যোগীরাজ্যের গণপিটুনি-সংস্কৃতি বাংলাতেও! একের পর এক ঘটনায় প্রশ্ন
Mob Lynching: তবে কি আইনের শাসনে ভরসা রাখতে পারছেন না আর মানুষ? ক্রমে কি বাংলাও রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ হয়ে যাচ্ছে বাংলাও। কোন জায়গা থেকে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে চাইছে মানুষ?
রাজ্য জুড়ে হঠাৎ করেই গণপিটুনির দৌড়াত্ম্য। জেলা থেকে শুরু করে খাস কলকাতা, একের পর এক খবর আসছে তো আসছেই। কেন হঠাৎ করে এই গণপিটুনির প্রাবাল্য? জড়ো হওয়া জনতা যখন সর্বসম্মত ভাবে কোনও একজনকে কোনও একটি বিষয়ে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে নিজেরাই সাজা দিতে বসে যায়, দেশের আইনব্যবস্থার উপর ভরসা না রেখেই, তখনই তা রূপ নেয় গণপ্রহারের। এর নেপথ্যে কাজ করে সেই সম্মিলিত মানুষের রায় বা জনাদেশ। আর তাঁরা ধরেই নেন, এই সম্মিলিত মানুষের সমষ্টি কখনওই ভুল বা অন্যায় করতে পারে না। ফলে দোষী ভেবে নেওয়া সেই ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া যেতেই পারে। মারধর করা যেতে পারে। এই সাজা দেওয়ার নেপথ্যে কি কোনও ভাবে মিশে থাকে নিজেকে সর্বশক্তিমান বা ঈশ্বরতুল্য মনে করার মানসিকতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তো দেখা যায় এই ধরনের জনাদেশের ভুক্তভোগী হন তুলনামূলক ভাবে দুর্বল, অক্ষম মানুষটি।
কখনও চোর সন্দেহে তো কখনও ছেলেধরা সন্দেহে, কখনও বা সালিশি সভায় তো কখনও বা ডাইনি সন্দেহে চলে গণপ্রহার। গত কয়েক সপ্তাহে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একের পর এক গণপিটুনির খবর এসেছে। যা উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে প্রশাসনের পাশাপাশি সরকারকেও। দিন কয়েক আগেই শিয়ালদহগামী দত্তপুকুর লোকালে দেখা যায়, বাজারের ব্যাগে বসিয়ে দশ মাসের সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছেন মা। কিন্তু যাত্রীরা ওই মহিলাকে ভেবে বসেন ছেলেধরা। বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা ছড়ায় বিরাটি স্টেশনে। মারধর করা হয় মহিলাকে। কেড়ে নেওয়া হয় কোলের সন্তানকে। বিহারের বাসিন্দা ওই মহিলার ভাষাগত সমস্যা থাকায় তিনি বোঝাতে পারেননি সন্তানটি তাঁরই। তার উপর মানসিক সমস্যাও রয়েছে তাঁর। পরে তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে, শিশুটি মহিলারই সন্তান। কয়েকমাস আগে বামনগাছির রেলবস্তিতে তাঁরা থাকতে শুরু করেছিলেন। যোগাযোগ করা হয় তাঁর স্বামী রামেশ্বরের সঙ্গে। প্রমাণ দেখিয়ে স্ত্রীকে তো উদ্ধার করেন রামেশ্বর। কিন্তু সন্তানটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে হোমে। সন্তানের জন্মের প্রমাণপত্র দেখানো সত্ত্বেও সন্তান ফেরত পাননি দম্পতি।
আরও পড়ুন: অপহরণ থেকে শুরু করে সিপিএম নেতা খুন! পুলিশের খাতায় ‘অপরাধে’র লম্বা তালিকা চোপড়ার জেসিবি-র
না, এমন ঘটনার শেষ এখানেই নয়। বেশ কয়েকদিন ধরেই বারাসতে ছেলেধরা বেরোনোর গুজব রটে। এক বালকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। ওই বালকের মৃত্যুর সঙ্গে শিশু চুরি বা ছেলেধরার কোনও সম্পর্ক নেই বলে আগেই জানিয়েছিল পুলিশ। তবু গুজব থামেনি। গুজবের জেরে বুধবার বারাসতের দুই এলাকায় দু’টি পৃথক ঘটনা ঘটে। মোল্লাপাড়ায় এক ব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় জনতা। অন্য দিকে, মডার্ন স্কুলের সামনে এক মহিলা এবং তাঁর সঙ্গীকেও একই ভাবে ছেলেধরা মনে করে বেধড়ক মারধর করা হয়। অভিযোগ, পুলিশের সামনেই ওই দু’জনকে টেনে হিঁচড়ে মারধর করা হয়। