খাবার গিলতে অসুবিধা? অবহেলা করবেন না, এই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন আপনি

Dysphagia Symptoms: ডিসফ‍্যাগিয়া-র লক্ষণগুলো কী কী?

মরশুম বদলের সময় আমাদের অনেকেরই গলা ব্যথার সমস্যা দেখা দেয়। প্রচণ্ড ব্যথায় খাবার থেকে জল, সবই যেন গলা দিয়ে নামানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। তবে যদি প্রতিনিয়ত খাবার গলাধঃকরণে সমস্যা হয় তবে কিন্তু আপনি রোগাক্রান্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে 'ডিসফ্যাগিয়া' বলে।

ডিসফ্যাগিয়া কী?
একজন মানুষ সারাদিনে গড়ে প্রায় ৬০০ বার ঢোক গিলে থাকেন। ডিসফ্যাগিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শক্ত খাবার, তরল খাদ্যবস্তু, এমনকী, নিজের মুখের লালাও গিলতে সমস্যা হয়। 'ডিস' কথাটির অর্থ কষ্টসাধ্য এবং 'ফ‍্যাগিয়া' কথাটির অর্থ খাদ্যগ্রহণ। অর্থাৎ, খাদ্যগ্রহণে কষ্ট। মূলত খাদ্যনালীর সমস্যার কারণেই খাবার গিলতে সমস্যা হয়। একাধিক কারণে এই রোগের শিকার হতে পারেন একজন ব্যক্তি। জেনে নেওয়া যাক, কী কী কারণে এই রোগ দেখা দেয়।

রোগের কারণ
১. গঠনগত অস্বাভাবিকতা: ঘাড় ও মাথায় অস্ত্রোপচার, টিউমারের উপস্থিতি বা জন্মগত ত্রুটির কারণে অনেকের মুখ, গলবিল, স্বরযন্ত্র বা খাদ্যনালীর গঠনগত অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়। ফলস্বরূপ খাবার গিলতে সমস্যা হয়।

আরও পড়ুন: উপসর্গ বদলাচ্ছে ডেঙ্গু! জমা জলেই কি তবে লুকিয়ে কলকাতার সর্বনাশ?

২. নার্ভের সমস্যা: আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ নিত্যনৈমিত্তিক একাধিক কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন হাঁটা, কথা বলা, খাবার গলাধঃকরণে সাহায্য করা। মস্তিষ্কের যে অংশ খাবার গিলতে সাহায্য করে, তার ক্ষতি হলে এই রোগ দেখা দেয়। বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগ খুবই সাধারণ। এছাড়াও শারীরিকভাবে অক্ষমদের মধ্যে এই রোগ দেখা যায়। স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া, পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বা ব্রেনে আঘাত লাগলে খাবার গিলতে সমস্যা হয়।

তবে এক্ষেত্রে প্রথমেই ডিসফ্যাগিয়ার সমস্যা দেখা দেয় না, অন্যান্য আরও লক্ষণ শরীরে উপস্থিত থাকে।

৩. বয়সজনিত সমস্যা: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের খাবার গলাধঃকরণ পদ্ধতি বদলে যেতে থাকে, ফলে বহু বৃদ্ধ মানুষের কাছে খাদ্যগ্রহণের অভিজ্ঞতাও পাল্টে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা একেবারে শেষ পর্যায়ে ডিসফ্যাগিয়া রোগে আক্রান্ত হন।

৪. সংক্রমণ বা ইনফেকশন: অল্প সময়ের জন্য গলায় ইনফেকশন হলেও আমাদের খাবার গিলতে অসুবিধা হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বহু মানুষ ইনফেকশনে ভোগেন। সংক্রমণের কারণে টনসিল ফুলে উঠলে বা লিম্ফ নোড ফুলে উঠলে খাবার গলা দিয়ে নামানো যায় না।

৫. টিউমারের উপস্থিতি: টিউমারের কারণে গলায় চাপ পড়লেও খাবার গিলতে অসুবিধা হয়। আবার মুখ ও গলার ক্যানসার, থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণও হতে পারে ডিসফ্যাগিয়া।

