মাঝপথ দিয়ে হাঁটলেই মৃত্যু

Teacher's Day: আজ ভাঙামনের টুকরোটাকরা কুড়োতে কুড়োতে বুঝতে চেষ্টা করছি কোন কথার কী মানে, আপাত অনর্থের অর্থ। ভাঙাচোরা মনটা কুড়িয়েবাড়িয়ে নিয়ে যদি আরেকবার স্কুলের সামনে দাঁড়াতে পারতাম।

আমার দেহ যদি হয় পিতামাতা আর জল-হাওয়ার দান, মন তবে শিক্ষকদের দেওয়া। মনের যদি কোনো শরীর থাকে, কোনো অবয়ব, তা যদি যাচাইযোগ্য হয়, তা হলে দেখা যাবে তার অস্থিসন্ধি, কলকব্জা-- শিক্ষকদের ছায়ায় ছায়াময়। নিজের বলতে আছে খুদকুঁড়ো। ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে থাকা, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে চালিয়ে নেওয়া। আর আমার শিক্ষকেরা, দানীশ্রেষ্ঠ। গ্রহণে অক্ষম ছাত্রদেরও তাঁরা ঝুলি উপুড় করে দিয়েছেন। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, দু'একজনের কথা বলি, বলি কার থেকে কী শিখেছি, কী  শিখতে পারিনি, কিন্তু মনে রেখেছি।

আমি বিশ্বাস করি, কোনো কোনো মানুষ গল্পের নদী পকেটে নিয়ে ঘোরে। একদিন নদীটা পকেট থেকে সে বের করে দিতে পারে, সময়সুযোগ এলে। এই বিশ্বাস কোথা থেকে পেলাম? আমার স্কুলশিক্ষক, প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় (তাঁকে আমরা চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় নামে চিনতাম) ক্লাসের দুরন্ত বাচ্চাদের শান্ত করার জন্যে সবচেয়ে ডানপিটে ছেলেটিকে কেন্দ্রে দাঁড় করিয়ে বলতেন- গল্প বল। গল্প বলব বলে বাড়িতে গোগ্রাসে গিলছি চাঁদমামা, সুকুমার রায়, টেনিদা। গল্পের গাড়িতে উঠে কথায় কথায় দামামা পেটানো ছেলেরা সব শান্ত হয়ে যায়। সেই যে গল্পের ভূত ধরেছে, ছাড়ে আর না।

আমি বিশ্বাস করি, পক্ষ একটা নিতেই হয়। এমনকী সেটা যদি পরে গিয়ে ভুল মনে হয়, তবুও, পক্ষ তোমায় নিতেই হবে। আমার স্কুলের ইতিহাস শিক্ষক, নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কোন কৈশোরে এই কথাটি ক্লাসে বলেছিলেন, বলেছিলেন, মাঝপথ দিয়ে হাঁটলে মৃত্যু, হয় ডানপথ, নয় বামপথ। তুমি বেছে নাও। যখন বলেছিলেন তখন এ কথার প্রকৃতার্থ বোঝার বয়স হয়নি। কিন্তু কথাটা সঙ্গে সঙ্গে রয়ে গেছে, কথাটা বড় হয়েছে, গাছের মতো হয়েছে, আমি সেই গাছের তলায় বসে আছি, থাকবও আজীবন। নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, প্রশ্ন করো। পড়ানোর পর পাঁচ মিনিট সময় রাখতেন প্রশ্ন করার জন্যে। কেন প্রশ্ন করতে হবে, কেন প্রশ্ন করা অভ্যেস করতে হবে, কেন প্রশ্ন না করলে লোকটা এমন রেগে যাচ্ছে, তখন বুঝিনি। এখন বুঝি, যদিও প্রিয় শিক্ষককে বলা হয় না, প্রশ্নহীন আনুগত্যের বাস্তুতন্ত্রে এখনও মরে যাইনি, বেঁচে আছি মনে হচ্ছে, তাঁর দেওয়া এই শিক্ষার জন্যেই। বলা হয় না, সেই যে তিনি রীতিমতো অভিনয় করে দেখাতেন, অন্যের দিকে একটা আঙুল মানে নিজের দিকে চারটে, ভুলিনি।

