খাপছাড়া শৈশব থেকে প্রশাসনিক ভুল! ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি উজেইরকে ভূস্বর্গের জঙ্গি বানাল যারা...
Uzair Bashir Khan, Kashmiri Militant Behind Kokernag Attack: কোন ঘটনা উজেইরকে টেনে নিয়ে গেল এই পথে, ভাবাচ্ছে অভিজ্ঞদের। শুধুই কি বিঘ্নিত শৈশব, নাকি এর শিকড় প্রোথিত আরও ভিতরে।
বছর আঠাশের আশপাশে। কাজের খোঁজে ঘর ছেড়েছিল ছেলেটা। যাওয়ার সময় ঠাকুমা ও কাকাকে বলে গিয়েছিল, আজ একটা কাজ জোগাড় করেঅ বাড়ি ফিরবেন। সোনমার্গের কাছে নাকি একটি বহুতল তৈরি হচ্ছে। সেখানেই ইলেকট্রিকের কাজ। পেয়ে যাবেই। আত্মবিশ্বাস ঝলকে উঠেছিল তাঁর কথায়। যে কোনও ভাবে তাঁর অফারে আজ রাজি হতেই হবে ঠিকাদারকে। ওই রাতটা হয়তো কাজের জায়গাতেই থাকতে হতে পারে। বলে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা।
সেই শেষবার ছেলেটাকে দেখেছিল বাড়ির লোকেরা। শেষ কথা ওটুকুই। পরের দিন ফোনে পাওয়া যায়নি। তার পরের দিনও ঘরে ফিরল না ছেলেটা। বাড়ির লোক পড়ি কি মরি করে ছুটেছিলেন থানায়। দক্ষিণ কাশ্মীরের একটি থানায় লেখা হয়েছিল মিসিং রিপোর্ট। সেটা গত ২৬ জুলাই, ২০২২ সালের ঘটনা।
উজেইর বসির খান। বারো ক্লাস ঠিকমতো পাশ করতে না পারা ছেলেটাকে কাজ খুঁজতে দেখেছেন পরিবারের লোকেরা। স্থানীয় একটি পলিটেকনিক কলেজ থেকে ইলেক্ট্রিকের কাজে ডিপ্লোমাও করেছিল উজেইর। কিন্তু কখনও হিংসার পক্ষে হাঁটতে দেখেননি একচুলও। এতদিন পরে এসে তাঁরা জানতে পারলেন, সেই উজেইর বসির খান নাকি জঙ্গি, লস্কর-ই-তইবার সদস্য। গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে অনন্তনাগের কোকেরনাগে যে ভয়াবহ জঙ্গি-সেনাবাহিনী গুলিযুদ্ধ চলেছে, সেই অপারেশনে জঙ্গিদের তরফে নেতৃত্ব দিয়েছেন উজেইরই। পুলিশের উপর হামলা চালোনোর মাস্টারমাইন্ড ছিল সে-ই। শেষপর্যন্ত সেই গুলির লড়াইয়ে সেনার হাতে মারা গিয়েছে উজেইর।
আরও পড়ুন: কলের মিস্ত্রির মুখোশে খলিস্তানি জঙ্গি! ভারত-কানাডা সম্পর্কের কাঁটা হরদীপ আসলে কে?
