কেন প্রতিটি দফায় কম ভোট পড়ছে? কম ভোটে কার লাভ, কার ক্ষতি?

Voter Turn Out 2024 Lok Sabha Polls: ২০১৯ সালের নির্বাচনে অনগ্রসর সম্প্রদায়, মুসলমান এবং দরিদ্ররাই সবচেয়ে কম ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

১৩ মে দেশের মোট ৯৬ টি আসনে ভোট গ্রহণ চলেছে। এই দিন দেশের ৯ টি রাজ্য এবং ১ টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ৮ টি, অন্ধ্রপ্রদেশের ২৫ টি, উত্তরপ্রদেশের ১৩ টি, মহারাষ্ট্রের ১১ টি, মধ্যপ্রদেশের ৮ টি, ওড়িশার ৪ টি, তেলঙ্গানার ১৭ টি বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের ৫ টি করে আসনে নির্বাচন চলেছে। দেশ জুড়ে ৫৪৩ টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩৭৯ টি আসনে ভোটদান প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শেষ। ৪ দফার ভোট হয়ে গিয়েছে, আর ৩ দফার ভোট বাকি। পরিসংখ্যান বলছে, ৪ দফাতেও ভোটের হার ২০১৯ সালের তুলনায় কমই। চার দফাতেই মূলত, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানের মতো বড় রাজ্যগুলিতেই ভোটদানের হার কম। কেন কম ভোট পড়ছে? এতে কোন দল সুবিধে পাবে?

গত ৩০ এপ্রিল, প্রথম এবং দ্বিতীয় দফা ভোটে কত ভোট পড়েছে তার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফা ভোটের ১১ দিন পর এই হিসেব প্রকাশ করা হয়েছিল। ২০ এপ্রিল কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রথম দফায় ভোট পড়েছিল ৬০% এবং দ্বিতীয় দফা ভোটের পর, প্রথমে কমিশনের তরফে জানা যায় ভোট পড়েছে ৬০.৯৬%। ৩০ এপ্রিল কমিশন আবার নতুন পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, প্রথম দফায় দেশ জুড়ে ভোট পড়েছে ৬৬.১৪% এবং দ্বিতীয় দফায় ৬৬.৭১%। দু'দফাতেই প্রায় ৬% করে ভোট বেড়ে যায়। ভোটদানের পরিসংখ্যান বেড়ে যাওয়া নিয়ে, তৃণমূলের তরফে রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও'ব্রায়েন চিঠি পাঠিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে। ৩২ পাতার ওই চিঠিতে পরিসংখ্যান বেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাছে তিনটি দাবি জানানো হয়েছে - প্রথমত, লোকসভা ভিত্তিক ভোটদাতার পরিসংখ্যান জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, কত জন ভোট প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে তা বিস্তারিত জানাতে হবে। তৃতীয়ত, দু'দফায় ভোটার পিছু কত ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে তা জানাতে হবে। ২০১৯ সালে ভোটদানের পরিসংখ্যান ছিল ৬৭.৩৩% যা প্রথম দফার তুলনায় ৪% কম এবং দ্বিতীয় দফার তুলনায় ৩% কম।

আরও পড়ুন- এই নির্বাচনে মোদি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন? যে বিস্ফোরক প্রশ্ন তুলছেন কেজরিওয়াল

