কেন দক্ষিণ ভারতীয় প্রতিমার ছাঁচে গড়া রামলালার মূর্তি?
Ram lalla Idol South Indian Style : পেরিয়ারের 'রামায়ণ পাথিরঙ্গল' ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। শূদ্র হওয়ার কারণে রাম শম্বুককে হত্যা করেছিলেন।
রামের যে মূর্তিটি অযোধ্যার রাম মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেটি রামের বড় বয়সের নয়। রামলালার মূর্তি, অর্থাৎ শিশু রামের মূর্তি। রামের পাঁচ বছর বয়সের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে এই মূর্তি গড়া হয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে এই যে পাঁচ বছর বয়সি রাম লালার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে তার উচ্চতা ৫১ ইঞ্চি। রং গাঢ় কালো। এই শিশু রাম পদ্মের উপর উপবিষ্ট। পদ্মফুলসহ প্রতিমার উচ্চতা হবে আট ফুট। কিন্তু রামের প্রচলিত ছবির সঙ্গে একেবারেই মিল নেই কেন এই মূর্তির? এই মূর্তির গড়ন দক্ষিণ ভারতীয়। কেন বিশেষ এই ধাঁচই বেছে নিল অযোধ্যা?
এই উত্তরের আগে বেশ কয়েকটি বিষয়কে মাথায় রাখা দরকার। রাম মন্দিরে রামলালার পাঁচ বছরের রূপই কেন স্থাপন হচ্ছে? হিন্দুধর্মে পাঁচ বা তার কম বয়সি বাচ্চাদের নির্দোষ হিসাবে দেখা হয়। পাঁচ বছর বয়সের পরে শিশুরা চারপাশের নানা জিনিস বুঝতে শুরু করে বলে মনে করা হয়। চাণক্যের মতো পণ্ডিতদের মতে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর করা ভুলগুলি নির্দোষ ভেবেই কারণে ক্ষমা করা হয়। তাই এই পাঁচ বছরের শিশু রামের মূর্তি স্থাপন করে আসলে রামের 'নিষ্পাপ রূপ'-কে চিত্রিত করা হচ্ছে বলেই দাবি।
কিন্তু দক্ষিণভারতে কখনই রাম জনপ্রিয় চরিত্র ছিল না। উত্তরভারতের রামায়ণ আর দক্ষিণভারতের রামায়ণের মধ্যে ফারাকও বিস্তর। তাহলে এই বিশেষ ধাঁচ কি দক্ষিণ ভারতকে রাম ও বিজেপিমুখী করার প্রয়াস?
আরও পড়ুন- ২২ জানুয়ারিই বজরং দলের হাতে হত্যা হয় পাদ্রীর! প্রাণ প্রতিষ্ঠার আড়ালে হারাচ্ছে যে ঘটনার স্মৃতি
কাকভূশুণ্ডি ছিলেন রামের ভক্ত। কাক সেজে গরুড়কে রামায়ণের গল্প বর্ণনা করেছেন এই কাকভূশুণ্ডি। এই কাকভূশুণ্ডিদের চিরঞ্জীবী বলে মনে করা হয়, বিশ্বাস করা হয় কাকভূশুণ্ডি এখনও জীবিত এবং পৃথিবীতে আছেন। কাকভূশুণ্ডি মূলত অযোধ্যার শূদ্র শ্রেণির মানুষ ছিলেন। একবার শিব রেগে গিয়ে তাকে সাপ হওয়ার অভিশাপ দেন। পরে অনুনয়-বিনয় করায় শিব শাস্তি কমিয়ে দেন এবং বলেন, বহু জন্ম পর তিনি কাকভূশুণ্ডি হয়ে ব্রাহ্মণ হিসেবে জন্ম নেবেন এবং রামের ভক্ত হবেন। কিন্তু পরে আবার অভিশাপের কারণে তিনি কাক হয়ে যান। কাকভূশুণ্ডি গড়ুড়কে বলেছিলেন শিশুরামচন্দ্রর দেহে কোটি কোটি কামদেবতার সৌন্দর্য রয়েছে। এই মূর্তি মাত্র ৫১ ইঞ্চি লম্বা কারণ বর্তমান ভারতে কোনও পাঁচ বছর বয়সি শিশু সাধারণত প্রায় ৪৩ থেকে ৪৫ ইঞ্চিই লম্বা হয়। রামের সময়ে লোকজন নাকি সাধারণত লম্বা ছিল। তাই মূর্তির উচ্চতা ৫১ ইঞ্চি।
অযোধ্যায় যদি জন্ম, তাহলে আর্য রামচন্দ্রের এই রামলালা মূর্তি কেন দক্ষিণ ভারতীয় ঘরানায় তৈরি? মাইসুরুর বিখ্যাত ভাস্কর অরুণ যোগীরাজ কালো পাথরের রামলালার মূর্তি গড়েছেন। মূর্তির ডান হারে আশীর্বাদের মুদ্রা, সেখানে তিরও ধরে রাখা আছে। বাম হাতটিতে একটি ধনুক। রামলালা মূর্তির দুই পাশে বিষ্ণুর ১০ অবতারই খোদাই করা আছে। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও কল্কি নামে দশটি অবতারের অবয়বই মূর্তির উপরে খোদাই করা আছে। ডান পায়ের কাছে হনুমান এবং বাম পায়ের কাছে গরুড়। অরুণ যোগীরাজ এর আগে কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং অন্ধ্র প্রদেশের মন্দিরগুলির মূর্তি গড়েছেন। সেই ঘরানার মূর্তিই এটি।
রামায়ণ মহাকাব্যটি ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকলেও রাম কখনই পূর্ব বা দক্ষিণ ভারতে ব্যাপকভাবে পূজিত ছিলেন না। পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু এবং কেরলের হিন্দুরা বিভিন্ন দেবী বা স্থানীয় দেবতা বা কৃষ্ণের আরাধনা কিন্তু বেশি করতেন। রামভক্তি প্রথমে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তুলসীদাসের রামচরিতমানস উত্তর ভারতীয়দের কাছে জনপ্রিয় আর বাংলায় কৃত্তিবাসী। কাম্পান এবং এজুথাচানের রামায়ণের সংস্করণগুলি দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয়।
