স্নেহ না সৌজন্য! শুভেন্দু অধিকারীকে কেন 'ক্ষমা' করে দিলেন মমতা?

Mamata Banerjee: বিজেপিকে যিনি হামেশাই মঞ্চে, জনসভায় তুলোধনা করেন সেই মমতাই হঠাৎ ক্ষমার পরাকাষ্ঠা হয়ে আগলে নিলেন প্রাক্তন তৃণমূল-অধুনা বিজেপি নেতাকে।

দলের এককালের বিশ্বস্ত সেনার প্রতি পুরাতন স্নেহ? নাকি বিরোধীদের দীর্ঘদিনের "যাহা বিজেপি, তাহাই তৃণমূল" ধারণাকেই মান্যতা? শুভেন্দু অধিকারীকে যেভাবে বাঁচালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে এই প্রশ্ন নতুন করে বাংলার রাজনীতির আকাশে ছন্নছাড়া মেঘের মতোই ভেসে উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই বাংলার প্রধান বিরোধী দলের নেতা শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভায় সাসপেনশন থেকে রক্ষা পেয়েছেন। বিজেপিকে যিনি হামেশাই মঞ্চে, জনসভায় তুলোধনা করেন সেই মমতাই হঠাৎ ক্ষমার পরাকাষ্ঠা হয়ে আগলে নিলেন প্রাক্তন তৃণমূল-অধুনা বিজেপি নেতাকে। স্পিকারকে 'অপমান' করার পরেও শুভেন্দুর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেন খোদ মমতা! শুধু তাই নয়, মুখ্যমন্ত্রী নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর আচরণের নিন্দা করার সময়ও তেমন কড়া কথা শোনাননি, ক্ষমা করেছেন, ক্ষমা করতেই বলেছেন।

বিধানসভায় সোমবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেন, “রাজ্যপালকে দিয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়ানো হচ্ছে।” পাশাপাশি তৃণমূলের ত্রুটি ঢাকতে রাজ্যপাল নিরপেক্ষ থাকছেন না এবং রাজ্যপালের বক্তব্যে দুর্নীতি, সন্ত্রাসের প্রসঙ্গও উঠে আসছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি। শুভেন্দুর এই বক্তব্য রাখার সময়েই তাঁর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘পিসি চোর, ভাইপো চোর’ স্লোগান দিতে দিতেই গেরুয়া শিবিরের বিধায়করা বিধানসভা থেকে বেরিয়ে যান।

স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ তোলেন, তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন বিরোধী দলনেতা। শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব আনার কথা ঘোষণা করেন বিমান। অন্যদিকে পাল্টা স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার কথা জানান শুভেন্দু। এর পরেই মঞ্চে মুশকিল আসান হয়ে অবতীর্ণ হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষমার বাণী নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে চান তিনি। প্রথমে জানা গিয়েছিল, ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুভেন্দুকে সাসপেন্ড করেছেন স্পিকার। মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী দলনেতার হয়ে ক্ষমা চাওয়ায় ওই সাপপেনশন প্রত্যাহার করে নেন স্পিকার। শুভেন্দুকে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব এনেছিলেন তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়। পরে তিনিও সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন।

আরও পড়ুন- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য! কেন এমনটা বললেন অমর্ত্য সেন?

মমতা শুরুতেই বলেন, "বিরোধী দলের নেতার কী লজ্জাজনক আচরণ। ওরা সবসময়ই এমন করে। ওরা সর্বত্র এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করে। আমাদের বিরুদ্ধেও। আমি ওর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাই। দয়া করে ওকে ক্ষমা করুন, ওদের ক্ষমা করুন।" বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণের প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনওরকম আক্রমণে না গিয়ে শুভেন্দু তো বটেই, বিজেপিকেও ক্ষমা করে দেওয়ার আর্জি জানান।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের ভাষণে পরে বলেন, "একজন বিরোধী নেতা কি ইডি এবং সিবিআই সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলতে পারেন এবং নির্দেশ দিতে পারেন যে তারা কোথায় অভিযান চালাবেন? তিনি কি রাজ্যপাল সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারেন?"

রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় অনুদান অন্য খাতে খরচ করার অভিযোগ তুলেছিলেন শুভেন্দু। অথচ দুর্নীতির প্রসঙ্গে রাজ্যপাল কেন নীরব সেই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তহবিলের অপব্যবহার এবং ঊর্ধ্বতন আমলা ও পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন শুভেন্দু, যা স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুত্ব দেননি। তাতে যারপরনাই চটে যান শুভেন্দু, মেজাজও হারান। বিজেপি বিধায়কদের নিয়ে ওয়াকআউটের পথে যান বিরোধী নেতা।

মুখ্যমন্ত্রীর এককালীন স্নেহধন্য শুভেন্দুকে ক্ষমা করার বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত বিষয়ে বিরোধী নেতা অবশ্য বলছেন, "ওদের বোধের উদয় হোক। আমার কথা শুনুন। ওরা আমার কথা শুনলে বাংলার জন্য খারাপ হবে না, ভালোই হবে"। শুভেন্দু কিন্তু কড়া কথা, অভিযোগের দিক থেকে সরে আসেননি। তিনি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা শুভেন্দুরে বক্তৃতায় বাধা দিতেই তাঁর বিধায়কদের উত্সাহিত করছেন, এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন।

আরও পড়ুন- দলে টানতে চেয়েছেন মমতা! শুভেন্দুর যে বিস্ফোরক দাবি ঘিরে হুলুস্থূল বঙ্গরাজনীতিতে

"আমার বক্তৃতার শুরুতেই আমি বলেছিলাম যে, আমাদের রাজ্যপালের উচিত তামিলনাড়ুর রাজ্যপালের পথে চলা। তিনি রাজ্য সরকারের লিখিত বলতে অস্বীকার করেন। স্পিকার যদি সিদ্ধান্ত নেন আমার বক্তৃতায় কী থাকা উচিত, সেক্ষেত্রে তার নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে," অভিযোগ শুভেন্দুর। যদিও শেষে তিনি বলেন, বিজেপি বিধায়করা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা নিয়ম মেনেই চলবেন এবং নিজেদের অভিযোগ নিয়ে কথাও বলবেন।"

প্রেম দিবসে গরুকে আলিঙ্গন করতে বলে, পরে তা প্রত্যাহার করার বিষয়েও বিজেপিকে নিয়ে হালকা মশকরা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। "ওরা চায় আমরা ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে গরুকে জড়িয়ে ধরি। যদি একটি গরু কাউকে গুঁতিয়ে দেয় তাহলে কী হবে? কে দায়ী হবে? প্রত্যেককে আগে তো তাহলে বীমা দেওয়া উচিত। তারপরে মানুষকে এসব করতে বলা উচিত,” বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যতই লঘু দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ এবং রাজ্যের অন্য বিরোধীদল বামেদের নেতারা কিন্তু বলছেন, ক্ষমার এই বাণী আসলে রাজনৈতিক এক বড় কৌশল। বিজেপির সঙ্গে বাহ্যিক যতই কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি থাক, ভেতরের সমঝোতার নীতি মমতার এই আচরণেই স্পষ্ট। বিজেপিকে চটাতে চান না মমতা। বিশেষ করে শুভেন্দুর মতো নেতাকে তো নয়ই। তাই স্নেহ, না কি রাজনৈতিক সৌজন্য, এ অঙ্কের উত্তর সম্ভবত জানে ভোটের সমীকরণই।

More Articles