মাস্টারস্ট্রোক না ষড়যন্ত্র! ভারত-পাক হাইভোল্ট ম্যাচের আগে আরও ৪ লক্ষ টিকিট কেন বিলোচ্ছে BCCI?

ODI World Cup: শুধুই কি জনগণের চাপে পড়ে নতুন করে টিকিট রিলিজের সিদ্ধান্ত নিলো বিসিসিআই? নাকি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোনও সমীকরণ?

ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই যেন আলাদা উত্তেজনা! অফিস-কাছারি, হাজের চোদ্দটা কাজ তাড়াতাড়ি সেরে টিভির সামনে ভিড় জমে ওঠা। বাইশ গজের যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান, তায় আবার বিশ্বকাপে। স্বাভাবিক ভাবেই এর আবেদন আলাদা। আর সেই ম্যাচের টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়বে না, তা আবার হয় নাকি! শুধু ভারতে বলে নয়, পাকিস্তানের দর্শকদের কাছেও এই ম্যাচের আবেদন যেন অনেকটা আলাদা। এমনিতেই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ম্যাচ তেমন একটা হয় না। রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে দুই দলের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রতিযোগিতা প্রায় দশ বছর ধরে বন্ধ। ফলে বাইশ গজে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট বা মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের জন্য। তাই যখনই এরকম একটা ম্যাচের আয়োজন হয়, তার উন্মাদনা থাকে তুঙ্গে। তার মধ্যে সে যদি হয় বিশ্বকাপের ম্যাচ, তাহলে তো কথাই নেই। উত্তেজনা বাড়লেই বাড়ে টিকিটের চাপও।

টিকিটের এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখে এবার ৪ লক্ষ অতিরিক্ত টিকিট বিক্রির ঘোষণা করেছে বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া ওরফে বিসিসিআই। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সময় সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে টিকিট বিক্রি। আইসিসি আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, ভারতের সমস্ত প্রস্তুতিম্যাচ ও লীগের ম্যাচের পাশাপাশি বিশ্বকাপের বাকি দলগুলির যাবতীয় ম্যাচের টিকিট বিক্রি শুরু হবে ২৫ আগস্ট থেকে, চলবে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু, পরবর্তীতে বিষয়টা পাল্টে যায়। আগে বিসিসিআই পর্যায়ক্রমে টিকিট বিক্রি শুরু করেছিল। কিন্তু, সেখানে শুরু হয় আরও এক সমস্যা। টিকিটের চাহিদা এতটাই আকাশছোঁয়া ছিল যে চাপের মুখে পড়ে বিসিসিআই। সেই চাপ সামলাতে এবার ৪ লক্ষ নতুন টিকিট নিয়ে বিক্রির কথা ঘোষণা করে দিল বিসিসিআই।

আরও পড়ুন: ক্রিকেটের শেষ ঈশ্বর, আমজনতার শেষ ভরসা সচিনই?

বিসিসিআইয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের টিকিট বিক্রি শুরু হতে না হতেই ক্রিকেট ভক্তরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের ক্ষোভ উগড়ে দিতে থাকেন। হবে না-ই বা কেন! বিসিসিআইয়ের পোস্ট দেখে টিকিট কাটতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তাঁদের হতে হয়েছে, তাতে হতাশ না-হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের ম্যাচের টিকিট মূলত বিক্রি হয় 'বুক মাই শো' ওয়েবসাইটে। কিন্তু এই বড় ম্যাচের আগে ভিড়ের চাপে রীতিমত ক্র্যাশ করে যায় ওয়েবসাইট। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও মেলেনি টিকিট। অভিযোগ ওঠে দুর্নীতিরও। আর এ ব্যাপারটি ঘিরে ঘরে বাইরে সব জায়গাতেই চাপের মুখে পড়তে হয় বিসিসিআইকে। শেষমেশ তাই সিদ্ধান্তে বদল আনতে বাধ্য হয় ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা।

শুধু যে ক্রিকেট ভক্তদের তোপের মুখে পড়েছে বিসিসিআই, তাই নয়, ভারতের প্রাক্তন খেলোয়ারেরাও ব্যাপারটি নিয়ে তুলোধোনা করেছে তাদের। এমনিতেই ওয়ানডে বিশ্বকাপে এই দুই দলের ম্যাচের টিকিটের যা দাম উঠেছে তা ভাবনার বাইরে। হাইভোল্টেজ এই ম্যাচের একটি টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫৭ লক্ষ টাকায়! টিকিট তো নয়, এ যেন একেবারে 'সোনার হরিণ'!