বন্ধুবান্ধবের গায়ে হাত তোলার পথটুকু মাড়ায়নি যে কোনওদিন, সে সোজা নাম লেখালো জঙ্গিদলে! তা-ও আবার পুলিশের উপর হামলার পরিকল্পনা। হজম করতে পারছেন না পরিবারের লোকেরা। সহিংসতার কোনও লক্ষণমাত্র ছিল না তাঁর মধ্যে। বুরহান ওয়ানির মতো আধুনিক জঙ্গিদের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব ছিল না উজেইর। বরং কাকে কোকিলে জানতেও পারেনি, তলে তলে লস্করের মতো জঙ্গি-দলে গিয়ে নাম লিখিয়েছে যে সে।
নাগাম গ্রামে ছোট্ট দোতলা বাড়ে উজেইরদের। সেই বাড়ির দোতলায় উজেইরের ঠাকুমা থাকতেন তাঁর চার ছেলে ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে। উজেইরের বাবা থাকতেন আলাদা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ওই গ্রামেরই অন্য একটি প্রান্তে। ডিপ্লোমা পাশ করার পর কাজে লেগে পড়ে উজেইর। কোনও না কোনও কাজ পেয়েও যেত। নাগাম গ্রামের জনপ্রিয় ইলেকট্রিশিয়ানদের অন্যতম ছিল উজেইর। শুধু নাগামেই নয়, কোকেরনাগের অন্যান্য গ্রামেও ডাক পড়ত তাক ঘনঘন। উজেইরের ছোট মাসি সায়রা জানান, বাড়ির একেবারে নিচের তলায় উজেইরের একটি ঘর ছিল। সেখানেই বসে নিজের যাবতীয় কাজ সারত সে। সায়রা ওই ঘর থেকে দুটি ছেঁড়াফাটা ব্যাকপ্যাক খুঁজে পান। তাতে অবশ্য রহস্যজনক কিছু মেলেনি। সাধারণ ইলেকট্রিশিয়ানদের ব্যাগে যা পাওয়া যায় আর কী! স্ক্রুডাইভার, পিলার, হাতুড়ি, ড্রিলযন্ত্র এসব টুকিটাকি। যেসব গত এক বছর ধরে অব্যবহৃহ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে উজেইর ভালোই রোজগার করছিলেন। পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, কোকেনাগারে পাশে ভেসু গ্রামে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য একটি টাউনশিপ তৈরি হচ্ছে। সেখানেই কাজ পেয়েছিলেন উজেইর। অন্তত পরিবারকে তেমনটাই জানিয়েছিলেন।
পরিশ্রমী উজেইরের টাকা উপার্জনের নেশা ছিল। তার জন্য প্রায়শই ওভারটাইম করত সে। অন্তর্মুখী উজেইর যে বাস্তবে জঙ্গি, তা মানতে কষ্ট হচ্ছে নাগাম গ্রামের অনেকেরই। কোকারনাগ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার গেলে ছোট্ট গ্রাম নাগাম। কাশ্মীরের অন্যান্য জায়গার তুলনায় শিক্ষার হার বেশ কম এখানে। ২০১১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী, মাত্র হাজার তিনেক মানুষের বাস এ গ্রামে। পুরনো ভাঙাচোরা ঘর আর চাষের ভরসাতেই কোনও ক্রমে দিন কাটে। ছোট্ট গ্রাম, সকলেই প্রায় একে অপরকে চেনেন। উজেইরের বাড়ির পথও সকলেরই কমবেশি চেনা। গোটা গ্রামের তুলনায় উজেইরদের আর্থিক অবস্থাও মোটামুটি চলনসই ছিল। ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে উজেইর এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে মাঝেমধ্যে কাজের চাপ সামলাতে ভাইকে কাজে ধরে নিয়ে যেত সে। তবে পারিবারিক ভাবে ছোট থেকেই ভালো ছিল না উজেইর। ছোট থেকেই নানাবিধ কারণে তার শৈশব বিঘ্নিত হয়েছে।
উজেইরের মাকে তালাক দিয়ে বাবা বসির আহমেদ দ্বিতীয় নিকাহ সারলেন। তখন উজেইরের বয়স বড়জোর কয়েক মাস। জম্মু-কাশ্মীরের জল শক্তি বিভাগে কাজ করতেন বাবা। দ্বিতীয় সংসারে দুটি সন্তান হয় বসিরের। তাদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় অশান্তি। বসিরের কানে উজেইরের বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে শুরু করলেন মা ফরিদা। উজেইর মাদকাসক্ত, এমনই মিথ্যা অপবাদ এনে বাবাকে উজেইরের বিরুদ্ধে উস্কাতে শুরু করলেন। একটা সময় তিতিবিরক্ত হয়ে উজেইরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন বসির। আত্মীয়দের বাড়ি ঘুরে ঘুরে বড় হতে লাগল ছোট্ট উজেইর।
