শিকড়, পাতা, ফুল, ডালপালা কিচ্ছু নেই! তরল গাছ আবিষ্কার করে অসাধ্য সাধন বিজ্ঞানীদের

Liquid Tree : এই তরল গাছ ব্যবহার করে শহুরে সেই জায়গাগুলিকে বাঁচানো সম্ভব যেখানে গাছ লাগানোর কোনও জায়গা নেই।

বাগান করবেন, সাধ আছে। নানা গাছ গাছালিতে, পাখির কিচিরমিচিরে চারপাশ ভরে থাকবে, ইচ্ছে আছে। কিন্তু থাকেন তো হদ্দ শহরে। দেশলাই বাক্সের মতো একের উপর এক ফ্ল্যাটবাড়ি। ছোট্ট একটুকরো ব্যালকনিতে ইচ্ছেরা বনসাই হয়েই থাকে। অতটুকুই ঠাঁই। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে, বাতাসকে প্রাকৃতিকভাবে বিশুদ্ধ করা যাচ্ছে না। গাছ লাগানোর দরকার কিন্তু চারা পুঁতবেন কোথায়? ফুটপাথে কংক্রিট, ছাদে ঢালাই, মাটিই বা কই? ঘনবসতির শহরে সামান্য ঝোপেরই জায়গা নেই, গাছ দূর অস্ত। প্রবল ঘিঞ্জি শহরের জন্য এবার তরল গাছ তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা! তরল গাছ? এ কেমন বস্তু? গাছ কীভাবে তরল হতে পারে জলের মতো? পাতা নেই, শিকড় নেই, ফুল নেই, ফল নেই, কাণ্ড নেই, তবু গাছ! লিকুইড গাছ! অবাস্তব মনে হলেও এমনটাই সম্ভব করেছেন সার্বিয়ান বিজ্ঞানীদের একটি দল।

আইএইচএমই গ্লোবাল হেলথ ডেটা এক্সচেঞ্জ টুল-এর তথ্য বলছে, পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে এইচআইভি/এইডস, যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়ার চেয়ে তিনগুণ বেশি মানুষ মারা যান। দু'টি বিশাল বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে, বেলগ্রেড সার্বিয়ার সবচেয়ে দূষিত শহরগুলির মধ্যে একটি। এই দু'টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০১৯ সালে হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অ্যালায়েন্সের (HEAL) ইউরোপের ১০টি নোংরা কারখানার তালিকায় ছিল। সামগ্রিকভাবে, ২০২০ সালে সবচেয়ে বায়ুর সবচেয়ে খারাপ গুণমানের জন্য সার্বিয়া বিশ্বে ২৮ তম স্থানে রয়েছে। বর্তমানে, দেশটির PM ঘনত্ব ২.৫, যা WHO-এর বার্ষিক বায়ু মানের নির্দিষ্ট মান থেকে ৪.৯ গুণ বেশি। এই দেশের নাগরিকরা তীব্র দূষণের তীব্রতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগেন। ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, ইউরোপের মধ্যে সার্বিয়াতেই দূষণজনিত কারণে মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ। প্রতি ১ লাখে ১৭৫ জন, তারপরেই আছে জর্জিয়া এবং বুলগেরিয়া। সার্বিয়ান জনসংখ্যার ৫৯% শহরাঞ্চলে বাস করে এবং এই হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু জনসংখ্যার ঘনত্ব এত বেশি তাই সবুজ এলাকা তৈরি করা এবং গাছ লাগানো কার্যত অসম্ভব।