গত ২৯ আগস্ট এবং ৩ সেপ্টেম্বর দুই দফায় ভারত পাকিস্তান ম্যাচের টিকিট বাজারে ছাড়া হয়েছিল। প্রতিবারই মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই বহুল প্রতীক্ষিত এই ম্যাচের টিকিট পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়। আর তখনই শুরু হয় কালোবাজারি। 'বুক মাই শো' থেকে টিকিট কিনে অনেকেই চড়া দামে বিক্রি করতে শুরু করেন টিকিট। অনলাইনে রীতিমতো নিলামে উঠতে থাকে ম্যাচ টিকিট। জানা গিয়েছে, 'ভিয়াগোগো' নামে তেমনই একটি ওয়েবসাইট নাকি মাঠের এক অংশের টিকিট ২১ লক্ষ টাকায় বিক্রি করতে শুরু করে, অন্য অংশের টিকিট মূল্য রাখা হয় ৫৭ লক্ষ টাকার মতো। ফলে মূল ওয়েবসাইটে টিকিট না পেয়ে অন্য উপায় টিকিট সংগ্রহ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন অনেকে। ফলে কালোবাজারির ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে ওঠে।

কিন্তু দেখতে গেলে, যে গুজরাটের মোতেরা তথা নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে এক লক্ষেরও বেশি আসন রয়েছে দর্শকদের জন্য। তবে এত কম সংখ্যক টিকিট রিলিজ কেন করল বিসিসিআই! বিষয়টা প্রথম থেকেই বেশ সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন অনেকে। ভারতের প্রাক্তন পেসার ভেঙ্কটেশ প্রসাদ বিসিসিআইকে একপ্রকার ধমকই দিয়ে ফেললেন এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে। কেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা আসনই সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ করবে বিসিসিআই? তাহলে কি প্রথম থেকেই কালোবাজারির ছক কষা ছিল? এমনকী ভিয়াগোগোর মতো ওয়েবসাইটগুলির সঙ্গে সরাসরি যোগসাজসের তত্ত্বও উঠে এসেছে? নাকি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণ? কেন গোড়া থেকেই টিকিট বিক্রিতে স্বচ্ছতা দেখায়নি বিসিসিআই? যেখানে ন্যূনতম ৮৫০০ সিট ভক্তদের জন্য রাখার কথা, সেখানে কেন এই গাফিলতি? আপাতত ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এমনই হাজারটা প্রশ্ন।

হিসেব বলছে, অন্যসব ম্যাচে যেভাবে ভক্তদের জন্য একটা নির্দিষ্ট অংশের টিকিট বরাদ্দ রাখা হয়, ঠিক সেভাবেই এই ম্যাচেও ৮৫০০ সিট ভক্তদের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত ছিল বিসিসিআইয়ের। অনেকেই মনে করছেন, বিগত কয়েক বছর ধরেই কর্পোরেট এবং অন্যান্য ধনী সদস্যদের খুশি করাটা বিসিসিআইয়ের একটা পরম্পরা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব সময়ই কর্পোরেট রিজার্ভেশন তাই একটু বেশি রাখা হয় প্রতিটি খেলার মাঠে। অথচ যারা ক্রিকেট বা টিম ইন্ডিয়ার ডাই হার্ড ফ্যান, তাদের হাতে থেকে যায় পেনসিল। তাঁদের জন্য টিকিট বরাদ্দ থাকে না বললেই চলে। ক্রিকেট ভক্তদের বঞ্চিত করাটাই যেন লক্ষ্য বিসিসিআইয়ের। তোপ দেগেছেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।

আরও পড়ুন: মাঠে নামলেই ছয়ের বন্যা! আইপিএলে সেরা ছক্কা হাঁকিয়েছেন কোন ক্রিকেটাররা, জানেন?

আর এই ব্যাপক সমালোচনা আর বিতর্কের মুখে পড়েই শেষমেষ হুশ ফিরেছে বিসিসিআইয়ের। তাঁরা রীতিমতো ঘোষণা করে জানিয়ে দিয়েছে, অতিরিক্ত চার লক্ষ টিকিট বিক্রি শুরু হবে আগামীকাল সকাল থেকে। লিগ ম্যাচের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলির টিকিট সংখ্যাও বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে। এমনকী নিজেদের ভুল স্বীকার করে ইতিমধ্যেই অফিসিয়াল বিবৃতিও জারি করেছে বিসিসিআই। তারা জানিয়েছে, ভক্তরাই যে টুর্নামেন্টের হৃদস্পন্দন, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বিসিসিআই। ২০২৩ আইসিসি পুরুষদের বিশ্বকাপে তাঁদের অটুট আবেগ বিসিসিআইকে অনুপ্রাণিত করেছে। টিকিট নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল। হোস্টিং স্টেট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনার পরে এই হাই ভোল্টেজ টুর্নামেন্টের জন্য আরও চার লক্ষ টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থা। আশা করা যাচ্ছে, এই পদক্ষেপের ফলে উৎসাহী ক্রিকেট ভক্তরা এই ঐতিহাসিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

প্রশ্ন উঠেছে, শুধুই কি জনগণের চাপে পড়ে নতুন করে টিকিট রিলিজের সিদ্ধান্ত নিলো বিসিসিআই? নাকি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোনও সমীকরণ? কালোবাজারি করে যে টাকা আসছে সেটা কি কোনও বিশেষ ফান্ডে জমা পড়ার কথা ছিল? উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্নও। কর্পোরেট ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে কি সাধারণ মানুষকে একেবারেই ভুলে গেছিলেন জয় শাহ, রজার বিনিরা? নাকি এটাও আবার ভোটের আগে বিজেপি সরকারের অদ্ভুত কোনও এক মাস্টারস্ট্রোক?

More Articles