দ্বাদশ শতাব্দীতে কাম্পানের অত্যন্ত ভক্তিমূলক ইরামাবতারম থেকে শুরু করে রামায়ণ দক্ষিণ ভারতের সমস্ত ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রামের গল্প দক্ষিণ ভারতে খুব জনপ্রিয় হলেও রামকে গণপূজা করা হয়নি। তামিলনাড়ুর ধর্ম বিষয়টি অত্যন্ত বিস্তৃত। এখানের প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন লোক দেবতা, পারিবারিক দেবতা এবং রীতিনীতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুদালাইমাদান, ইসাকিয়াম্মান দক্ষিণ তামিলনাড়ুতে পূজিত হন এবং কঙ্গু অঞ্চলে আনানমারের পুজো করা হয়। এখানে শৈবধর্মও প্রভাবশালী। মুরুগানের মতো দেবতার পুজো হয়।
তামিল বৈষ্ণব আন্দোলন সপ্তম শতাব্দীর ভক্তি আন্দোলনে কৃষ্ণকেই বেছে নিয়েছিল। ব্যতিক্রম হিসেবে রামকে সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল। রামের মন্দিরগুলি পরবর্তীকালে চোল, পাণ্ড্য এবং বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত হয়েছিল। তামিলনাড়ুতে পাওয়া বেশিরভাগ ব্রোঞ্জের মূর্তি কৃষ্ণরই ছিল। কেরলেও কৃষ্ণই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আসলে রামায়ণের রাম মানুষের ততটা কাছাকাছি নন, কৃষ্ণ তার দুষ্টুমি এবং দুঃসাহসিকতায় অনেক বেশি মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।
আরও পড়ুন- অযোধ্যায় চাষিদের ঠকিয়ে, কোটি কোটি টাকায় জমি বিক্রি করা হয়েছে আদানি গোষ্ঠীকে?
কেরলের রামের কম জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ ভগবতী কাভুস বা দেবী ধর্মের মতো দ্রাবিড় ঐতিহ্য। বাংলাতেও রামকে বিষ্ণুর প্রথম মানব অবতার হিসাবে 'ভগবানের' মর্যাদা দেওয়া হলেও মন্দির গড়ে পুজোর আয়োজন হয়নি। বাংলার অধিকাংশ মানুষ শক্তির উপাসনা করে, দেবীর বিভিন্ন রূপে মূর্তি গড়ে।
তামিলনাড়ুতে পেরিয়ারের আন্দোলন রামায়ণ এবং এর চরিত্রগুলিকে সনাতন ধর্মের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেছিল, সমাজে বর্ণভেদের মূল। পেরিয়ারের 'রামায়ণ পাথিরঙ্গল' ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। শূদ্র হওয়ার কারণে রাম শম্বুককে হত্যা করেছিলেন। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিরুদ্ধে শূদ্রদের একজোট করা, দলিত আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ার রামায়ণকে আর্য বনাম দ্রাবিড় যুদ্ধ হিসাবেই তুলে আনেন নিক্ষেপ করেছিলেন। পেরিয়ার বলেছিলেন এই মহাকাব্যটি দ্রাবিড়দের বিরুদ্ধে এবং রাবণ আসলে একজন তামিল। তাই ১৯৫০ এর দশক থেকে তামিলনাড়ুতে একটি প্রজন্ম রামায়ণ না পড়েই বড় হয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকরাই৷
১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে দূরদর্শনে রামায়ণ শুরু হওয়া ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রতি সপ্তাহে আনুমানিক ৮ লক্ষ মানুষ এই সিরিয়াল দেখতেন। অনেকেই একে ধর্মীয় আচরণ হিসেবেই দেখতেন। ভারত জুড়ে এখন যে হিড়িক শুরু হয়েছে রামকে নিয়ে তা এমন সব অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে যেখানে মূলধারার দেবতারা পূজিতই নন। ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতি বুকে নিয়ে পেটের টানে মানুষ অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে, সেই সংস্কৃতির মধ্যে নতুন বীজ পোঁতা হয়েছে। তামিলনাড়ু, কেরলেও রামকে ঘিরে ধর্মীয় শক্তি এবং আচার-অনুষ্ঠান বেড়েছে। আর এই বৃদ্ধিকেই কি নিজের দিকে টানতে চাইছে বিজেপি? তাই দক্ষিণ ভারতীয় ছাঁচে গড়া রামমূর্তিই প্রতিষ্ঠা হলো মন্দিরে? দক্ষিণ ভারতে গেরুয়া রং এখনও ঠিক ছাপ ফেলেনি। উত্তর, পশ্চিম ও উত্তর পূর্ব ভারতে বিজেপির দাপট রইলেও দক্ষিণ ভারতের জমি পায়নি গেরুয়া দল। এবার কি সেই মানুষদের টানতেই রাম-অস্ত্র ব্যবহার করছে বিজেপি-আরএসএস?