চক্রব্যূহে একা কিশোর, কর্ণ নন, কেন মহাভারতের আসল ট্র্যাজিক হিরো অভিমন্যু!
Abhimanyu Mahabharat: চক্রব্যূহ বা পদ্মব্যূহ হল বহু-স্তরযুক্ত প্রতিরক্ষামূলক গঠন যা উপরে থেকে দেখলে প্রস্ফুটিত পদ্ম বা চাকতির (চক্র) মতো দেখায়।
দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা- এই ছয়জন প্রথমে অভিমন্যুকে বেষ্টন করেন। একে একে অভিমন্যুর সকল অস্ত্র ও রথ ধ্বংস হলে দুঃশাসনের পুত্র তাঁর মস্তকে গদাঘাত করেন এবং শেষ পর্যন্ত দুঃশাসনের হাতে তিনি নিহত হন। তৎকালীন রীতি অনুসারে অভিমন্যু-হত্যার এই প্রক্রিয়াটি অন্যায় ছিল। সমকালের আলোকেও তা ন্যায় বিচারের দাবি রাখে না। অবশ্য পরে এই অন্যায় যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন অভিমন্যুর পিতা অর্জুন।
“মহাভারতের বর্ণিত ইতিহাস মানবসমাজের বিপ্লবের ইতিহাস। ... হয়তো কোনও ক্ষুদ্র প্রাদেশিক ঘটনার স্মৃতিমাত্র অবলম্বন করিয়া মহাকবি আপনার চিত্তবৃত্তির সমাধিকালে মানবসমাজের মহাবিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন; এবং সেই স্বপ্নদৃষ্ট ধ্যানলব্ধ মহাবিপ্লবের, ধর্মের সহিত অধর্মের মহাসমরের চিত্র ভবিষ্যৎ যুগের লোকশিক্ষার জন্য অঙ্কিত করিয়া গিয়াছেন।”
রাজশেখর বসু তাঁর মহাভারতের সারানুবাদে এভাবেই ‘মহাকাব্যের লক্ষণ’ থেকে রামেন্দ্রসুন্দরের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এটা কোনও ব্যক্তিবিশেষের ইতিহাস নয়, এটা একটা জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস। তাই ন্যায়, অন্যায়, যুদ্ধ বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব এবং অসংখ্য কল্পকাহিনির মিশেলে একটি জাতির সমগ্রতার বিশাল মূর্তি। তাই আজও ষড়যন্ত্রের আবর্তে অভিমন্যুর মতো বীরের মৃত্যুর ন্যায় অন্যায় আলোচনা সমকালীন এবং প্রাসঙ্গিক।
আরও পড়ুন- ভাইদের ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে! ধৃতরাষ্ট্র-পুত্র হয়েও কেন এত অবহেলিত যুযুৎসু
কে অভিমন্যু?
অভিমন্যু মহাভারত মহাকাব্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র ও অর্জুন-সুভদ্রার পুত্র, শ্রীকৃষ্ণের ভাগিনেয় এবং মৎস্য রাজকন্যা উত্তরার স্বামী। শৌর্যে বীর্যে তিনি তাঁর পিতা অর্জুন ও পিতামহ ইন্দ্রের সমতুল্য। অভিমুন্য নামের অভি অর্থ অত্যধিক; আর মুন্য অর্থ ক্রোধ। তাই অভিমন্যু নামের অর্থ দাঁড়ায় ক্রোধিত পুরুষ। যুদ্ধ ক্ষেত্রে অভিমন্যু তাঁর পিতা অর্জুন ও মাতুল শ্রীকৃষ্ণের সমান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর একমাত্র সন্তান পরীক্ষিৎ তাঁর মৃত্যুর পর জন্মগ্রহণ করেন। অর্জুনের বারো বছরের ব্রহ্মচর্য ও বনবাস সম্পূর্ণ হওয়ার পর অভিমন্যুর জন্ম হয়। মায়ের গর্ভে থাকতেই তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল। গর্ভাবস্থায় সুভদ্রা অর্জুনের নিকট চক্রব্যূহে প্রবেশের প্রণালী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ায় অভিমন্যু কেবল চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে জানতেন, বেরোতে জানতেন না।
পাণ্ডবগণের বনবাস ও অজ্ঞাতবাসের কারণে অভিমন্যু তাঁর বাল্যকাল দ্বারকায় মাতুলালয়েই অতিবাহিত করেন। সেখানে কৃষ্ণ ও বলরামের অভিভাবকত্বে তিনি কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন এবং যাদববীর কৃতবর্মা ও সাত্যকীর নিকট অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেন।
অজ্ঞাতবাসকালে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী মৎস্যরাজ বিরাটের কাছে ছদ্মবেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তেরো বৎসর সম্পূর্ণ হওয়ার পর তাঁরা আত্মপ্রকাশ করলে বিরাট স্বীয় কন্যা উত্তরার সঙ্গে অর্জুনের বিবাহের প্রস্তাব দেয়। তখন অর্জুন জানান উত্তরা তাঁকে আচার্যের ন্যায় শ্রদ্ধা করেন। তাই তিনি উত্তরাকে পুত্রবধূ রূপে গ্রহণ করবেন। তাঁর পুত্র অভিমন্যুই মৎস্যরাজের জামাতা হওয়ার উপযুক্ত। এরপর উপপ্লব্য নগরীতে অভিমন্যু ও উত্তরার বিবাহ সম্পন্ন হয়। এঁদের পুত্র পরীক্ষিৎ।
চক্রব্যূহ কী?