আকাশ অপার, আকাশের পরে আছে আরও আকাশ, মহানীলাকাশ। আর মন হবে ঠিক এমন, অনন্তের কাছাকাছি। সামাজিক খাপখোপ পেরিয়ে মন হবে আকাশমুখী, সদা অবাধ্য, কৌতূহলী। রিকসাওয়ালার থেকে টাকা ফেরত চাওয়া যাবে না, যে তোমার থেকে পিছিয়ে আছে সে যাতে হীনম্মন্যতায় না ভোগে, তা দেখার দায় সর্বদা তোমার। পথে যে কেউ তোমার বন্ধু হতে পারে। সেবায়, নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো প্রত্যাশার মেদ নেই, কোনো প্রদর্শনের অভীপ্সা নেই, কেবল আছে এক অপার্থিব আনন্দ। বিবেকানন্দের বাণী জানার আগে আমার প্রিয়তম শিক্ষক, স্কুলের ইংরেজি মাস্টারমশাই শিবায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন-ছন্দ দেখে এই বোধের আলো আমি ছুঁয়েছি, অর্জন হয়তো করতে পারিনি। তাঁর কাছেই শেখা, আসল সিলেবাস শুকনো সিলেবাসের থেকে অনেক বড়। এখনও সেই মহাসিলেবাস বানিয়ে চলেছি, সিলেবাস আর শেষ হয় না। নিত্যই নতুন কোনো বিদ্যুৎচমক, নতুন কোনো কাব্যপঙক্তি, নতুন ছবি, আশ্চর্য কোনো আলোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। মহতের সামনে নতজানু দাঁড়িয়ে থাকা, শিখেছি।

আরেকজন শিক্ষক, শুদ্ধসত্ত্ব ভট্টাচার্য, ব্ল্যাকবোর্ডে দেশের ম্যাপ আঁকতেন ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে। ছাত্র বুঝেছে, দেশ হবে করতলে আমলকি, চিরচেনা, আলাদা করে প্রমাণ লাগবে না। 

আমার পাড়াতুতো শিক্ষক, শিপ্রা সিংহ রায়, জীবনের বেশিরভাগ সাইকেল। তারপর স্কুটি। নির্লোভ। সর্বদা অন্যের জন্যে বাঁচা। অপরজনের অধিকারের পক্ষে সওয়াল। মাথা উঁচু করে দার্ঢ্য নিয়ে বাঁচা। ঋত্বিক ঘটকের 'মেঘে ঢাকা তারা' দেখার আগে তার স্নেহচ্ছায়ায়, কঠোর-কোমল ব্যক্তিত্বে আমি নীতাকে চিনেছি।

যে শিক্ষকদের কথা ছোট ছোট আঁচড়ে এখানে ধরে রাখছি, তাদের মধ্যে একটা বিষয় সাধারণ, তারা সর্বদা অপরের পক্ষ নিতে বলেছেন, বলেছেন নিজেকে মেলে ধরতে, প্রকাশ করতে। কেউ মুখে বলেছেন, কেউ কাজে বুঝিয়েছেন। জীবনের প্রথমক্ষণে ওঁরা এসেছিলেন, তাই তৎক্ষণাৎ ওদের কথার-কাজের পরিধি বুঝতে না পারলেও, আজীবন বোঝার চেষ্টায় মন সক্রিয় থেকেছে। চেয়েছে প্রকাশিত হতে। এই সক্রিয়তাই মনকে একটা অবয়ব দিয়েছে নিয়ত।

আমার মনের সেই অবয়ব ভারতবর্ষে হাঁটছে। ভারতবর্ষ তার চেনা হওয়ার কথা, কারণ তার শিক্ষক চক না তুলে ব্ল্যাকবোর্ডে ভারতবর্ষের অলিগলি চিনিয়েছে। কিন্তু চেনা পথে হাঁটতে হাঁটতে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে মন, মন পথ গুলিয়ে ফেলছে, মনের মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। মনের শরীরে কালশিটে। মন দেখছে নতুন ভারতের নতুন শিক্ষককে। যে শেখায় অপর হলে গাল পেতে চড় খেতে হয়। একে একে সকলে এসে চড় মারবে। শিক্ষক যা শেখাবেন তাই শিখবে ছাত্র। যেমন আমার মন শিখেছিল। আজ নতুন কারো মন শিখছে, উত্তরপ্রদেশের শিক্ষক ছাত্রদের শেখাচ্ছেন, মহামেডান ছাত্ররা ছুটিতে আত্মীয়বাড়ি যায়। হোমটাস্ক করে না, অতএব তার প্রাপ্য জনে জনে মারা চড়। গাল পেতে চড় খাও, তুমি মহামেডান। যে মারল সে শিখল আজীবন মহামেডানকে চড়াতে হবে, সে সেকেন্ড ক্লাস, চড় খাওয়ার যোগ্য। যে মার খেল সে জানল, মহামেডানকে আজীবন চড় খেতে হবে, সে সেকেন্ড ক্লাস, চড় খাওয়ার যোগ্য।