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে, তা সামাল দিতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। আক্রান্ত তিন জনই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বারাসত পুলিশ জেলার সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়া বুধবার সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, বারাসতে কোনও শিশুচুরির ঘটনাই ঘটেনি। যে বালকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই গুজব, তাকে খুন করা হয়েছে। খুনের অভিযোগে এক জনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। ছেলেধরার সঙ্গে সেই খুনের সম্পর্ক নেই। বারাসতে মোট তিন জনকে গণপিটুনির ঘটনায় মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বারাসতের পর একই রকম ঘটনা ঘটে অশোকনগরেও। ছেলেধরা সন্দেহে এক তরুণীকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটে শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পুমলিয়ায়। খবর পেয়ে তরুণীকে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে উদ্ধার করতে যায় পুলিশ। ছাড় পায়নি তারাও। স্থানীয় সূত্রে খবর, আহতের নাম রজনী খাতুন। ২৮ বছরের রজনীর বাড়ি ডায়মন্ড হারবার এলাকায়। সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান তিনি। পুলিশ সূত্রে খবর, বিকেলে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কিছুটা মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন ওই তরুণী। তাঁকে দেখে সন্দেহ কয়েক জন স্থানীয়ের। অভিযোগ, বিনা প্ররোচনায় শুরু হয় ওই তরুণীকে মার। কয়েক’শো মানুষ ঘিরে ধরেন একা ওই তরুণীকে। শুধু বারাসত বা অশোকনগর নয়, খড়দাতেও ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির অভিযোগ এক যুবককে ৷ চড়, লাথি, ঘুষি সবকিছুই চলল স্রেফ সন্দেহের বশে ৷ ওই যুবককে রাস্তায় ফেলে মারধর করার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে সোশাল মিডিয়ায় ৷ মারধরের জেরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় এই আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আহত যুবক ৷ শুক্রবার রাতের এই ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে খড়দার রুইয়া এলাকায় ৷
গত ২৬ জুন ডাইনি সন্দেহে মারধর করা হয় দার্জিলিংয়ের ফাঁসিদেওয়ার এক মহিলাকে। জানা গিয়েছে স্বামীর মৃত্যুর কাজকর্ম শেষ হতেই ডাইনি অবাদ দিয়ে বাচামণি টুকুকে মারধর করা হয়। এরপর ওঁই গৃহবধূকে গাড়িতে তুলে ভাইয়ের বাড়িতে ফেলে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আরও অভিযোগ করা হয়, মহিলা মদ্যপ অবস্থায় রয়েছেন, তাই ভাইয়ের কাছে দিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর ২ দিন ধরে জ্ঞান না ফেরায় এবং মহিলার শরীর দেখতেই চমকে ওঠেন পরিবারের লোকজন। তাঁর শরীরে ছুরির আঘাত রয়েছে বলে দাবি করেছে মহিলার আত্মীয়রা। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গত ২৮ জুন, শুক্রবার বউবাজারে মোবাইল চোর সন্দেহে ইরশাদ আলম নামের এক যুবককে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। যে ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার এনআরএস হাসপাতালের সামনে মোবাইল চোর সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনির অভিযোগ উঠেছে। মোবাইল চোর সন্দেহে এক যুবককে বেধড়ক মারধর করেন কয়েক জন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান ওই যুবক। তার পর ৪-৫ জন মিলে তাঁকে মারধর করে। এই ঘটনার একটি ভিডিয়োও ছড়িয়েছে। সেখানে বেল্ট দিয়েও মারতে দেখা যাচ্ছে চুরিতে অভিযুক্তকে। খবর পেয়ে আহত যুবককে উদ্ধার করে মুচিপাড়া থানার পুলিশ। আদৌ তিনি মোবাইল চুরি করেছিলেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।
এ মাসের গোড়ায় খিদিরপুরে এক গেস্ট হাউজের সামনে এক যুবককে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠেছে। জানা গিয়েছে, ওই যুবক উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। গত সোমবার রাতে খিদিরপুরের ওই গেস্ট হাউজে ভিন রাজ্যের কয়েকজন যুবকের সঙ্গে গেস্ট হাউজের সামনে বসে থাকা কয়েকজনের ঝামেলা হয়। গেস্ট হাউজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, তাঁদের এক গেস্টের পানের পিক ফেলতে বাইরে যান। সে সময়ে কারোর সঙ্গে ধাক্কা লাগে। তা নিয়ে ঝামেলা। পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছে গেস্ট হাউজ কর্তৃপক্ষ। আহতরা ইকবালপুর হাসপাতালে ভর্তি।