চক্রব্যূহ আসলে একটি হিন্দু পৌরাণিক সেনা-সমাবেশ বিশেষ। চক্রাকারে দুর্ভেদ্য সেনা সমাবেশের কারণে এর নাম চক্রব্যূহ। দ্রোণাচার্য এই ব্যূহ রচনায় পারদর্শী ছিলেন। এইরূপ সেনা-সমাবেশ ভেদ করতে একমাত্র অর্জুন সক্ষম ছিলেন। অর্জুন পুত্র অভিমন্যু এই সেনা-সমাবেশে প্রবেশ করে ধ্বংস করার বিদ্যা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু বেরিয়ে আসার বিদ্যা জানতেন না।
চক্রব্যূহ বা পদ্মব্যূহ হল বহু-স্তরযুক্ত প্রতিরক্ষামূলক গঠন যা উপরে থেকে দেখলে প্রস্ফুটিত পদ্ম বা চাকতির (চক্র) মতো দেখায়। এই গঠনটি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রোণাচার্য দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিল, যিনি ভীষ্ম পিতামহের পতনের পর কৌরব সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়েছিলেন। কৌরব ও পাণ্ডবরা একইভাবে বিভিন্ন ব্যূহ (সামরিক গঠন) অধ্যয়ন করেছিলেন।
মহাভারতে বর্ণিত এই ব্যূহ হল- শক্তিশালী যোদ্ধাদের এমন অবস্থানে স্থাপন করা, যেখানে তাঁরা বিরোধী শক্তিকে সর্বাধিক ক্ষতি করতে পারেন বা তাঁদের নিজেদের পক্ষকে রক্ষা করতে পারেন। এই সামরিক কৌশল অনুসারে, যুদ্ধের সময় নির্দিষ্ট স্থির বস্তু বা চলমান বস্তু বা ব্যক্তিকে বন্দি, বেষ্টিত এবং সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন- দুর্যোধনের ভাই হয়েও দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় প্রতিবাদ! ব্যাতিক্রমী বিকর্ণ রয়ে গেলেন নিভৃতেই
অভিমন্যুর বধ
মহাভারতের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে কৌরব সেনাপতি দ্রোণাচার্য একটি চক্রব্যূহ রচনা করেন। এই ব্যূহ ভেদের কৌশল মাত্র চার জনের জানা ছিল, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, অর্জুন আর অভিমুন্য। এই সময়ে চক্রব্যূহ ভেদ করার জন্য পাণ্ডব শিবিরে অভিমন্যু ব্যতীত আর কেউ উপস্থিত না থাকায় যুধিষ্ঠির তাঁর উপর এই গুরুভার অর্পণ করেন। এরপর অভিমন্যু যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং চক্রব্যূহ ভেদ করে কৌরব সেনা মধ্যে উপস্থিত হন। তাঁর শরবর্ষণে মদ্ররাজ শল্য ও দুঃশাসন মূর্ছিত হন। শল্যের ভ্রাতা নিহত হন এবং শল্য রণভূমি থেকে পলায়ণ করেন। এই সময় যুধিষ্ঠির, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডি, সাত্যকী, বিরাট ও দ্রুপদ ব্যূহে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ শিবের বরে তাঁদের পরাস্ত করেন ও ব্যূহের প্রবেশ পথ রুদ্ধ করেন। কুরুসৈন্য বেষ্টিত অভিমন্যু একাকী যুদ্ধ করতে থাকেন। কৌরব সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয় এবং যোদ্ধারা পালাতে থাকেন। শল্যপুত্র রুক্মরথ, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষণ ও কোশলরাজ বৃহদবল তাঁর বাণে হত হন।
অভিমন্যুকে অপ্রতিরোধ্য দেখে কর্ণ দ্রোণের উপদেশে তাঁকে পিছন থেকে আক্রমণ করে রথচ্যূত ও ধনুর্হীন করেন এবং দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও শকুনি নিষ্করুণ ভাবে তাঁর ওপর শরাঘাত করতে থাকেন। অভিমন্যু খড়গ, চক্র, গদা এমনকী রথের চাকা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এইসময় দুঃশাসনের পুত্র তাঁর মাথায় গদাঘাত করেন। তখন নিপীড়িত বালক অভিমন্যুর প্রাণশূন্য দেহ ভূপাতিত হয়। অভিমুন্যের বধের জন্য দ্রোণ, দ্রৌণি, কৃপ, কর্ণ, শল্য, কৃতবর্মা, শকুনি, বৃহদ্বল, ভূরি, ভুরিশ্রবা, শল, পৌরব আর বৃষসেনকে দায়ি করা হয়। মহাভারতের কথা অমৃতসমান তো বটেই, পৌরাণিক সময়কে ধারণ করে রাখলেও এই মহাকাব্যকে আজও মনে হয় আধুনিক। তাই সমকালের আলোয় এখনও অভিমন্যুর হত্যা বিশেষ তর্কের দাবি রাখেই।