উজেইরের বধির ঠাকুমা পড়শিদের মুখ থেকে জানতে পেরেছিলেন নাতির পরিণতির কথা। সেটা একটা ইদের দিন। বেশ কয়েকদিন ধরে উজেইরের পেটে একটা দানাও পড়েনি। সেই দিন উজেইরকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন ঠাকুমা। সেই থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ঠাকুমার ছায়ায় থেকেছে উজেইর। তবে একেবারে শৈশবের সেই কয়েকটা তালগোল পাকানো স্মৃতি কি আজীবন বয়ে বেরিয়েছে উজেইর। যা হয়তো তার ভিতরে জন্ম দিয়েছিল এক সন্ত্রাসের বিষপোকার। হয়তো বাবার দৃষ্টির মধ্যে থাকলে এমনটা হত না উজেইরের সঙ্গে।
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে, গত ১৯ সেপ্টেম্বর অনন্তনাগের কাছে কোকেরনাগের জঙ্গলে যৌথ অভিযান চানায় নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ। পাল্টা সেনার উপর হামলা চালায় জঙ্গিরা, এবং তারপরে জঙ্গলের গভীরে আশ্রয় নেয়। জঙ্গিদের গুলিতে সেনার এক কর্নেল, মেজর এবং জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের এক ডিএসপি নিহত হয়েছেন। এরপর জঙ্গিদের ধরতে তল্লাশি অভিযান শুরু করে পুলিষ। নামে প্যারা কম্যান্ডো। প্রায় ১৫০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে জঙ্গি-পুলিশ গুলিযুদ্ধ। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, শেষপর্যন্ত সেনা-অভিযানে নিকেশ হয়েছে সমস্ত জঙ্গিই। নিশ্চিত হতে ড্রোন ও হেলিকপ্টারের সাহায্যেও চলে তল্লাশি। উদ্ধার হয় এক জঙ্গির ঝলসানো দেহ। নিহত জঙ্গিদের মধ্যে ছিল উজেইরও। অনন্তনাগে এই জঙ্গি-সেনা সংঘর্ষে ৪ সেনারও মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন: “বিশ্বাস করুন, আমি জিহাদি নই!” হিজাব ছুঁড়ে এখন বাঁচার রাস্তা খুঁজছেন আইসিস জঙ্গির বউ শামিমা
তবে কোন ঘটনা উজেইরকে টেনে নিয়ে গেল এই পথে, ভাবাচ্ছে অভিজ্ঞদের। শুধুই কি বিঘ্নিত শৈশব, নাকি এর শিকড় প্রোথিত আরও ভিতরে। কিছুদিন আগেই কাশ্মীরের একটি স্থানীয় বাড়িতে আটকা পড়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা। কোনওরকম আলোচনার চেষ্টা না করেই গোটা বাড়িটিকেই আইইডি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় নিরাপত্তা বাহিনী। এই ঘটনা কার্যত জঙ্গিদের ভিতরের নৃশসংতাকে জাগিয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। কথাবার্তা বা আলাপআলোচনার বদলে যে কোনও রকম চরম পদক্ষেপের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে তারা। সেই ঘটনাই কি অন্যান্য জঙ্গিদের মতোই উজেইরকেও ঠেলে দিল হিংস্র আক্রমণের দিকে। যা ডেকে আনল শেষপর্যন্ত মৃত্য়ু। সেনাবাহিনীর উপর বদলা নেওয়াই কি আসল উদ্দেশ্য ছিল তার।
এমন সব হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে উজেইর নামে বছর আঠাশের কাশ্মীরি যুবকের মৃত্যু ঘিরে। বুরহান ওয়ানি থেকে উজেইর বসির খান, আরও কত তাজা প্রাণ ঝরবে এই সন্ত্রাসের ফাঁদে! এই প্রশ্নটার জবাব নেই। অন্তত কাশ্নীরে তো বটেই।