অস্ত্র সেই সিএএ, মমতার নাম করে কেন আক্রমণ করছেন অমিত শাহ?
গোটা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি৷ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি'র দ্বিতীয় শীর্ষনেতা তিনি৷ তাঁর মুখে এমন ভাষা!
সাধারণত পাড়ার তথাকথিত দাদা'রা চায়ের দোকানে বসে যে ভাষায় কথা বলে, যেভাবে 'দেখে নেওয়ার' ইঙ্গিত দেয়, ঠিক যেন সেই ভাষাই উঠে এসেছে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে৷ সবসময়ই তা দুর্ভাগ্যজনক৷ আর এই আচরণ তিনি যদি একজন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি করেন, তাহলে তো তা অমার্জনীয় অপরাধ৷
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ চালু করতেই পারে৷ সংসদের উভয়কক্ষে সংখ্যাধিক্যের জোরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাষ্ট্রপতি সই করার পর সেই বিল আইনেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর মাঝে বছর আড়াই কাটলেও সিএএ আইনের নীতি এখনও সম্পূর্ণভাবে প্রণয়ন হয়নি। সংসদ ইতিমধ্যে একাধিকবার সিএএ আইনের নীতি প্রণয়নের সময়সীমা বাড়িয়েছে। কেন্দ্রের তরফে আদালতে এজন্য করোনা অতিমারিকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে৷ এই আইন নিয়ে গোটা দেশে আন্দোলনের ঝড়ও ওঠে। সে সময় এসব তোয়াক্কা না করেই আইন পাশ করিয়ে নেন মোদি- শাহ৷ যে কোনও কারণেই হোক, এই আইন এখনও লাগু হয়নি দেশে৷ হয়তো এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বহর দেখে সাময়িকভাবে হলেও পিছু হটেছে মোদি সরকার৷ তবে রাজ্য সফরে এসে অমিত শাহ 'ভাঙবে তবু মচকাবেনা' নীতি অনুসারে সাফাই দিয়েছেন অন্য ভাবে৷ বলেছেন, "দেশ করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই এই আইন বলবৎ করতে উদ্যোগ নেবে কেন্দ্র।” আর এর পরেই আপত্তিকর শাহি-হুমকি, "করোনার দাপট কমলেই এই আইন লাগু হবে৷ মমতাদিদি, আপনি কিছুই করতে পারবেন না। কান খুলে শুনে রাখুন, সিএএ লাগু হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।"
এ কেমন ভাষা ? দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন মুখ্যমন্ত্রীকে এমন হুমকি, হুঁশিয়ারি দিতে পারেন ? সৌজন্য বলে কোনো শব্দ কি অভিধানে নেই! একজন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রকাশ্য আচরণ কি এমন ধমকচমকের হতে পারে!
আরও পড়ুন-নাইটক্লাবে রাহুলের ছবিকে হাতিয়ার করে কী আড়াল করছে বিজেপি?