প্রথম দফা ভোটে ২১ টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভোটদান হয়। এই দফায় সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছিল লক্ষদ্বীপে, ৮৪.১৬%। সর্বনিম্ন ভোট পড়েছিল বিহারে, ৪৯.২৬%। মূলত নাগাল্যান্ড সর্বোচ্চ ভোটদানের রেকর্ড রাখে কিন্তু নাগাল্যান্ড এই লোকসভার প্রথম দফাতেই রেকর্ড ভাঙে। নাগাল্যান্ডের বাসিন্দারা একাধিক এলাকায় ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিল। ২০১৪ সালে এখানে সর্বোচ্চ ভোট পড়েছিল, ৮৭.৮২% এবং ২০১৯ সালে পড়েছিল ৮৯.৯৯%। প্রথম দফা থেকেও দ্বিতীয় দফায় ভোটের হার কমে ছিল। দ্বিতীয় দফায় সর্বোচ্চ ভোট পড়েছিল ত্রিপুরায়, ৭৪.৪৬%। তারপরেই ছিল মণিপুরের, এই দফায় এখানে ভোটদানের পরিসংখ্যান ছিল ৭৭.৩২%। উত্তরপ্রদেশে ভোট পড়েছিল ৫৪.৮৫% এবং বিহারে ৫৫.০৮%। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোটারের পরিসংখ্যান ছিল ৬২%, যা দ্বিতীয় দফার চেয়ে ৭% কমেছিল। এই দফায় কেরলে মোট ভোট পড়েছিল ৭০.২১%। তার মধ্যে রাহুল গান্ধির কেন্দ্র ওয়ানাডে ভোট পড়েছিল সর্বাধিক (৭২.৭০%)। বাংলায় ভোট পড়েছিল ৭১.৮৪%। তৃতীয় দফা ভোটে দেশ জুড়ে ১১টি রাজ্যে ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে মোট ৯৩ টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলেছে। এই দফায় ভোট পড়েছে, ৬৪.৪%, যা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় পর্বের থেকে কম। ওই বছরের পরিসংখ্যান ছিল ৬৭.৩৩%।

নির্বাচন কমিশনের ভোটার টার্ন আউট অ্যাপের তথ্য অনুযায়ী, এই দফায় পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে ভোট বেশি পড়েছে। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে উত্তরপ্রদেশ। অসমের হার প্রায় ৮১.৬১ %, পশ্চিমবঙ্গের হার প্রায় ৭৪% এবং উত্তরপ্রদেশের হার প্রায় ৫৭.৩৪%। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই একই আসনে ভোট পড়েছিল ৬০.১%। তৃতীয় দফায় গুজরাতের ২৫ টি আসনে ভোট হয়। সেই দিন এই আসনে ভোট পড়েছে ৫৮.১৮%। ২০১৯ সালে যা ছিল ৬৪.৫%। মহারাষ্ট্রের ১১ টি আসন মিলিয়ে ভোট পড়েছে ৬১.৪৪ % এবং ছত্তিশগড়ে সাতটি আসনে মোট ভোট পড়েছে ৭১.০৬%। চতুর্থ দফায় সারা দেশে মোট ভোট পড়েছে ৬২.৮৪ শতাংশ। এক দশকে প্রথমবার সর্বোচ্চ ভোট শ্রীনগরে। এই দিন এই অঞ্চলে ভোট পড়েছে ৩৬.৫৮%। এই আসনেই ২০১৯ সালে ১৪.৪৩%, ২০১৪ সালে ২৫.৮%, ২০০৯ সালে ২৫.৬% ভোট পড়েছিল। চতুর্থ দফায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে জম্মু-কাশ্মীরে। এই দফাতেও সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে বঙ্গে। এরপরই নাম রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের, ভোট পড়েছে ৬৮.০৪% এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, ভোট পড়েছে ৬৮.০১%।

বড় বড় রাজ্যগুলির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে ভোটদানের হার অনেকটাই বেশি। তৃতীয় দফার মোট ভোটেও মহিলা ভোটদাতার সংখ্যা বেশি। এই দফায় বাংলার চারটি আসন - মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, জঙ্গিপুর এবং মুর্শিদাবাদে ভোট ছিল। এই দিন এই চার আসনে ভোট পড়েছে ৭৫.৭৯%। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, অন্যান্য রাজ্য যেমন - উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের তুলনায়, বাংলায় বরাবরই ভোটের হার বেশি। প্রথম দফা ভোটে দেশে মোট ভোটের হার ছিল ৬৬.১৬%, সেই দিন বাংলার ভোটের হার ৮১.৯১%। দ্বিতীয় দফা ভোটে দেশে মোট ভোটের হার ছিল ৬৬.৭১% আর বাংলায় ছিল ৭৫.৭৮%। তৃতীয় দফা ভোটে দেশে মোট ভোটের হার ছিল ৬১.৪৫%, বাংলার নিরিখে সেই সংখ্যা ৭৫.৭৯%। ২০০৯ থেকে ২০১৯ টানা তিন বছর লোকসভা ভোটে সর্বনিম্ন ভোটের হারের রাজ্যগুলির মধ্যে ছিল যোগীরাজ্যও। ২০১৯ সালে যোগীর রাজ্যে রেজিস্টার্ড ভোটারের অধিকাংশ ভোটদান করেননি। এই রাজ্যে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে ৪০% ভোটার ভোট দেননি। উল্লেখ্য, দেশে লোকসভার ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের আসন সংখ্যা ৮০ টি, সবচেয়ে বেশি। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বই, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সর্বনিম্ন ভোটের ট্রেন্ড করে। শুধুমাত্র ১৯৯১ সাল থেকে টানা তিনবার ৫০%-এর বেশি ভোট পড়েছিল। জম্মু ও কাশ্মীরে প্রতিবার কম ভোট পড়ে। ২০১৯ সালে সর্বমোট ভোট পড়েছিল ৪৪.৯ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ছিল ৪৯.৫২%।

