নারীদের জন্য নিরাপদ কলকাতা! কোথায় দাঁড়িয়ে দেশের অপরাধ মানচিত্র?
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার নিরাপদ শহরের তকমা ছিনিয়ে নিল কলকাতা।
দেশের মধ্যে সবথেকে নিরাপদ শহর ‘সিটি অফ জয়’ কলকাতা। চুরি, খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির মতো অপরাধের ক্ষেত্রে দিল্লির সঙ্গে কোনও তুলনাই হয় না শহর কলকাতার। এমনটাই জানাচ্ছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। নারী সুরক্ষার লড়াইয়ে কলকাতা অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মতো বড় বড় শহরকে। আর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার নিরাপদ শহরের তকমা ছিনিয়ে নিল কলকাতা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রেকর্ড বলছে, কয়েকটি অপরাধের ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও ২০২১ সালেও দেশের সবথেকে নিরাপদ শহর ছিল কলকাতাই। খোদ দেশের রাজধানী দিল্লিতে অপরাধের ভয়ংকর পরিসংখ্যানকে হাতিয়ার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক কী আছে এই রিপোর্টে ?
কেন্দ্রীয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিল্লিতে যেভাবে অপরাধ হয়েছে একের পর এক, তাতে তুলনায় অনেক পেছনে রয়েছে মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ও হায়দ্রাবাদের মতো মেট্রো শহরগুলি। এনসিআরবি-র রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে দিল্লিতে খুন হয়েছেন ৪৫৪ জন। সেখানে মুম্বইয়ে একই বছরে খুন হয়েছেন ১৬২ জন, বেঙ্গালুরুতে ১৫২ জন, চেন্নাইয়ে ১৬১ এবং হায়দরাবাদে ৯৮ জন। অন্যদিকে, গত বছর দিল্লিতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২২৬ জন। সেখানে মুম্বইয়ে এই সংখ্যাটা ৩৬৪, বেঙ্গালুরুতে ১১৭, চেন্নাইয়ে ৪৫ এবং হায়দরাবাদে ১১৬ জন। মহিলাদের জন্য দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক তিন মেট্রোপলিটন শহরের তালিকায় দিল্লি ছাড়া অন্য যে দু'টি শহর রয়েছে, সেগুলি হলো জয়পুর (৫০২টি ধর্ষণের ঘটনা) এবং মুম্বই (৩৬৪টি ধর্ষণের ঘটনা)। কলকাতার কাছাকাছি নিরাপদ শহরগুলির মধ্যে রয়েছে কোয়েম্বাটোর (১২টি ধর্ষণের ঘটনা) এবং পাটনা (৩০টি ধর্ষণের ঘটনা)। সদ্য প্রকাশিত ২০২১ সালের এনসিআরবি (NCRB) রেকর্ড জানিয়েছে, প্রতি লাখ জনসংখ্যা অনুযায়ী, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে কলকাতার অপরাধের হার মাত্র ৯২.৬। সেখানে দিল্লিতে অপরাধের হার ১৭৭১.৭, যা কলকাতার থেকে ১৯ গুণেরও বেশি। গুজরাতের আমেদাবাদে গুরুতর অপরাধের হার ৩৮৮.৩, সুরাতে ৭০০, উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ে ৪৮৮.৬, কানপুরে ২৪৭.৮, রাজস্থানের জয়পুরে ৭৫৯.৫, মুম্বইয়ে ৩৪৫.৯, চেন্নাইয়ে ৫২৯.৯, হায়দরাবাদে ২৩১.৭।
তবে এই প্রথম নয়, কলকাতা এর আগেও প্রত্যেক বছরেই মহিলাদের নিরাপত্তার নিরিখে ভারতের অন্য বড় শহরগুলির তুলনায় এগিয়ে ছিল। ২০২০ সালে এই শহরের ১১টি ধর্ষণের ঘটনার রিপোর্ট করা হয়। ২০১৯ সালে ১৪টি। ২০২১ সালে এই শহরে ধর্ষণের প্রচেষ্টার একটিও রিপোর্ট হয়নি। সব মিলিয়ে কলকাতার অপরাধের সংখ্যাই গত ৭ বছরে একটু একটু করে কমেছে। এমনই বলা হয়েছে রিপোর্টে। ২০২১ সালে নথিবদ্ধ হওয়া অপরাধের সংখ্যা ১৪,৫৯১, ২০২০ সালে তা ছিল ১৮,২৭৭, ২০১৮ সালে সেটিই ছিল ১৯,১৬১। ২০১৮ সাল থেকে দেশের অন্যান্য শহরে যখন ক্রাইম রিপোর্টের গ্রাফ যেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে কলকাতায় অপরাধের গ্রাফ কমেছে নজর কাড়ার মতো। ৩০ অগাস্ট এমনটাই প্রকাশিত হলো এনসিআরবি-র তথ্যে। কলকাতায় অপরাধের হার কমেছে এই তথ্য পেয়ে খুশি লালবাজারের কর্তা থেকে কলকাতা পুলিশের অধিকারিক ও কর্মীরা সকলেই। এপ্রসঙ্গে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল বলেছেন, সাধারণ মানুষের সমর্থন এবং কলকাতার পুলিশকর্মীদের দক্ষতা আর পরিশ্রমের কারণেই আজ এই ঘটনা ঘটেছে। খুন বা খুনের চেষ্টার মতো অপরাধও কলকাতায় বেশ কম। ২০২১ সালে এই দুই অপরাধের সংখ্যা যথাক্রমে ৪৫ এবং ১৩৫। ২০১৮ সালে এটিই ছিল ৫৩ এবং ১২১। মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণের সংখ্যা ২০২১ সালে ১০টি। যা দিল্লি (১৭টি) এবং চেন্নাইয়ের (১৬টি) তুলনায় কম।
আরও পড়ুন: ত্রাসের নাম ডিজিটাল রেপ! নতুন ভারতে কতটা নিরাপদ নারীরা?
