উদ্বাস্তু হচ্ছে বাঘও! কেন বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসছে বাঘের দল?
Sundarban Tiger: বিশ্বের ৭৫ শতাংশ বাঘের আবাস ভারতে। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে ভারতের জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ জানায়, ভারতে গত এক দশকে রেকর্ড সংখ্যক ১২৬ টি বাঘ মারা গেছে।
প্রায় ৭০ বছর পরে আজ ভারতে পা পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী চিতার। আফ্রিকার দেশ নামিবিয়া থেকে আজ ভারতে আনা হয়েছে ৮টি চিতাকে। চিতাগুলিকে নামিবিয়া থেকে আনতে একাধিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন বি৭৪৭ জাম্বো জেট পাঠিয়েছিল নয়াদিল্লি। চিতাদের রাজকীয় অভ্যর্থনা জানাতে যখন সাজ সাজ রব ঠিক তার আগে ভারতের জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ এনটিসিএ-র আনন্দ দ্বিগুণ করেছে পশ্চিমবঙ্গের বনদপ্তরের বাঘ বৃদ্ধির ঘোষণা। গত বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গণ্ডার সংরক্ষণ ও গণ্ডার শুমারি সংক্রান্ত পুরোনো আইন প্রত্যাহার বিষয়ে বলতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে বাঘের বৃদ্ধির কথা জানান। তবে এই সমস্ত বাঘের বসতভিটা বাংলাদেশ। তাদের ভারতমুখী হওয়ার পিছনে রয়েছে খাদ্যের অভাব। খুব সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যেই এইসব বাঘ বাংলাদেশের সুন্দরবনের অংশ থেকে ভারতের অংশে প্রবেশ করেছে।
সুন্দরবনের জঙ্গলে খাদ্য শৃঙ্খলের একেবারে ওপরে বসে রয়েছে বাঘ। জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ খুবই প্রয়োজন। এবার সংরক্ষণ আদৌ ভালো হচ্ছে না কি খারাপ, তাই ধরা পড়ে বাঘশুমারিতে। গণ্ডার সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণে সাফল্যের উদাহরণ তুলে আনেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। বিধায়সভায় তিনি বলেন, “জঙ্গলে খাবারে টান ধরলেই বাঘ গ্রামে ঢুকে পড়ে। তাই বাঘ নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে বাঘের খাবারের যাতে অভাব না দেখা দেয় তা নিয়েও স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই নৌকায় চাপিয়ে হরিণ এবং শূকর নিয়মিত ছেড়ে দিয়ে আসা হয় গভীর জঙ্গলে। ফলে সাফল্য মিলেছে। বাংলাদেশের জঙ্গলে খাবার নেই। তাই বাঘ এদেশে চলে আসছে।” মন্ত্রী বলেন “সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে এখন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমবেশি ১২৩টি। প্রায় ২৭টি বাঘ বেড়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের বাঘ শুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৯৬টি।”
মন্ত্রী জানিয়েছেন, এই বছর বাঘ শুমারির তথ্য এবং ছবি হায়দরাবাদে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এখনও আসেনি। তবে সংখ্যা বাড়ার ইঙ্গিত মিলেছে। সুন্দরবন এলাকায় রামগঙ্গা–সহ অন্যান্য এলাকায় অন্তত পাঁচটি দ্বীপে বাঘের সন্ধান মিলেছে। এই দ্বীপগুলিকে টাইগার রিজার্ভের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ফলে এখানকার সংখ্যাটাও যোগ হবে। ভবিষ্যতে বাঘেরাও বাচ্চার জন্ম দেবে। সংখ্যা আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন- আফ্রিকার চিতা ধরে রাখা যাবে ভারতের অরণ্যে?
এমন ঘটনায় উচ্ছ্বসিত ভারতীয় বন কর্মকর্তারা। সুন্দরবনের ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তা টি নারায়ণ জানান, মানুষের টেনে দেওয়া আন্তর্জাতিক সীমারেখা প্রাণীদের জন্য কাজ করে না। শিকারের সন্ধানে ও সঙ্গী আছে কিনা- এসব নানা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব সীমানা ঠিক করে তারা। এরকমই প্রাণী বাঘ, সঙ্গীর খোঁজে অনেক দূর পর্যন্ত পাড়ি জমায় সে। প্রজনন মরশুমে সাধারণত দুই দেশের মধ্যে বাঘের ব্যাপক যাতায়াত লক্ষ্য করা যায়। তবে সেটাও এত ব্যাপক মাত্রাতেও নয়। গতবছর নাকি এমন মাত্র ৬টি ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। সাধারণত বাঘের প্রজনন ঋতু নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। তার আগেই এত বাঘ চলে আসার পিছনে কারণ হিসেবে তিনি জানাচ্ছেন, তুলনামূলক নিরাপদ আবাসভূমি এবং খাদ্য প্রাচুর্যতার কারণেই বাংলাদেশের বাঘ চলে আসছে ভারতের সুন্দরবনে।
বিশ্বের ৭৫ শতাংশ বাঘের আবাস ভারতে। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে ভারতের জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ এনটিসিএ তার বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, ভারতে গত এক দশকে রেকর্ড সংখ্যক ১২৬ টি বাঘ মারা গেছে। এনটিসিএ জানিয়েছে, ভারতে গত এক দশকে বেশিরভাগ বাঘের মৃত্যু স্বাভাবিক কারণে হয়েছে। তবে অনেক বাঘ চোরাশিকারিদের গুলি ও ফাঁদে পড়ে এবং লোকালয়ে ঢুকে পড়ে গণপিটুনিতেও মারা গেছে। ওয়াইল্ডলাইফ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর ভিবি মাথুর বলেন, “নিঃসন্দেহে দেশের বন দফতর অরণ্য সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে বিগত কয়েক বছর। দেশে অভয়ারণ্যের সংখ্যা ২৮ থেকে বেড়ে ৫০ হয়েছে শেষ ১৪ বছরে। ঘন জঙ্গল ছাড়াও সংলগ্ন অঞ্চল সংরক্ষিত হওয়ায় বাঘের বিচরণ ভূমি বেড়েছে। পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে বাঘেদের প্রজনন খুব তাড়াতাড়ি হয়। জঙ্গলের কোর অঞ্চলের বাইরে একটু দূরে দূরে যে গ্রাম গড়ে উঠেছিল সেসব সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সরকারি তত্ত্বাবধানে। ফলে নির্বিঘ্নে বাঘেদের বিচরণ ভূমি বেড়েছে।”
ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার নীতিন দেশাই বলেন, “বাঘ শিকারিদের উপর কড়া নজরদারি বাড়ার ফলেও অনেকটা বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। ২০১৩ সালের পর থেকে সংগঠিত বাঘ শিকারের কোনও ঘটনা ঘটেনি। বাঘ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও গত এক দশকে দ্বিগুণের বেশি বাজেট বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের তুলনায় দেশের বাঘের সংখ্যা ২২২৬ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৬৭।
চার বছর অন্তর অন্তর ভারতে বাঘশুমারি হয়। শেষ শুমারিতেই সবথেকে বেশি বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ছিল ৭৬ ও ৮৮টি। ২০২০-২১ এ সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯৬টি। সম্পূর্ণ সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ পড়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি ৪০ শতাংশ পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এবং ভারতের অংশে আয়তন প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই বনের বিস্তার বাংলাদেশে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও পটুয়াখালি এবং পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পর্যন্ত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে ও ভারতে দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরবনের অবস্থান। দুই দেশের বন বিভাগেরই দাবি, সুন্দরবনে ছেলে বাঘ বা মেয়ে বাঘের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে তাদের জানা নেই। তবে, সাধারণত একটি বনে মোট বাঘের সংখ্যার মধ্যে ছেলে বাঘ থাকে এক চতুর্থাংশ।
আরও পড়ুন- আজও বাঘের চোখে চোখ রেখে জঙ্গলে পা ফেলেন সুন্দরবনের ‘বাঘ বিধবা’-রা
সর্বশেষ বাঘ শুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি, ফলে এই বনে ৩০টির মতো পুরুষ বাঘ থাকার কথা। ভারতীয় বন বিভাগের আশঙ্কা, বাংলাদেশের বনে অস্বাভাবিকভাবে নারী বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মূলত নারী সঙ্গীর খোঁজে ভারতের অংশে আসতে পারে নিঃসঙ্গ পুরুষ বাঘেরা। ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারিতে এই সংখ্যা ১১৪টি।
তবে মন্ত্রী যতই দাবি করুন, সুন্দরবনের জঙ্গলে খাদ্যের অভাব নেই এমন তথ্য মানতে রাজি নয় সুন্দরবন লাগোয়া ভারতীয় গ্রামগুলির বাসিন্দারা। তাঁদের কথায়, গত কয়েক বছরে সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামগুলিতে নিয়মিতভাবে বেড়েছে বাঘের আনাগোনা। বারবার জঙ্গল থেকে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে বাঘ৷ এতে হতাহত হচ্ছে মানুষ, গৃহপালিত পশু৷ গত এক দশকে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে বছরে গড়ে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৮-৯ জনের। গত বছরের নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জ, কুলতলি, গোসাবা, বাসন্তী ব্লকের লোকালয়ে কম করে ১৬ বার বাঘের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বাঘের হামলায় গ্রামবাসী বা মৎস্যজীবীর মৃত্যু হয়েছে, কোথাও গৃহপালিত পশু মারা পড়ছে৷ ডাব্লিউডাব্লিউএফ সুন্দরবন প্রোগ্রামের অধিকর্তা অনমিত্র অনুরাগ দণ্ড এজন্য বাঘের খাদ্যাভাবকেই দায়ী করেছেন৷ তিনি জানান, বিভিন্ন কারণে বনাঞ্চলে খাদ্যের অভাব হতে পারে৷ জঙ্গলে বাঘের জায়গা বাড়ছে না, বংশবৃদ্ধি হলে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবেই৷ তাছাড়া জঙ্গলের নিরাপত্তা নেট কেটে জঙ্গলে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনাকেও তিনি দায়ী করেন। অনমিত্র বলেন, “বাঘ বৃদ্ধ হলে সমস্যা বেশি। সহজ শিকারের লোভে কাটা নিরাপত্তা নেট পেরিয়ে গ্রামের গবাদি পশু শিকারের জন্য তারা লোকালয়ে চলে আসে।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক কড়াভাবে জঙ্গলে খাদ্যাভাবের কারণটি নাকচ করেছেন৷ তাঁর মতে, খাবারের অভাব কারণ নয়। বাঘের প্রজনন মরশুম এলেই সঙ্গীর খোঁজে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়৷ মন্ত্রীকে সমর্থন করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা শিবাজী ভট্টাচার্য বলেন, “লোকালয়ে বাঘ হাজির হচ্ছে না বাঘিনী সেটা আগে দেখতে হবে। প্রজনন সময়ে বাঘিনী বাঘকে আহবান করে, কোনও বাঘ তার প্রস্তাবে রাজি না হলে বাঘিনীকে তার এলাকা থেকে বার করে দেয়, ফলে স্থানান্তরের সময় গ্রামে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, আমাদের জঙ্গলে খাদ্যের সংকট নেই!”