রাস্তায় রাত কাটানো থেকে অমিতাভের বন্ধুত্ব, যা রেখে গেলেন বিক্রম গোখলে

Vikram Gokhale: আট, নয়ের দশকের অধিকাংশ জনপ্রিয় ছবিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। একাধিক সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।

চলে গেলেন অভিনেতা বিক্রম গোখলে। থিয়েটার, বলিউড থেকে মারাঠি সিনেমা জগতের এই অন্যতম নক্ষত্রের চিরবিদায় ঘটল। মহারাষ্ট্রের পুনের এক বেসরকারি হাসপাতালে ৮২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই অভিনেতা। প্রায় ১৫ দিন ওই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যু ঘটেছে তাঁর। প্রবীণ অভিনেতা বিক্রমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল কয়েক দিন আগে থেকেই। তারপর ওঠে মৃত্যুর গুজব। বাড়ির সূত্রে জানানো হয়, সেই খবর রটনা আসলে। তারপরেই আশাব‍্যঞ্জক খবর আসে, জানা যায়, চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন প্রবীণ অভিনেতা। তারপর আবার ধীরে ধীরে অবস্থা খারাপ হয় তাঁর। এরপরেই ভেন্টিলেশনে থাকাকালীন মৃত্যু হয় অভিনেতার।

কিন্তু কে এই অভিনেতা? কেন বলিউড শুধু নয়, ভারতের চলচ্চিত্র জগতে তিনি অন্যতম! কী যোগ রয়েছে অমিতাভের সঙ্গে?

বিক্রম গোখলে (১৯৪৫-২০২২)
১৯৪৫ সালের ১৪ নভেম্বর। তৎকালীন বোম্বের পুনেতে জন্ম হয় এই বিক্রমের। বাবা মহারাষ্ট্রের থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নাটকের অভিনেতা হিসেবে নাম ছিল চন্দ্রকান্ত গোখলের। বিক্রমের ঠাকুমা কমলাবাই গোখলেও ছিলেন অভিনেত্রী।

যদিও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত পরিবারের সন্তান হলেও ছোটবেলা থেকেই অভাব ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। পড়াশুনায় বরাবর ভালো ছিলেন বিক্রম। সঙ্গে ছিল অভিনয়ের প্রতি ঝোঁক। এরপর পরিবারের অন্যান্য অনেকের মতোই থিয়েটারে যোগ। কথা, জাওয়াই মাঝা ভালা, খাড়া সঙ্গৌচা তার- একাধিক মারাঠি নাটকে অভিনয় দিয়ে শুরু করেন অভিনয়-জীবন।

চলচ্চিত্রে গোখলে
একাধিক নাটকে নজর কাড়েন তিনি। এরপর ১৯৭১ সাল নাগাদ জীবনের প্রথম পর্বেই সুযোগ পান হিন্দি ছবি 'পারওয়ানা'য়। এখান থেকেই যোগাযোগ শুরু হয় অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে। কয়েক বছর আবার লড়াই। ১৯৭৩ নাগাদ একটি মারাঠি ছবিতে অভিনয়। তারপর ফের বলিউডে ফিরলেন ১৯৭৭ সালে। 'এ হ্যায় জিন্দেগি', 'ভিংরি' ছবিতে অভিনয়। পরের বছরই 'স্বর্গ নরক', তারপর প্রেম বন্ধন, জয় বাবা অমরনাথ, বিবেক- সিনেমায় অভিনয়। এরপর ফের; বিক্রম বেতাল, ইনসাফ, ফালাক, অগ্নিপথ, ইশ্বর, ধর্ম সংকট, খুদা গাওয়া, অধর্ম, বলবান- ছবিতে অভিনয়।

অমিতাভ বচ্চন থেকে বিনোদ খান্না। অনিল কাপুর থেকে সঞ্জয় দত্ত, সলমন খান। আট, নয়ের দশকের অধিকাংশ জনপ্রিয় ছবিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। একাধিক সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।

অমিতাভ-বন্ধুত্ব
'পারওয়ানা' সিনেমায় যে অমিতাভের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রপাত। সেই অমিতাভের সঙ্গে বিক্রমের বন্ধুত্ব ছিল আজীবন। অগ্নিপথ থেকে খুদা গাওয়া। একাধিক সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেছেন দু'জনে। চলেছে খুনসুটি। মনোমালিন্য হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি কিছুই। ক্রমশ বন্ধুত্ব গভীর হয়েছে দুই সত্তার।