আরও পড়ুন-মান বাঁচানোর লড়াই! বহিষ্কৃত হয়ে ফের সংসদে ফিরতে পারবেন মহুয়া মৈত্র?

তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা জানাচ্ছেন, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছিল ৫৮.২%। আবার, ২০১৪ সালে তা হয় ৬৬.৪%। ২০১৯ সালে আরও বেড়ে গিয়ে পরিসংখ্যান হয় ৬৭.৪%। অন্যদিকে, ১৯৫২ সাল থেকে টানা তিনটি নির্বাচনে কিন্তু ভোটারের পরিসংখ্যান বাড়েনি। ফলত, ভোটদান কখন বাড়বে বা কমবে তা জোর দিয়ে বলা যায় না। 'হিন্দুস্তান টাইমস'-এর বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষত পরপর দু'বার নির্বাচনে ভোটের হার বেড়ে গিয়ে, তিনবারের সময়কালে ভোটের হার কমে যায়। বলা যায়, এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করছে, ২০১৯ সালের থেকে ভোটদান কমে যেতে পারে। ২০১৪ সালে সবচেয়ে বেশি ভোট বেড়ে ছিল, প্রায় ৮%। 'হিন্দুস্থান টাইমস'-এর ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে উত্তর এবং মধ্য-র রাজ্যগুলিতে ভোট পড়েছে ৭০%। যেখানে দক্ষিণ এবং পূর্ব রাজ্যগুলিতে ৮০%-এরও বেশি ভোট পড়েছে।

ভোটের হার নিয়ে বিভিন্ন দেশের লেখার ভিত্তিতে আন্দাজ করা যায়, আবহাওয়া, ভোটের উদাসীনতা, দীর্ঘদিন ধরে ভোটদান প্রক্রিয়া চলা, রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা এই সব কিছুর নিরিখেই ভোটের হার কম বা বেশি হয়ে থাকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং ক্যাডার ভিত্তিক দলের জন্যও ভোটের হার বেশি হয়। লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের হার কমে যায়। ২০০৯ সালে লোকনীতি- সিএসডিএস-এর, 'ন্যাশনাল ইলেকশন স্টাডিজ' সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০% জনগণের নাম ভোটার তালিকায় থাকার কথা নয় কারণ ওই ২০%-র মধ্যে কেউ মারা গিয়েছিলেন, আবার কেউ ওই এলাকাতেই থাকতেন না।

'হিন্দুস্তান টাইমস'-এর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, কোভিড১৯-এর পরও ভোটার তালিকায় প্রভাব পড়তে পারে, তাই ভোটার তালিকা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। লোকনীতি-সিএসডিএসের সমীক্ষার তথ্য বলছে, ভোট কম পড়লেও বিজেপির ভোটে তেমন কোনও তফাত হয় না কারণ, যারা ভোট দানে অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে বেশি সংখ্যক মানুষই বিজেপিকে ভোট দেন। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের নির্বাচনে অনগ্রসর সম্প্রদায়, মুসলমান এবং দরিদ্ররাই সবচেয়ে কম ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০২৪ সালের প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষাতেও এই একই তথ্য সামনে এসেছে। তথ্য বলছে, বিরোধী দলের সমর্থকরা ভোট দিতেই যান না কারণ হয়তো তারা মনে করেন, তাদের ভোট দিয়ে কোনও লাভই হবে না। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে, ইস্তেহার নিয়ে বিরোধী দলগুলির সঙ্গে যে বিবাদ হয়েছে তারপর সম্ভবনা রয়েছে, বিজেপির ভোট না হয় কমে যাবে, না হয় বেড়ে যাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটদানের হার দেখে আন্দাজ করা যায় একটি দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি কেমন।

More Articles