মৃত্যুর সহায়িকা বই! মিশরের রহস্যময় 'বুক অফ দ্য ডেড'-এ আসলে কী আছে?
Book of The Dead: মিশরের এই বুক অফ দ্য ডেড-এর বিভিন্ন মন্ত্রগুলি মানুষকে সঠিক সময়ে সঠিক জিনিস বলতে সাহায্য করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল।
জীবন ফুরিয়ে গেলে কী হয়? মৃত্যুতেই কি শেষ? নাকি মৃত্যু আসলে আরেক জীবনের চৌকাঠ? মরণপরবর্তী অবস্থা নিয়ে কৌতূহল মানুষের চিরকালীন। বিশ্বের বহু প্রাচীন সংস্কৃতিতেই রয়েছে মৃত্যু চেতনার নানা ধারণা, নানা বিশ্বাস এবং বিবিধ চর্চা। প্রাচীন মিশরীয়দের পরকাল সম্পর্কিত বিশ্বাসের চর্চা আজও অবাক করে। প্রাচীন মিশরীয়রা মনে করতেন মৃত্যু আসলে অনন্তের পথে এক দীর্ঘ এবং কঠিন যাত্রার শুরু। যে পথ মোটেও গোলাপ বিছানো নয়। লাখো বাধা এবং হাজারো দানবে পরিপূর্ণ সেই পথ। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের স্বর্গের পথটি ঝুঁকিপূর্ণ। এই কারণেই প্রাচীন মিশরে একটি আস্ত বই ছিল মৃতের জন্য! 'বুক অফ দ্য ডেড’ আসলে মৃত মানুষদের গাইডবুক। অতিপ্রাকৃত অনন্তের পথে কীভাবে যেতে হবে, সেই দিকনির্দেশনার কাজটি করত মিশরীয়দের রহস্যময় এই বই।
বুক অফ দ্য ডেড আসলে কেমন বই?
বই বলে ডাকা হচ্ছে ঠিকই, আসলে কিন্তু মিশরের বুক অফ দ্য ডেড মোটেও কোনও বই নয়। এটি প্রায় ১,০০০ বছর ধরে লেখা নানান মন্ত্রের একটি সংগ্রহ যার কোনও আনুষ্ঠানিক আদেশ, গঠন বা বর্ণনা নেই। এই মন্ত্রগুলি প্রতিটি মৃত ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। মৃতের আবার কেমন চ্যালেঞ্জ? মৃত্যুর পরের সেই যে পথের কথা হচ্ছিল, দানবে আর বাধাতে পূর্ণ, সেই আনকোরা পথে কোনও মৃত ব্যক্তি যা যা সম্ভাব্য বাধার সম্মুখীন হতে পারে সেই সব কাটিয়ে ওঠার মন্ত্রই রয়েছে এই বইতে। এই মন্ত্রগুলি বিভিন্ন রূপে মৃতদেহের পাশেই সমাধিতে রাখা প্যাপিরিতে পাওয়া যেত।
২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ মিশরের রাজাদের সমাধি কক্ষের ভিতরের বিভিন্ন বস্তুর উপর এই মন্ত্রগুলি আঁকা হয়েছিল এবং একে বলা হতো পিরামিড টেক্সট। পরবর্তীকালে মেলে কফিন টেক্সট। যারা রাজা নন কিন্তু অভিজাত, তাদের কফিনে খোদাই করা হতো এই মন্ত্র। এর আগে বিবিধ মন্ত্রের এই সংগ্রহটি খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৬ শতকের দ্য বুক অফ কমিং ফোর্থ বাই ডে' শিরোনামে পুনঃসম্পাদিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন- সর্বাঙ্গ ঢাকা বর্ম পরিয়ে দেওয়া হতো কবর! চিনের মৃতদের এই রহস্য তাক লাগাবে…
এখন চাইলে যে কেউই এই বই কিনতে পারেন। ঢালাও বিক্রি হয় এই 'বই'। বিশেষত যারা জীবন ছেড়ে মৃত্যুর দিকে এগোতে প্রস্তুত তাদের জন্য তো এই বই অপরিহার্য হিসাবেই দেখা হয়। তবে, মৃতপ্রায় মানুষদের সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু অধ্যায় কিনতেই দেখা গিয়েছে। আজ অবধি কোনও কবরেই এই মন্ত্রের আস্ত সংগ্রহটি মেলেনি।
১৮৪২ সালের আগে পর্যন্ত কিন্তু এই মন্ত্রের এই সংগ্রহটিকে বুক অফ দ্য ডেড বলে ডাকা হতো না। জার্মান মিশরবিদ কার্ল রিচার্ড লেপসিয়াস এই নামেই বইটি প্রকাশ করেন।
বুক অফ দ্য ডেডে কী আছে?
মিশরের এই বুক অফ দ্য ডেড-এর বিভিন্ন মন্ত্রগুলি মানুষকে সঠিক সময়ে সঠিক জিনিস বলতে সাহায্য করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। যাতে মৃত ব্যক্তি কোনও রকমের বিপদ ও বাধা ছাড়াই অনন্ত পরকালের জীবনে পৌঁছতে পারে। প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাস অনুসারে, মৃতদেরকে দেবতা ওসিরিসের সঙ্গে দেখা করার জন্য পাতালের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। এই পাতালের পথেই তাদের জীবদ্দশার নানা কাজের অনুযায়ী তাদের বিচার করা হতো।
আরও পড়ুন- নুন দিয়ে দেহ শুকনোর পর কী এমন মাখানো হতো দেহে? অবশেষে ফাঁস মমি তৈরির রহস্য
এই পথটি ভয়ঙ্কর সব দানব এবং অন্যান্য অতিপ্রাকৃত বিপদে ঢাকা। আসলে এই দানবরাই ওই পাতালপথের রক্ষী। পাতালের পথে সেই রক্ষীদের শান্ত বা নিয়ন্ত্রণ করতে করতেই এগোতে হবে। বুক অফ দ্য ডেড-এর অনেক মন্ত্র এমন রয়েছে যা এই শত্রুদের পরাস্ত করার জন্য পাঠ করতে হবে মৃতদের। অনেক এমন প্রশ্নের উত্তর রয়েছে যা দেবতারা মৃতদের জিজ্ঞাসা করবেন এই যাত্রাপথে।
যারা ওসিরিসের কাছে পৌঁছবেন তাদের তখন ৪২টি দেবতার প্রত্যেকের নাম বলতে হবে যারা মৃতদের আত্মার বিচার করেছেন। এর পরে, মৃতদের 'নেতিবাচক স্বীকারোক্তি' পাঠ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে জীবদ্দশায় এই মানুষরা হত্যা, চুরি এই জাতীয় ৪২টি ভিন্ন পাপ থেকে বিরত ছিলেন। এত সব কঠিন পরীক্ষা দিয়ে তবে পরপারের ভিসাতে মিলবে স্ট্যাম্প! ভাগ্যিস এই সমস্ত তথ্য মৃতের বইতে লেখা ছিল। মারা যাওয়ার আগে এই সহায়িকা না থাকলে মৃত পরীক্ষার্থীদের যে কী হতো!
একবার এই সমস্ত চ্যালেঞ্জগুলি সম্পন্ন হলেই মৃত ব্যক্তির হৃদয় আর একটি পালকের সঙ্গে ওজন করা হবে। যদি দাঁড়িপাল্লা সমান সমান থাকে তাহলে ওই ব্যক্তিকে পাপমুক্ত বলে বিচার করা হবে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। যাদের মন পাপের ভারে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে তাদের গ্রাস করে নেবে ওই পাতালপথ।