেশে গতিশীল উইংপ্লেতে আরও জোর দিয়ে ভারত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল। নেভিল ডিসুজা আরেকটা গোল করে অনেকগুলো রেকর্ড হস্তগত করেন। প্রথম এশীয় খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিক হ্যাট্রিকের পাশাপাশি অলিম্পিক ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে নিজের অভিষেক ম্যাচে তিন গোল করেন তিনি। চতুর্থ গোলটা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে যোগ করেন কিট্টু। সেই অলিম্পিকে আর কোনও এশীয় দল জেতেনি একটিও ম্যাচ। ভারত ৪-২ গোলে হোম টিমকে পরাভূত করে গোটা ফুটবল জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিয়েছিল। তাদের আধুনিক ফুটবল স্টাইল দেখে অস্ট্রিয়ার ফুটবল চিন্তক ও সাংবাদিক উইলহেলম মিয়েসল মন্তব্য করেন যে ভারতীয় ফুটবল একটা দুর্দান্ত বিপ্লবের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভারতের সাজঘরে এসে দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন।

আগের দুটো অলিম্পিকে রূপোর মেডেল জেতা যুগোস্লাভ দলের সঙ্গে সেমিফাইনাল ম্যাচ পড়েছিল। চার বছর আগেকার হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ভারতকে দশ গোল দিয়েছিল যুগোস্লাভিয়া। ভারতের ফার্স্ট চয়েস কিপার পিটার থঙ্গরাজ এই ম্যাচটা খেলতে পারেননি। যুগোস্লাভ দলের শারীরিক শক্তির বিরুদ্ধে ভারত গতি ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে লড়ার চেষ্টা করেছিল। প্রথমার্ধ গোলশূন্য শেষ হলেও, ভারতীয় খেলোয়াড়দের ক্লান্তিটা স্পষ্ট হয়ে আসছিল। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে তেজালো এনার্জির শেষ বিন্দু নিকিয়ে এনে নেভিল ডিসুজা প্রতিযোগিতায় তাঁর চতুর্থ গোলটা দিলেন। নেভিল এরপরও একটা শট মেরেছিলেন। সেটা বারে না লেগে গোলে ঢুকলে ভারত অলিম্পিক ফুটবলে একটা পদক নিশ্চিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলত হয়তো। ৫৪ মিনিটে সমতা ফেরায় যুগোস্লাভিয়া। ম্যাচের রাশ পুরোপুরি চলে যায় তাদের হাতে। ৫৯ মিনিটে গোল দিয়ে তারা এগিয়েও যায়। ম্যাচের শেষে ৪-১ গোলে ভারতকে হারিয়ে একটানা তৃতীয় অলিম্পিক ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল যুগোস্লাভ দল।

ব্রোঞ্জ মেডেলের ম্যাচে বুলগেরিয়া হতোদ্যম ভারতকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। ছয়দিনের মধ্যে তিনটে ম্যাচ সমান ইনটেনসিটিতে খেলার মতো শারীরিক সক্ষমতা ভারতীয় প্লেয়ারদের ছিল না মোটেই। নেভিল ডিসুজা অলিম্পিক টুর্নামেন্টের টপ স্কোরার হয়েছিলেন। জাপানের কুনিশিগে কামামোতো ছাড়া আর কোনও এশীয় খেলোয়াড়ের এই বিরল কৃতিত্ব নেই। ভারতের চতুর্থ হওয়াটাই অলিম্পিকে ভারতের ফুটবল দলের সেরা ফিনিশ। প্রতিযোগিতায় একটিও গোল করেননি বদ্রু, কিন্তু তাঁর অপরিসীম প্রভাব দলের আক্রমণভাগকে ঝাঁ-চকচকে করে তুলেছিল। নোভি কাপাডিয়া লিখেছেন বদ্রু ছিলেন ভারতের প্রথম 'রোভিং স্ট্রাইকার', অর্থাৎ এমন একজন খেলোয়াড় যিনি বিপক্ষের অর্ধে ঘুরে ঘুরে স্পেস খুঁজে আক্রমণ শানান। তাঁর এই মুভমেন্টের কারণে তাঁকে মার্ক করা কঠিন হয়ে যায়। ফুটবল কোশেন্ট বেশ উঁচুদরের না হলে এই পজিশনে সফল হওয়া কঠিন।

১৯৫৭ সালে মোহনবাগান নিজেদের রাজপাট ধরে রাখতে পারেনি। লিগ আর শিল্ড দুইই জেতে মহামেডান। ১৯৫৮ সালে ক্লাবের ক্যাপ্টেন করা হয় বদ্রুকে। দুর্ভাগ্যের, এই সিজনে মাত্র দুই পয়েন্টের জন্যে লিগ হাতছাড়া হয় মোহনবাগানের। শিল্ড ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ১-১ ড্র করার পর রিপ্লেতে ১-০ গোলের সূক্ষ্ম মার্জিনে হেরে গিয়েছিল মোহনবাগান।

১৯৫৯ সালে, ত্রিশ ছুঁই-ছুঁই বদ্রু চাকরি পেয়েছিলেন বার্মা শেল কোম্পানিতে। তাঁর পোস্টিং হয়েছিল শিলিগুড়িতে। দূরত্বের বাধা তুচ্ছ করে কিছুদিন শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা যাতায়াত করে, চাকরিটা রেখেও ফুটবলের সাধনা করার চেষ্টা করে বদ্রু বুঝেছিলেন যে এইভাবে সম্ভব নয়। সেই সিজনে লিগ জিতেছিল মোহনবাগান। সিজনের শেষে অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নেন বদ্রু। ফর্মে থাকতে থাকতেই খেলাটাকে বিদায় জানানোর মাধ্যমে পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর হিসেবি সিদ্ধান্ত-গ্রহণ করার ক্ষমতা আমাদের কাছে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।

মোহনবাগানের হয়ে মাত্র আট বছরের একটা স্প্যানে তিনি জিতেছিলেন চারটি কলকাতা লিগ, একটি ডুরান্ড কাপ, তিনটি আইএফএ শিল্ড এবং একটি রোভার্স কাপ। এছাড়া ভারতের হয়ে অলিম্পিকে চতুর্থ হওয়ার পাশাপাশি জিতেছিলেন কলম্বো কাপ। প্লেয়ার হিসেবে দুবার সন্তোষ ট্রফি জিতবার পর, কোচ হিসেবেও বাংলাকেও জিতিয়েছিলেন ওই শিরোপা।

২০০৯ সালে তিনি মোহনবাগান রত্ন সম্মান লাভ করেন। মোহনবাগানের অক্লান্ত সমর্থক বদ্রু তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে মোটা টাকার হাতছানি উপেক্ষা করে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলার সুযোগ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন। ২০২০র মার্চে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়েছিল।

পৃথিবীর বুকে ন'টা দশক কাটানোর পরেও, প্রায়ই হাওড়ার নানা মাঠে গিয়ে তরুণ খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতে তাঁকে দেখা যেত। বিরানব্বই বছর বয়সে তাঁর মহাপ্রয়াণ আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় ফুটবলের এক ইন্দ্রপতন। অলিম্পিকের মাঠে, যুগের তুলনায় অগ্রসর একটি পজিশনে দাপিয়ে খেলা, বাঙালি ক্যাপ্টেন সমর ব্যানার্জি ভারতীয় ফুটবল রসিকের স্মৃতিতে নিঃসন্দেহে মৃত্যুহীন রয়ে যাবেন।

More Articles