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে গত দু-তিন বছর ধরে সমানে রাজনীতি করে চলেছে বিজেপি তথা কেন্দ্র৷ বিজেপি'র অভ্যন্তরেও কিন্তু এই আইন নিয়ে আপত্তি রয়েছে৷ সিএএ নিয়ে কেন্দ্রের অহেতুক জেদ ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে বিজেপির দিকেই৷ বোঝাই যাচ্ছে,সে সব সামাল দিতেই বাংলায় এসে ফের সিএএ প্রসঙ্গ তুলেছেন শাহ। সিএএ কার্যকর হবেই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন৷
শাহি-বচনে এটাও ধরা পড়েছে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনেও এই আইনকেই হাতিয়ার করে মানুষকে ভুল বোঝাতে নামবে গেরুয়া শিবির৷ কিন্তু সে তো পুরোপুরি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বিষয়৷ প্রশ্ন অন্য, ওই আইন চালু করা নিয়ে একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কীভাবে বলেন, "মমতাদিদি, আপনি কিছুই করতে পারবেন না। কান খুলে শুনে রাখুন, সিএএ লাগু হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না।" রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং শাসক দলের প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, "তৃণমূলের লোকেরা কান খুলে শুনে নিন, সিএএ বাস্তব ছিল, আছে এবং থাকবে। মমতা দিদি, আপনি কিছুই করতে পারবেন না।"
সিএএ চালু করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে প্রশাসনিক পদ্ধতি মেনে কেন্দ্র তা করতেই পারে৷ বিরোধীদের আপত্তি থাকলে গণতান্ত্রিক পথে তারা প্রতিবাদও করতে পারে৷ কিন্তু বিষয়টিকে যেন ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে এ কোন ভাষায় কথা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? এটাই কি শাহি-সহবত ? 'কিছুই করতে পারবেন না', 'কান খুলে শুনে রাখুন', 'কেউ আটকাতে পারবে না', এমন ভাষাতেই তো এলাকার গুণ্ডা- মস্তানরা হুমকি দেয়! দলীয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে, কর্মীদের উৎসাহ দিতে এমন কথা বলার দরকার থাকলে, তা তো পরিশীলিত ভাষাতেও বলতে পারতেন শাহ৷ তা না করে কার্যত দেখে নেওয়ার হুমকি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে, হালের রাজনীতি কি এতটাই তলিয়ে গিয়েছে ?
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে অমিত শাহ বাংলায় এসে গরম গরম হুমকি দিয়ে গেলেও, তা স্রেফ কথার কথা বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ৷ লোকসভা ভোটের মুখে এই আইন দেশবাসীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যে চরম ঝুঁকির, তা বিজেপি নেতৃত্বের না বোঝার কথা নয়৷ কেন্দ্র সিএএ কার্যকর করতে গেলেই যে বিরোধীরা ফের একেবারে হাতে গরম অ্যাজেণ্ডা নিয়ে এর বিরুদ্ধে হই হই করে মাঠে নেমে পড়বে, তা সবার জানা।
কিন্তু রাজনীতি বড় বালাই, পাবলিককে গ্যাস খাওয়াতেই হয়৷ তাই বোধহয় ঢাল হিসেবে করোনা অতিমারিকে ব্যবহার করে মুখরক্ষার চেষ্টা করেছেন অমিত শাহ৷ বলেছেন, দেশ করোনা- মুক্ত হলেই সিএএ লাগু হবে৷ ওদিকে বিশেষজ্ঞদের স্পষ্ট অভিমত, দেশ থেকে কখনই নির্মূল, নিশ্চিহ্ন হবে না করোনা৷ কোভিড- ১৯ কে সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হবে। ভ্যারিয়েন্ট বদলাতে থাকবে। ওদিকে দেশে করোনার দাপট বাড়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের এই অভিমত বিজেপির শীর্ষস্তর বা শাহ জানেন না, তা হতেই পারেনা৷ শাহ জানেন, করোনা যথারীতি থাকছে। দেশ করোনা-মুক্ত হবেনা৷ ফলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনও কার্যকর করার প্রশ্ন উঠছে না৷ কিন্তু দলীয় নেতা-কর্মী তথা সাধারণ মানুষকে তো বোকা বানাতেই হবে৷ এটাই তো রাজনীতি, এটাই শীর্ষনেতার কাজ৷ বাংলা সফরে এসে, ক্যালকুলেটিভ পথে ঠিক সেই কাজটাই করে গেলেন অমিত শাহ৷
শাহের বাধ্যকতা রয়েছে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার। জনতার একাংশকে ধরে রাখতে হবে৷ সে কাজ স্বছন্দে করতেই পারেন উনি৷ মানুষ বোকা নয়, সবই বুঝতে পারে, ধরতে পারে৷ কিন্তু হুমকি দিতে গিয়ে এতখানি অসংযমী ভাষা ব্যবহার না করলেও তো পারতেন৷ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের ভাষা কি মানানসই ?