এখানেই কিস্তিমাত করেছেন ডঃ ইভান স্পাসোজেভিক। বায়োফিজিকাল সায়েন্সের গবেষক ডঃ ইভান বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিসার্চের প্রকল্পের একজন লেখক। গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে এবং বায়ুর গুণমান উন্নত করার জন্য এক অভাবনীয় জিনিস আবিষ্কার করেছেন তিনি: তরল গাছ। এই তরল গাছের নাম LIQUID 3। এই তরল গাছ সার্বিয়ার প্রথম শহুরে ফটো-বায়োরিঅ্যাক্টর। এতে রয়েছে ছ'শো লিটার জল রয়েছে এবং মাইক্রোঅ্যালগি। কার্বন ডাই অক্সাইডকে আবদ্ধ করতে এবং সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বিশুদ্ধ অক্সিজেন তৈরি করার কাজ করে মাইক্রোঅ্যালগি।

দু'টি ১০ বছর বয়সী গাছ বা ২০০ বর্গ মিটারের সবুজ মাঠ যা করে, এই মাইক্রোঅ্যালগি আসলে সেই কাজই করে। তরল গাছ কেন বলা হচ্ছে তবে? গাছ এবং ঘাস দুই-ই সালোকসংশ্লেষ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইডকে আবদ্ধ করে। মাইক্রোঅ্যালগির গাছের তুলনায় ১০ থেকে ৫০ গুণ বেশি কার্যকর। LIQUID 3-এর নেপথ্যে থাকা গবেষকরা বলছেন, তাঁদের লক্ষ্য বন বা বৃক্ষ রোপণের বিকল্প তৈরি নয়। এই তরল গাছ ব্যবহার করে শহুরে সেই জায়গাগুলিকে বাঁচানো সম্ভব যেখানে গাছ লাগানোর কোনও জায়গা নেই। তীব্র দূষণে অনেক গাছই বেঁচেও থাকতে পারে না। LIQUID 3 বেলগ্রেডের মেকডনস্কা স্ট্রিটে স্টারি গ্র্যাড পৌরসভার সামনে স্থাপন করা হয়েছে। এটি ব্যস্ত শহুরে এলাকা যেখানে CO2 নির্গমনের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।

ফটোবায়োরিঅ্যাক্টর হচ্ছে বায়ু পরিশোধন এবং অক্সিজেন উৎপাদনের একটি সম্পূর্ণ নতুন জৈব প্রযুক্তিগত সমাধান। ছ'শো লিটার জলের অ্যাকোয়ারিয়ামে যা শ্যাওলা আছে তা কার্বন ডাই অক্সাইডকে আবদ্ধ করে এবং সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে বিশুদ্ধ অক্সিজেন তৈরি করে। LIQUID 3 আসলে একটি বেঞ্চ, এতে মোবাইল ফোনের জন্য চার্জার রয়েছে, পাশাপাশি একটি সৌর প্যানেল রয়েছে, যার কারণে রাতেও এই বেঞ্চে এসে বসলে আলো পাবেন। ডঃ ইভান স্পাসোজেভিক বলছেন, এককোষী মিষ্টি জলের শ্যাওলা ব্যবহার করা হচ্ছে যা সার্বিয়ার পুকুর এবং হ্রদে প্রচুর মেলে এবং কলের জলেই বৃদ্ধি পেতে পারে। এই তরল গাছের বিশেষ দেখভালের দরকারও নেই। এটি শ্যাত্তলাগুলিকে আলাদাও করে ফলে জৈববস্তু তুলে ফেলে তা পরে সার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি দেড় মাসে অন্তর নতুন জল এবং এই মাইক্রোঅ্যালগি ঢালা হয় এবং শ্যাত্তলাগুলি অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।

LIQUID 3 নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির স্মার্ট ব্যবহার। নগরোন্নয়ের পরিকল্পনায় এই তরল গাছ যে কতখানি এগিয়ে থাকা একটি ভাবনা তা বলাই বাহুল্য। ভারতের ঘিঞ্জি শহরগুলোতে কি তরল গাছের মাধ্যমে বায়ু পরিশোধন সম্ভব? আগামীতে এমন প্রযুক্তির বাস্তবায়ন এদেশে সম্ভব করতে গিয়ে এগিয়ে আসবেন গবেষক, চিন্তক, পরিবেশপ্রেমী মানুষরা?

More Articles