ভোটে হেরেও ছিলেন মমতার বিশ্বস্ত! অভিনয় থেকে দুর্নীতিতে যেভাবে নাম জড়াল সায়নী ঘোষের
Saayoni Ghosh ED: ভোটে হেরে পদোন্নতি হয়েছিল সায়নীর। সেই বছর জুন মাসেই সায়নী ঘোষকে তৃণমূল যুব সভানেত্রী ঘোষণা করেন মমতা।
যখন নিজের পেশায় পড়ন্ত বেলা, অনেকেই 'সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট' থিওরিতে টিকে রইতে পেশা বদলে নেন। বিশেষ করে যারা চিরকালই জনগণের কাছে 'স্টার' হয়ে থেকেছেন, তারা। এককালে অভিনয়ে বাজার মন্দ গেলেই দলে দলে রাজনীতিতে যোগ দিতেন সিনেমার তারকারা। এখনও দেন, তবে আর বয়স হওয়ার অপেক্ষা করেন না। এক খ্যাতির মধ্যে থাকতে থাকতেই অন্যত্র খাতা খুলে রাখেন। বলা যায় না, দিনকাল ভালো না। কার মাথার উপর থেকে কখন ছাতা সরে যায়, কার পায়ের তলা থেকে কখন কার্পেট সরে যায়। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস দলে যোগ দেওয়া এখন খুব সাধারণ পেশা নির্বাচনের মতোই। বাংলায় বাজার ভালো থাকতে থাকতেই সিনেমা তারকারা রাজনীতিতে যোগ দেন। নেতানেত্রীদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করেন, হাত নাড়েন, মালা পরেন, ভোট চান, সংসদে যান না এবং ক্ষমতার নানা পদে সহজেই আসীন হয়ে যান। দলে দলে যোগ দেওয়া তারকা, সিনেমাস্টার, সিরিয়ালস্টারদের মধ্যেই ছিলেন সায়নী ঘোষ। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়া যদি পেশা হয়, পেশার নিজস্ব ঝুঁকিও রয়েছে। এমনই ঝুঁকির মুখে পড়েছেন সায়নী ঘোষ। তৃণমূল কংগ্রেস যুব শাখার সভাপতি সায়নী ঘোষকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে জেরা করছে ইডি। বিতর্ক তো এই প্রথম নয়। এর আগেও নানাভাবে চর্চায় থেকেছেন সায়নী। তবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ এই প্রথম। কিন্তু মোদ্দা কথাটি হচ্ছে, সায়নী রাজনীতিতে এলেনই বা কেন, এসে এমন ভোটে দাঁড়ানো, একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার মন্ত্রই বা তিনি শিখলেন কীভাবে?
সায়নী ঘোষ যে আসলে কার দলে তা ভালো করে বুঝতেই পারেননি রাজ্যের তাবড় নেতারাও। বেশ কিছু বছর আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বিজেপির বিরুদ্ধে সরাসরি মুখ খুলেছিলেন অভিনেত্রী। প্রত্যক্ষ রাজনীতির থেকে তখন যোজন দূরে তিনি। জয় শ্রী রাম ধ্বনি কীভাবে 'ওয়ার ক্রাই' হয়ে উঠেছে প্রশ্ন তুলে তিনি বুঝিয়ে দেন আর যাই হোক, গেরুয়া শিবিরের লোক তিনি নন। তৃণমূল ও সিপিএম দুই-ই খুশি। সিপিএম ঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক অনীক দওর সিনেমা 'ভবিষ্যতের ভূত' তখন তৃণমূলের বিষ নজরে। রাজ্যের বিভিন্ন হল থেকে তখন সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে পলিটিক্যাল স্যাটায়ারটি। অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মাবত-এর হামলার বিরোধিতা করেছিলেন এবং বাংলায় সিনেমাটি প্রদর্শনের জন্য প্রযোজকদের সমস্ত নিরাপত্তার আশ্বাসও দিয়েছিলেন মমতা। তাহলে কেন তাঁর বাংলাতে বাংলা সিনেমার প্রতি এমন আচরণ?” তৃণমূল ধন্দে, সিপিএম নেতারা ভাবলেন দলে নতুন সম্ভাবনাময় মুখ দেখা দিচ্ছে! তারপর কোথা থেকে কী হইয়া গেল, সায়নী 'নো ভোট টু বিজেপি' ধ্বনি তুলে তৃণমূলের টিকিটে ভোটে লড়ে ফেললেন।
আরও পড়ুন- আদালতের রায়ে নাজেহাল যুবরাজ! কেন ফের সিবিআইয়ের তলব অভিষেককে?