এই তালিকায় ভারতের প্রায় প্রতিটি বড় শহরই রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইন্দোর (১৬৫টি ধর্ষণের ঘটনা), বেঙ্গালুরু (১১৭টি ধর্ষণের ঘটনা), হায়দরাবাদ (১১৬টি ধর্ষণের ঘটনা) এবং নাগপুর (১১৫টি ধর্ষণের ঘটনা)। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-র রিপোর্ট বলছে, ১৯টি মেট্রোপলিটন শহর মিলিয়ে ২০২১ সালে ভারতে ৩২০৮টি ধর্ষণের ঘটনার রিপোর্ট হয়েছে। ভারতে প্রতিদিন দেশে গড়ে ৮০টি খুন এবং ৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বছরে মোট ২৯ হাজার ১৯৩টি। তালিকায় শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ। আগের বছরের চেয়ে ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে খুনের মামলা। ২০২০ সালে খুনের ঘটনা ঘটেছিল ২৮,৯১৫টি। প্রতিদিন গড়ে ৭৯টি।এনসিআরবি-র (National Crime Records Bureau) তথ্য বলছে, রাজ্যগুলির মধ্যে খুনের ঘটনায় শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh)। ৩ হাজার ৭৭৯টি হত্যাকাণ্ডের মামলা নথিবদ্ধ হয়েছে যোগীর রাজ্যে। তারপর বিহারে ৩ হাজার ১৫০টি মামলা। মহারাষ্ট্রে ২ হাজার ১৬৩টি ঘটনা ঘটেছে। ২ হাজার ১০১টি খুনের মামলা মধ্যপ্রদেশে। আর পশ্চিমবঙ্গে ১ হাজার ৯৪৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। ধর্ষণের তথ্যও দিয়েছে এনসিআরবি (NCRB)। ২০২১ সালে প্রতিদিন গড়ে ৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মোট ঘটনা ২৮ হাজার ৪৬টি। এর মধ্যে নির্যাতিতার সংখ্যা ২৮,১৫৩। দেশজুড়ে গতবছর মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা ৩,৭১,৫০৩। গতবছরের থেকে তা কমেছে ৮.৩ শতাংশ। ২০২০ সালে ৪,০৫,৩২৬টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল। National Crime Records Bureau (NCRB)-র রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে গত বছরে ৩১৬৭৭টি ধর্ষণের ঘটনার রিপোর্ট হয়েছে। আক্রান্তর সংখ্যা ৩১৮৭৮।
তবে ২০১৮ সাল থেকে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে দিনমজুরদের আত্মহত্যার ঘটনা। সম্প্রতি এনসিআরবি প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে। যে পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে ২০২১ সালে দেশে মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১,৬৪,০৩৩টি। যার মধ্যে ৪২,০০৪ জন ২৫.৬% দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। এনসিআরবি রিপোর্টের ‘অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ অ্যান্ড সুইসাইডস ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক অংশে এই তথ্য জানানো হয়েছে। যদিও এই পরিসংখ্যানে সঙ্গে কৃষকদের আত্মহত্যা অথবা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের আত্মহত্যার ঘটনা যুক্ত করা হয়নি। এনসিআরবি রিপোর্টে ‘পারসনস এনগেজড ইন ফারমিং সেক্টর’ শীর্ষকভাগে দেখানো হয়েছে। যে পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২০২১ সালে কৃষক এবং কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ১০,৮৮১ জন আত্মহত্যা করেছেন। ২০২১ সালের আত্মহত্যার তথ্য অনুসারে সার্বিকভাবে সর্বাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। ২২২০৭টি। ১৮,৯২৫টি আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে তালিকায় এরপরেই নাম আছে তামিলনাড়ু। তৃতীয় স্থানে থাকা মধ্যপ্রদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪,৯৫৬, পশ্চিমবঙ্গে ১৩,৫০০, কর্নাটকে ১৩,০৫৬ এবং দিল্লিতে ২,৮৪০টি।