আমার মন, যে কৈশোরে শিক্ষকের দয়ায় প্রশ্ন করা শিখেছিল, সে মার খেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এখন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। সেখানে কর্মরত অর্থনীতির এক অধ্যাপক তাঁর গবেষণা সামনে এনেছেন। ডেমোক্র্যাটিক ব্যাকস্লাইডিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ডস লার্জেস্ট ডেমোক্রেসি-এই নামের গবেষণায় একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশ্নটি ভোটব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে, শাসকের ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে। যেই প্রশ্ন করলেন, ঠিক তখনই তাঁকে বাধ্য করা হলো ইস্তফা দিতে। প্রশ্নাকীর্ণ, প্রকাশোন্মুখ মন চলে যাচ্ছে আরেকটা ঘটনায়, এই তো কিছুদিন আগেই ঘটল। একজন শিক্ষক নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বলেছিলেন, শিক্ষিত নেতাকে ভোট দাও। তাঁরও চাকরি গেল। তার মানে প্রশ্ন করার মাশুল, নামকাটা। পরিস্থিতি বলছে, প্রকাশভঙ্গিমা সর্বদা হবে 'সেন্সরড'। তাহলে আমার প্রশ্নের মনটা, ভ্রমের আছিলায় ভ্রমণ করা মনটা কোথায় যাবে? প্রশ্ন না করে সে কি চিৎকার করে বলবে, হ্যাঁ হ্যাঁ জানি, তুমি জানাচ্ছ তাই জানি, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান?  একদিকে প্রকাশের ইচ্ছে, অন্য দিকে ভয়ে মৌন থাকার বাধ্যতা, কোনটা বেছে নেবে সে? যে মন দেখে আপোষ আর আপোষ, প্রতিটি ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া, গা বাঁচানো, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, হাত পেতে অন্যায়ভাবে টাকা নেওয়া আর গাল পেতে অন্যায়ভাবে চড় খাওয়া, সে মন কোথায় যাবে!

আরও পড়ুন: কে তুমি?

একদিকে জীবনের প্রথম শিক্ষকেরা। অন্য দিকে প্রতিদিন, ঘটনাপ্রবাহ, নতুন শিক্ষার বহর। বাঁদিকে যারা আছেন তারা মনের কাচঘর গড়েছেন সন্তর্পণে, ডান দিকে যারা আছেন, তারা সেই কাচঘর বুলডোজার চালিয়ে রোজ ভাঙছেন, অপার নির্মমতায়। আমি আমার ভাঙামনের শতখণ্ডের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে্ আছি। মন জানে, মহামেডান মানে চড় খেতে হয়। মন জানে, দেখেও না দেখাটাই নিয়ম। প্রশ্ন করলেই চাকরি থেকে ছুটি। প্রশ্নহীন আনুগত্যই একমাত্র অভিজ্ঞান।

জানে কিন্তু মানে না। মানে না কারণ ওই, অভ্যাসগত প্রতিবর্ত ক্রিয়া। ইতিহাসের শিক্ষক বলেছিলেন, প্রশ্ন করো, প্রশ্ন করো। ভুলো না, বিপ্লব মানে আমূল পরিবর্তন, গাছের মূলটা উপরের দিকে উঠে থাকবে। মাথাটা নীচে। এই পরিবর্তন একদিনে হয় না। সেদিন বুঝিনি। আজ ভাঙামনের টুকরোটাকরা কুড়োতে কুড়োতে বুঝতে চেষ্টা করছি কোন কথার কী মানে, আপাত অনর্থের অর্থ। ভাঙাচোরা মনটা জড়ো করে নিয়ে যদি আরেকবার স্কুলের সামনে দাঁড়াতে পারতাম। শুনেছি, শিক্ষকের অবসরের সময় হয়ে এল।

More Articles