এই বন্ধুত্বের এক স্মৃতি সামনে আসে বারবার। একবার প্রবল আর্থিক সংকটে পড়েন বিক্রম গোখলে। থাকার জায়গা ছিল না তাঁর। মারাত্মক করুণ অবস্থা। একাধিক ছবিতে অভিনয় করার পরেও টাকা নেই তাঁর হাতে! সংসার চালানো তো দূর, থাকবেন কোথায়, এই প্রশ্নেই বিপদে পড়েন তিনি। ঠিক সেই অবস্থায় বন্ধুর এই অসহায়তার কথা জানতে পারেন অমিতাভ। মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মনোহর যোশীকে (১৯৯৫-১৯৯৯) চিঠি লেখেন শাহেনশাহ। মুম্বইয়ে থাকার জায়গা জোটে তাঁর। একাধিক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বিক্রম। বন্ধুর সাহায্যের কথা বারবার ব্যক্ত করেছেন এই অভিনেতা। বচ্চন পরিবারের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল তাঁর। বন্ধুর বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল এই অভিনেতার। জীবনের শেষ সিনেমা 'নিকম্মা' দেখেও বন্ধুকে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন অমিতাভ। এমনকি তাঁর অসুস্থতার সময়েও খোঁজ নিয়েছেন তিনি।

জনপ্রিয়তার শিখরে বিক্রম
১৯৯৯। নন্দিনীর রাগী বাবা হিসেবে প্রবল জনপ্রিয় হন বিক্রম গোখলে। বর্তমানে বচ্চন পরিবারের বৌমা অভিনেত্রী ঐশ্বর্য রাই এবং সলমন খান অভিনীত 'হম দিল দে চুকে সনম' ছবিতে ঐশ্বর্যের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সেই ছবিতে তাঁর অভিনয় নজর কাড়ে সে-বারও।

এছাড়াও একাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। বারবার হয়েছেন প্রশংসিত। 'হে রাম', 'তুম বিন', 'ভুলভুলাইয়া', 'মিশন মঙ্গল', 'হিচকি', শেষে 'নিকম্মা' সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি।

'বঞ্চিত বিক্রম'
বরাবর ভালো অভিনয় করে গেলেও একটা সময়ে কাজ পাননি তিনি। ১৯৭১ এর পর কয়েক বছর পরিচালকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন কাজের জন্য। আবার ১৯৯৫ সালের পরে কয়েক বছর চূড়ান্ত কাজহীন সময় কাটাতে হয়েছে অভিনেতাকে। ছিল আর্থিক কষ্টও। অবসাদে ভুগেছেন বিক্রম। আবার অনেক কম বয়সেই পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন বাবা-কাকা হিসেবে। সুযোগের অভাবে বহু ছোট ছোট, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে এই দুঁদে অভিনেতাকে। তবুও তিনি লড়েছেন। আর্থিক অভাব কাটিয়ে লড়ে গিয়েছেন বারবার।

২০১৬ সাল নাগাদ মঞ্চে অভিনয়ে ইতি টানতে হয় তাঁকে। আচমকা গলায় সমস্যা দেখা দেয় অভিনেতার। ভেঙে পড়েন। কিন্তু ফের ঘুরে দাঁড়ান।

মারাঠি সিনেমা জগতের আলো ছিলেন তিনি। এমনকি অমিতাভ বচ্চনের মারাঠি সিনেমায় অভিনয়ের ক্ষেত্রেও হাত ছিল তাঁর। 'এবি আনি সিডি' ছবিতে একসঙ্গে অভিনয় করেন দুই বন্ধু। প্রশংসিত হয় সেই ছবিও।

জীবনপথের ক্যানভাসে পার্শ্ব সংযোগ হয়েই রয়ে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু মঞ্চ আর লাইট ক্যামেরা অ্যাকশনের দুনিয়ায় হয়ে উঠেছেন অভিনব আর অনন্য এক চরিত্র। যাঁর প্রত্যেক মুহূর্তের এগিয়ে যাওয়া আর নানা প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা উজ্জ্বল করেছে তাঁর সত্তাকে। তাই বিক্রম হয়ে উঠেছেন ভিন্ন। খানিকটা মৌলিকও।

More Articles