বছর ৩০ বয়স। সিনেমা সিরিজের বেশ পরিচিত মুখ ছিলেন। এখনও আছেনই বলা যায়। সায়নীর 'স্ক্রিন অ্যাপিয়ারেন্স' তথাকথিত বাংলা নারী চরিত্রের থেকে বেশ পৃথক। রাজনীতিতে আসার পর যতই নিজের বাহ্যিক 'ইমেজে' সনাতনী নেত্রীর ছাপ আনার চেষ্টা করুন না কেন, সকলেই জানেন সায়নী ঘোষ বেশ জনপ্রিয় বাংলার যুব সমাজের কাছে এবং তা তাঁর বাহ্যিক বেশভূষার কারণেই। সায়নী ঘোষের উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা দলের আশা প্রত্যাশা শুরু থেকেই গভীর। নাহলে, আসানসোল দক্ষিণের মতো গুরুত্বপূর্ণ আসনে একদম নতুন মুখকে দাঁড় করানো রাজনৈতিকভাবে বেশ জটিল চাল ছিল তৃণমূলের। সায়নী অগ্নিমিত্রার কাছে হেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ব্যবধান ছিল অত্যন্ত কম। তবে সায়নী ঘোষ রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত হন প্রথম শিবলিঙ্গকে ঘিরে। একটি মিম শেয়ারের ঘটনাকে নিয়ে। মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় সায়নীর সোশ্যাল মিডিয়া পেজ থেকে ২০১৫ সালের শিবলিঙ্গ বিষয়ক টুইট ঘিরে 'হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত করার' জন্য তাঁর বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করেছিলেন। এই বিতর্ক ঘিরে সায়নীও ব্যাপকভাবে অনলাইনে মৃত্যু ও ধর্ষণের হুমকি পেতে থাকেন। পরে জানিয়েছিলেন, এসব মিম নাকি শেয়ার করা হয়েছিল তাঁর অ্যাকাউন্টটি হ্যাক করে।
পরে আগরতলায় ত্রিপুরা পুলিশ 'খুনের চেষ্টা' এবং অন্যান্য অভিযোগে গ্রেপ্তার করে সায়নীকে৷ সেবার দলের সম্পূর্ণ সমর্থন পান সায়নী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন সায়নীর গ্রেপ্তারির বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে উত্থাপন করবেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তড়িঘড়ি আগরতলায় উড়ে যান সায়নীর পাশে দাঁড়াতে। সায়নীর জন্য এই তড়িঘড়ি প্রতিবাদ ও পাশে দাঁড়ানোর হিড়িকই প্রমাণ করে দলে তাঁর অবস্থান কেমন। নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী দ্বাদশ শ্রেণির পর আর পড়াশোনার দিকে এগোননি। বাংলা সিরিয়াল এবং টেলিফিল্মে কাজ দিয়েই অভিনয় জীবন শুরু। পরে বাংলা চলচ্চিত্রেরও মুখ হয়ে উঠলেন সায়নী। সিনেমায় খ্যাতি বাড়তে না বাড়তেই দেখা গেল তৃণমূলের টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাও যে সে ভোট নয়। সকলেই জানেন, ২০২১ সালে বাংলায় বিধানসভা ভোটটি ছিল তৃণমূলের মরণ বাঁচন লড়াই! ২০২১ সালে ভোটের ঠিক আগে আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন সায়নী। সমস্ত ধরনের দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দলও তাঁকে আসানসোল দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করে দেয়।
আরও পড়ুন- মমতা-বর্জিত একনায়কতন্ত্রের চেষ্টা আদৌ সফল হবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের?
মনোনীত হওয়ার পরেই সায়নী ঘোষ আসানসোলে ঘাঁটি গাড়েন। বাড়ি ভাড়া নেন। আসানসোলের ভোটারদের সঙ্গে, বিশেষ করে মহিলা ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তাকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে শুরু করেন। 'আমি তোমাদেরই লোক' বোঝাতে ভোটারদের বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ মহিলাদের থেকে চাটনির রেসিপি নেওয়া বা ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের কয়লা খনিতে নেমে স্থানীয় গ্রাম থেকে আসা খনি শ্রমিকদের কাছ থেকে ভোট চাওয়া- কী করেননি তিনি! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেই ফেলেন সায়নী ঘোষ 'স্ট্রিট ফাইটার'। এককালে এই নামেই ডাকা হতো খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও! যদিও সায়নী ঘোষ বিজেপির অগ্নিমিত্রা পালের কাছে হেরেই যান, তবে মাত্র ৫,০০০-এরও কম ভোটে। সায়নী ঘোষ পেয়েছিলেন ৮৩,৩৯৪ টি ভোট। আর অগ্নিমিত্রা পান ৮৭,৮৮১ টি ভোট।
ভোটে জেতার পুরস্কার সকলেই পান। ভোটে হেরে পদোন্নতি হয়েছিল সায়নীর। জুন মাসেই সায়নী ঘোষকে তৃণমূল যুব সভানেত্রী ঘোষণা করেন মমতা। এই পদের দায়িত্বভার সামলাতেন খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়! তারপর কাট টু ২০২৩, ৩০ জুন। ১১ ঘণ্টা ইডির জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সায়নী ঘোষ। এমন মামলায় নাম জড়িয়েছেন তিনি যা এই রাজ্যের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দুর্নীতি। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের একাধিক নেতা, পদাধিকারী, আধিকারিক জেলে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে উঠে এসেছিল বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের নাম। তাঁর সঙ্গে বিপুল টাকাপয়সা লেনদেনের অভিযোগ ওঠে আরেক অভিনেতা বনি সেনগুপ্তর বিরুদ্ধেও। কুন্তল ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ আর সায়নী ঘোষের প্রতিপত্তি বাড়ার বিষয়টি তাই ইডির নজরে। ইডি ফের ডাকতে চলেছে সায়নীকে। ২০২৪ সালের লোকসভার আগে একের পর এক তৃণমূল নেতানেত্রীরা যেভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির আতশকাচের তলে আসছেন, দল সঙ্কটে একথা বলাও যায়, আবার নাও বলা যায়। বাংলায় রাজনীতি করবেন আর দুর্নীতিতে জড়াবেন না এমন প্রত্যাশা মানুষ শেষ কবে করেছেন জানা নেই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে কি সায়নী ঘোষ গ্রেপ্তার হবেন? তাতে কি ভোটে খুব প্রভাব পড়বে? গ্রাম বাংলায় অন্য মন্ত্র, অন্য ভয়- সেখানে কলকাতা কেন্দ্রিক পালিশ করা রাজনীতির সম্ভবত ঠাঁই নেই।