৬. অ্যাকালশিয়া: পেশি এবং স্নায়ু যা খাদ্যনালীর পেশিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও খাবার গিলতে সমস্যা হয়। এই অবস্থাকে অ্যাকালশিয়া বলে। সাধারণত ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সি ব্যক্তিদের এই সমস্যা দেখা যায় এবং এর সঠিক কারণ কী, তা চিকিৎসকরা আজও বুঝে উঠতে পারেননি।

৭. খাদ্যনালীর ওপর চাপ: খাদ্যনালীর বাইরের অংশ থেকে চাপের কারণে অনেকের খাবার গিলতে সমস্যা তৈরি হয়। এছাড়া খাদ্যনালীর পার্শ্ববর্তী কোনও অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে বা নষ্ট হয়ে গেলেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। যেমন থাইরয়েড গ্রন্থি, ফুসফুস বা পাকস্থলীর ক্যানসারে খাদ্যনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে খাবার গলাধঃকরণ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।

লক্ষণ
ডিসফ্যাগিয়া রোগের লক্ষণগুলি হলো:
১. প্রায়শই গলায় খাবার আটকে যায় এবং অতিরিক্ত করে তা গিলতে হয়।
২. অনেকের খাবার খাওয়ার সময় বা খাবার খেলেই কাশি শুরু হয়।
৩. অনেক সময় নাক-মুখ দিয়ে খাবার বেরিয়েও আসতে পারে।
৪. খাবার গলাধঃকরণের সময় গলায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হতে পারে।
৫. খাদ্যগ্রহণের সময় দম বন্ধ হয়ে আসছে বলে মনে হয়।
এই লক্ষণগুলি কোনও ব্যক্তির শরীরে উপস্থিত থাকলে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে ডিসফ্যাগিয়ার চিকিৎসা করা হলে সহজেই সারিয়ে তোলা সম্ভব এই রোগ। রোগীর দেহে উপস্থিত লক্ষণের ভিত্তিতে চিকিৎসকরা নানান রকমের পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন। যে যে পরীক্ষার মাধ্যমে ডিসফ্যাগিয়া নির্ণয় করা যায়,

১. এন্ডোস্কোপি: এক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল নালীর মধ্য দিয়ে সূক্ষ্ম একটি টেলিস্কোপ প্রবেশ করানো হয়।এই টেলিস্কোপের মুখে একটি ক্যামেরা লাগানো থাকে। মুখের ভেতর দিয়ে খাদ্যনালী হয়ে পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্র পর্যন্ত এই ক্যামেরার মাধ্যমে সম্পূর্ণ অঙ্গগুলির অবস্থা দেখা হয় এন্ডোস্কোপি করে। প্রয়োজন অনুভব করলে চিকিৎসকেরা একই সঙ্গে বায়োপসি করানোর নির্দেশও ডেন।

২. বেরিয়াম তরল গলাধঃকরণ: এক্স রে করার সময় খাদ্যনালী এবং এর পার্শ্ববর্তী অঙ্গগুলি খুব ভালো বোঝা যায় না। কিন্তু রোগীর লক্ষণের ভিত্তিতে তাঁকে বেরিয়াম সালফেটের তরল খাওয়ানো হয় যার ফলে এক্স রে-তে স্পষ্ট বোঝা যায় খাদ্যনালী।

এছাড়াও পিএইচ টেস্ট, নিয়মিত কিছু রক্ত পরীক্ষা, এমআরআই স্ক্যান, ভিডিও ফ্লুওরসস্কপির মতো পরীক্ষাও করানোর নির্দেশ দেন চিকিৎসকেরা।

পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে যে কারণে জন্য খাবার গিলতে অসুবিধা হচ্ছে তার চিকিৎসা করা হয়। আবার অনেক সময় একাধিক থেরাপির মাধ্যমে ডিসফ্যাগিয়া সারিয়ে তোলা হয়। তবে খাদ্যনালী বা খাদ্যগ্রহণের সঙ্গে যুক্ত অঙ্গের কোনও সমস্যা থাকলে সার্জারি করাতে হতে পারে। এসময় চিকিৎসকেরা গলা বা তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। তাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে চিকিৎসকদের পরামর্শ অবশ্যই জরুরি।

More Articles