গত রবিবার, হুগলির তারকেশ্বরে নাইটামাল পাহাড়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের রানাবাঁধে। সেখানে গাড়িচালক ২৩ বছর বয়সি বিশ্বজিৎ মান্নাকে স্থানীয় মানুষ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাদের সন্দেহ ছিল, বিশ্বজিৎ গাড়ি চুরি করেছে। পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় একটি পরিবারের বাবা, ছেলে ও তাদের কিছু বন্ধু মিলে বিশ্বজিৎকে বেধড়ক মারে। মারের চোটে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। পরিবারের সদস্যরা রাত দুইটা নাগাদ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেদিনই উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়ায় সালিশি সভায় এক যুগলকে রাস্তায় ফেলে ভয়াবহ মারধরের অভিযোগ ওঠে এলাকার স্থানীয় দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিচিত এলাকায় সে। অন্যদিকে, পাণ্ডুয়ায় মনসা পুজোয় মাইক বাজানো নিয়ে গণ্ডগোলের জেরে এক যুবককে রাস্তায় ফেলে বাঁশ দিয়ে পেটানো হয়। তার রক্তবমি শুরু হয় এবং একদিনের মাথায় ওই যুবকের মৃত্যু হয়। অভিযোগ, ওই যুবক মাইক বাজানো নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। মাইক বাজানো নিয়ে প্রতিবাদের জেরে তাকে বেধড়ক মারা হয়।
ঝাড়গ্রামেও ঘটেছে একই রকম ঘটনা। ঝাড়গ্রামে চুরির সন্দেহে বেধড়ক মারের ফলে একজন যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গত ২২ জুন একটি স্কুটি নিয়ে সৌরভ সাউ ও তাঁর বন্ধু অক্ষয় মাহাতো ঝাড়গ্রাম ঘুরে দেখতে বেরিয়েছিল। বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় তাঁদের দেখে এলাকার লোকজন চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিতে থাকে। সেসময় তারা নির্মাণ সামগ্রী চুরি করেছে, এই অভিযোগে ব্যাপক পেটানো হয়। তাঁরা যে চোর নয় সে কথায় কান দেয়নি লোকজন, পুলিশ গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁদের দুজনকে উদ্ধার করে হাপাতালে ভর্তি করে, গতকাল সৌরভ সাউয়ের মৃত্যু হয়েছে, বন্ধু অক্ষয় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
আরও পড়ুন: যোগীরাজ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা! হাথরসে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু শতাধিকের
ইতিমধ্যেই রাজ্যজুড়ে গণপিটুনির ঘটনা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। গণপিটুনির ঘটনা শক্ত হাতে দমন করতে নবান্নের তরফে সব জেলার পুলিশকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার পাশাপাশি পরিবারের এক সদস্যকে চাকরি দেওয়া হবে বলেও মঙ্গলবার নবান্নের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে ফের উস্কে উঠেছে রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাত। রাজ্য সরকারের দাবি, গণপিটুনির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, এই মর্মে বিল পাশ হয়েছিল বিধানসভায়। কিন্তু তা আজও আইনে পরিণত হয়নি। ৫ বছর ধরে লালফিতের ফাঁসে আটকে সেই বিল। আর তার জন্য রাজ্যপালকেই দায়ী করেছে সরকার। বিধানসভার স্পিকারের দাবি, রাজ্যপাল স্বাক্ষর করেননি। ফলে বিল আর আইনে পরিণত হয়নি। এই অভিযোগের পালটা জবাব দিয়ে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের দাবি, রাজ্যের কাছে বিল সংক্রান্ত কিছু ব্যাখ্যা তলব করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার জবাব এখনও পাননি। সব মিলিয়ে গণপ্রহার নিয়ে রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাতের মধ্যেই প্রশাসনকে ভাবাচ্ছে গণপিটুনির বাড়বাড়ন্ত। তবে কি আইনের শাসনে ভরসা রাখতে পারছেন না আর মানুষ? ক্রমে কি বাংলাও রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ হয়ে যাচ্ছে বাংলাও। কোন জায়গা থেকে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে চাইছে মানুষ? কীভাবে বন্ধ হবে এই সামাজিক ব্যাধি? স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে বড়সড় প্রশ্ন।